বাঙালির জীবনের প্রতিটি মর্মকথা, চলন, বলন, আবেগ-অনুভূতিতে মিশে থাকা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নৈবেদ্য কাব্যগ্রন্থে ‘মৃত্যু’ কবিতায় বলেছিলেন, ‘মৃত্যু অজ্ঞাত মোর/ আজি তার তরে/ ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ডরে/ এত ভালোবাসি/ বলে হয়েছে প্রত্যয়/ মৃত্যুরে আমি ভালোবাসিব নিশ্চয়’।
মৃত্যু অনিবার্য বাস্তবতা, মৃত্যুকে এড়িয়ে চলার উপায় নেই। তবুও কিছু মৃত্যু আছে মেনে নেয়া কষ্টকর-বেদনার্ত। তেমনি হাটহাজারী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শিক্ষাবিদ মির কফিল উদ্দীন স্যারের মৃত্যু। গেল বছর ২০২৩ সালের ২০ অক্টোবর না ফেরার দেশে চলে গেছেন তিনি। যিনি এলাকার মানুষের কাছে এবং তাঁর বিগত দিনের কর্মস্থলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে প্রিয় অধ্যক্ষ কফিল স্যার এ নামেই বেশ পরিচিত ছিলেন। শিক্ষার্থীরা তাঁকে আপনজন হিসেবে জানত। শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সকলের সাথেই ছিল তাঁর মধুর সম্পর্ক। সকলের এ প্রিয় মানুষটি বড়ো অসময়ে চলে গেলেও তাঁর কীর্তির বহমানতা রয়ে গেছে বলে তিনি এখনও বেঁচে আছেন মানুষের মাঝে।
কলেজের শিক্ষার্থীদের কল্যাণে তিনি সুসজ্জিত সেমিনার, লাইব্রেরি, শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মিলনায়তন, অডিটরিয়াম, অতিথিশালা, মসজিদ ও আধুনিক মানের কম্পিউটার ল্যাব চালু করেন। শিক্ষার্থীদের পঠনপাঠনের সুবিধার্থে বিভিন্ন বিভাগে তিনিই প্রথম চালু করেন গ্রুপ ভিত্তিক ক্লাস। তাঁর পরিকল্পনায় শিক্ষকদের প্রাণবন্ত ক্লাসে শিক্ষার্থীরা থাকত উচ্ছ্বসিত, উপভোগ করত পুরো সময়। শিক্ষার্থী-বান্ধব ও ছাত্রকল্যাণে নিবেদিত এ প্রাণপুরুষ শিক্ষকতার মহান পেশাকে জীবনের মূল লক্ষ্য বানিয়ে মেধা ও শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন শিক্ষার্থীদের প্রিয় মুখ।
১৯৫৮ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারী পৌরসভার ঐতিহ্যবাহী মীরের খিল গ্রামের মীর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন অধ্যক্ষ মির কফিল উদ্দীন। পড়াশোনা শেষ করে তিনি ১৯৮৬ সালে প্রভাষক হিসেবে হাটহাজারী সরকারি কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর কর্মজীবনের এক পর্যায়ে ২০০৯ সালের ১৪ মে তিনি অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর তিনি চেষ্টা করেছেন কলেজের অবকাঠামো, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নসহ শিক্ষক-কর্মচারীদের কল্যাণে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণসহ অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করতে। পরবর্তীতে তিনি সফলও হয়েছিলেন, সফলতা তাঁকে ধরাও দিয়েছিল।
এদিকে, ২০১৭ সালে শিক্ষার মূল্যায়নে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষিত ‘কলেজ পারফর্মেন্স র্যাংকিং’-এ চট্টগ্রাম অঞ্চলে র্যাংকিংয়ের সারাদেশের ৭১৮টি স্নাতক কলেজের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মত চট্টগ্রাম বিভাগে উক্ত কলেজে ৭ম স্থান এবং ২০১৫ সালে প্রথমবার ১২৪তম স্থান অধিকার করেছিল। তাঁর চাকরিজীবনে কলেজের উন্নতির জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। এরমধ্যে ২০১৮ সালে তিনি হাটহাজারী উপজেলায় ‘শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ’ এর খেতাবে ভূষিত হয় এবং একজন সফল অধ্যক্ষ হিসেবে বেশ সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে পেশাগত কর্ম ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকা-ে জড়িত ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) সমাজতত্ত্ব সমিতির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া চবি’র প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী ৮২ ব্যাচ এর সাময়িকীর সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। তাছাড়া চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতি এবং চট্টগ্রাম কিডনি ফাউন্ডেশন ও হাটহাজারী ডায়াবেটিক সমিতির আজীবন সদস্য এবং সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত হাটহাজারী টেলিফোন গাইড প্রকাশনা উপ-কমিটির আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর এসব কর্মে যিনি সার্বক্ষনিক অনুপ্রেরণা যোগাতেন তিনি হলেন চট্টগ্রামের স¦নামধন্য আইনজীবী বাঁশখালী নিবাসী অ্যাডভোকেট আবদুল সবুর সাহেবের ৩য় কন্যা এবং অধ্যক্ষ শিক্ষাবিদ মির কফিল উদ্দীন এর সহধর্মীনি তহুরীন সবুর। তাঁর সহধর্মীনি তহুরীন সবুর চট্টগ্রাম নগরীর এনায়েত বাজার মহিলা কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।
ত্যাগ ও নিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষকে ভালোবেসে অকৃপণভাবে মেধা ও পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষক সমাজে সকলের কাছে সমাদৃত অধ্যক্ষ কফিল স্যার প্রাজ্ঞ বিবেচনায় ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি ও ¯েœহার্দ্র আচরণের অধিকারী ছিলেন। তিনি শিক্ষকদের সম্মান ও অধিকার রক্ষায় সর্বদা নিবেদিত ছিলেন। পাশাপাশি শিক্ষকদের সম্মান রক্ষায় তাঁর দিকনিদের্শনাগুলো সত্যিই অনুসরণ করার মত ছিল। আর্থিক দিক দিয়ে সবচেয়ে অবহেলিত শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি ছিলেন এক উদার অভিভাবক। কোন জটিল ও কারো কাছে সমাধান যোগ্য নয় এমন সমস্যা নিমিষেই সমাধানের পথ খুঁজে দিতেন। কারো রক্তচক্ষুতে তাঁর সাহসে ভাঁটা পড়তে দেখিনি। শিক্ষার্থীদের কখনও শাসনে, কখনও সোহাগে; আবার কখনও কৌশলে পথ চলে প্রিয় অধ্যক্ষ কফিল স্যারে পরিণত হয়েছিলেন।
অধ্যক্ষ কফিল স্যার শিক্ষাগুরু হিসেবে নীতি-আদর্শের এক অনন্য প্রতীক। তাঁর সততা, নিষ্ঠা ও নীতি-আদর্শ সর্বমহলে সুপ্রতিষ্ঠিত। আদর্শবান এ প্রাণপুরুষের সাহচর্য পেয়ে গুণী মানুষে পরিণত হয়েছে হাজারো শিক্ষার্থী। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও চৌকষ। ধর্মীয় শিক্ষাসহ নানা বিষয়ে পা-িত্য অর্জনের পাশাপাশি তিনি যুগের চাহিদায় আধুনিক জ্ঞান রপ্ত করে সমৃদ্ধ করেছেন নিজেকে। তবে, তিনি বড় অসময়ে চলে গেলেনে। আর কিছুদিন তিনি এ ধরিত্রীর বুকে বেঁচে থাকলে আরও অনেক কিছু হাটহাজারীবাসীকে দিতে পারতেন। একজন প্রতিভাবান শিক্ষক মির কফিল স্যারের অভাব সহজে পূরণ হওয়ার নয়, তবে তাঁর বিলিয়ে যাওয়া আলোকবর্তিকা এবং পরামর্শ, উপদেশ ও দিকনির্দেশনা নিঃশব্দে সামনের দিনগুলোয় আমাদের ও শিক্ষার্থীদের পথ দেখাবে ।
নিজ গ্রামের বাড়িতে মসজিদের পাশে গোরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত প্রিয় মির কফিল স্যারের বিদেহ আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আল্লাহ তাঁকে বেহেশত নসিব করুন, আমিন।
পিইউও মো. আবু তালেব
প্লাটুন কমান্ডার (সেনা শাখা)
হাটহাজারী সরকারি কলেজ বিএনসিসি প্লাটুন
১১ বিএনসিসি ব্যাটালিয়ন, কর্ণফুলি রেজিমেন্ট, চট্টগ্রাম।