বঙ্গবাজারের আগুনে ঈদের স্বপ্ন ছাই

আজাদী ডেস্ক | বুধবার , ৫ এপ্রিল, ২০২৩ at ৪:৪৬ পূর্বাহ্ণ

ঈদের আগে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে গেছে দেশের অন্যতম বড় কাপড়ের মার্কেট ঢাকার বঙ্গবাজার। সাথে ঈদের স্বপ্নও পুড়ে ছাই হয়ে গেল। ক্ষতিগ্রস্ত এক ব্যবসায়ী আর্তনাদ করে বলছিলেন, ‘ভাই কিছুই নাই। ছাই আর ছাই। আমি শূন্য হয়ে গেছি, কেমন চলমু। আল্লাহ গো।’ আরেকজন কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘আমি নিজেও মরে গেছি।কোথাও যামু?’

ফায়ার সার্ভিসের গণমাধ্যম বিভাগের কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইসলাম দোলন জানান, সকাল ৬টা ১০ মিনিটে ওই মার্কেটে আগুন লাগার খবর পান তারা। ফায়ার সার্ভিসের ৪৮টি ইউনিটের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর দুটি দল প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টার চেষ্টায় বেলা ১২টা ৩৬ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে এরই মধ্যে বঙ্গবাজার মার্কেট, মহানগর মার্কেট, আদর্শ মার্কেট ও গুলিস্তান মার্কেট পুরোপুরি ভস্মীভূত হয়। ঈদকে কেন্দ্র করে দোকানে দোকানে মজুদও ছিল প্রচুর। বঙ্গবাজারের পাঁচটি মার্কেটের মধ্যে চারটি পুরোপুরি পুড়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় আশপাশের আরও কয়েকটি ভবন ও মার্কেট। এনেক্সকো টাওয়ারে আগুন জ্বলতে দেখা যায় আরও কয়েক ঘণ্টা। বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবেগাক্রান্ত হয়েছেন। আগুনের বিষয়ে ভবিষ্যতে সবাইকে সতর্ক থাকার অনুরোধ করেছেন বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। গতকাল একনেক বৈঠক পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী সকালের ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সহমর্মিতার কথা জানান। আগুন কী করে লাগল তা অনুসন্ধানে ৫ সদস্যের কমিটি করেছে ফায়ার সার্ভিস। এছাড়া আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা এবং ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে ৮ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। খবর বিডিনিউজের।

বঙ্গবাজারের পাশেই ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর বলে খবর পাওয়ার দুই মিনিটের মধ্যে সেখানে প্রথম ইউনিট পৌঁছায়। এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ইউনিটের সংখ্যা। কিন্তু বাতাসের মধ্যে ঘিঞ্জি ওই মার্কেটের আগুন ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ওই অবস্থায় ঢাকায় ফায়ার সার্ভিসের অধিকাংশ ইউনিটকে সেখানে ডাকা হয়। বহু দূর থেকেও বঙ্গবাজারের আকাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠতে দেখা যায়। প্রায় ২২ হাজার বর্গফুট এলাকার ওপর ঠাসাঠাসি দোকানের ভিড়ে আগুন নেভাতে পেরিয়ে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

এক পর্যায়ে পাশের পুলিশ সদর দপ্তরের সীমানায়ও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সাময়িক বন্ধ রাখা হয় জাতীয় জরুরি সেবার নম্বর ৯৯৯এর সেবা। ৯ ঘণ্টা পর তা আবার চালু হয়েছে।

আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলসংলগ্ন পুকুর থেকেও পানি নিতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিসকে। বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারকে দেখা গেছে হাতিরঝিল থেকে পানি নিয়ে বঙ্গবাজারে আগুনের ওপর ছিটাতে।

বড় এলাকায় টিন ও কাঠ দিয়ে নির্মিত শত শত দোকান নিয়ে এই বঙ্গবাজার। ঈদ সামনে রেখে সব দোকানেই প্রচুর নতুন পণ্য তোলা হয়েছিল। ভোরে অগ্নিকাণ্ড শুরুর পর তার বেশিরভাগই বের করার সুযোগ পাননি দোকানিরা।

ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, বঙ্গবাজার আদর্শ মার্কেট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে তা পুরো মার্কেটসহ বরিশাল প্লাজায়ও ছড়িয়ে পড়ে। তবে কীভাবে সেখানে আগুন লাগল তা এখনও স্পষ্ট নয়। ফায়ার সার্ভিসের মোট ৬৫০ জন কর্মকর্তাকর্মচারী আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন। তাদের মধ্যে ৮ জন আহত ও অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। কারো মৃত্যুর খবর আসেনি।

এ অগ্নিকাণ্ডের কারণে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার এবং আশপাশের এলাকার সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা হয় বেলা পৌনে ৩টা পর্যন্ত। বঙ্গবাজারগুলিস্তান, হানিফ ফ্লাইওভারের চাঁনখারপুল অভিমুখী লেন ও বঙ্গবাজার থেকে শিক্ষাভবন অভিমুখী সড়ক বন্ধ থাকায় আশপাশের অন্যান্য সড়কে যানজট ছড়িয়ে পড়ে। নিরাপত্তার কারণে বঙ্গবাজার ও আশপাশের এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহও বন্ধ রাখা হয়। ফলে সেখানে মোবাইল নেটওয়ার্কও বিঘ্নিত হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্র্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন ভোর থেকেই সেখানে অবস্থান করে বাহিনীর কর্মীদের কাজ তদারকি করছিলেন। আগুন কীভাবে লাগল জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়টি এখন বলা সম্ভব নয়।

সব পুড়ে ছাই : ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মালিকানাধীন বঙ্গবাজার চারটি ইউনিটে বিভক্ত। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, গুলিস্তান ইউনিট, মহানগর ইউনিট ও আদর্শ ইউনিট মিলিয়ে মোট দোকানের সংখ্যা ২ হাজার ৩৭০টি। আশপাশের বিপণিবিতান মিলিয়ে ৫ হাজারের মতো দোকান ভস্মীভূত হয়েছে বলে ধারণা দিয়েছেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন।

সকালে ব্যবসায়ী ও দোকানকর্মীদের কাউকে কাউকে মরিয়া হয়ে মালামাল সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে দেখা যায়। অনেকেই অসহায়ভাবে কাঁদছিলেন। একজন বলছিলেন কয়েক লাখ টাকার মাল তিনি দোকানে তুলেছিলেন ঈদ সামনে রেখে।

১৯৯৫ সালে একবার ভয়াবহ আগুনে পুড়ে রায় বঙ্গবাজার। পরে নতুন করে গড়ে তোলা হয় ওই মার্কেট। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই সেখানে আগুন লেগে মার্কেটের গুলিস্তান ইউনিটের কয়েকটি দোকান পুড়ে যায়। পাশের আনন্দবাজারে প্রায় ২৪ বছর ধরে ব্যবসা করা আলআমীন বলছেন, গতকাল আগুনের যে ভয়াবহতা দেখা গেছে বঙ্গবাজারে, তেমনটা তিনি আর কখনও দেখেননি।

তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের কমিটি : অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে পাঁচ সদস্যের কমিটি করেছে ফায়ার সার্ভিস। বাহিনীর পরিচালক (অপারেশন্স) লেফটেনেন্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে সভাপতি করে গঠিত এই কমিটিতে সদস্য সচিব করা হয়েছে ঢাকা জোন১ ঢাকার উপসহকারী পরিচালক মো. বজলুর রশিদকে। কমিটিকে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।

ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে ডিএসসিসির কমিটি : আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা এবং ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে আট সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। কমিটিকে আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। ডিএসসিসির সচিব আকরামুজ্জামানের স্বাক্ষরে এক দপ্তর আদেশে জানানো হয়, ডিএসসিসির অঞ্চল১ এর নির্বাহী কর্মকর্তাকে আহ্বায়ক করে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে।

৯ ঘণ্টা পর সেবায় ফিরল ৯৯৯ : অগ্নিকাণ্ডের কারণে সাময়িকভাবে বন্ধ জাতীয় জরুরি সেবার নম্বর ৯৯৯ প্রায় ৯ ঘণ্টা পর আবার চালু হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় পুলিশ সদর দপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

৯৯৯এর পুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার বলেন, সকালে বঙ্গবাজারে আগুন লাগার পর বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় জাতীয় জরুরি সেবা বন্ধ হয়ে যায়। আমরা বিশেষ ব্যবস্থায় সাড়ে ১০টায় পর্যন্ত চালু রেখেছিলাম। কিন্তু পুলিশ সদর দপ্তরের সঙ্গে আমাদের সার্ভারসহ বিশেষ কিছু সংযোগ বিদ্যুতের সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে সদর দপ্তরে বিদ্যুৎ না থাকায় জরুরি সেবা বন্ধ রাখতে হয়েছে।

আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর পুলিশ মহাপরিদর্শক আলমামুন সাংবাদিকদের জানান, পাঁচ তলা ওই ভবনে ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি ‘এক্সচেঞ্জ’ (নিয়ন্ত্রণ কক্ষ) রয়েছে, সেটা আগুনে বেশি ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া আরও অনেক ক্ষতি হয়েছে, সেগুলো নিরূপণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আগুন ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কায় আগে থেকেই পুলিশ সদর দপ্তরের ভেতর ফায়ার সার্ভিসের দুটি গাড়ি রাখা হয়েছিল। ফলে বিপদ বড় হতে পারেনি।

ঈদের স্বপ্ন ছাই : ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়েছিলেন ব্যবসায়ী মাসুদ আলী, সকাল ৬টার দিকে যখন বঙ্গবাজারে আগুন লাগার খবর পান, নাজিরা বাজারের বাসা থেকে দৌড়ে গিয়ে দেখেন গোটা মার্কেট জ্বলছে। শিশুদের কাপড়ের লট ছিল তার দোকানে। ঈদের আগ দিয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সর্বস্ব হারিয়ে তার আর্তনাদ যেন থামছে না। তিনি বলেন, আমার দোকানের কোনো কিছুই বাইর করতে পারিনি। আমি পথে বসে গেছি, আমার কিছুই নাই। দোকানের ক্যাশ ড্রয়ারে ৪০ হাজার টাকা রেখে আইছিলাম। ৪০ লাখ টাকার মালামাল ছিল, সব কিছু পুইড়া গেছে।

স্থানীয় লোকজন ও অন্যান্য ব্যবসায়ীরা সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন তাকে। কিন্তু কিছুতেই যেন নিজেকে বোঝাতে পারছিলেন তিনি। আক্ষেপ করে বলছিলেন, সেহেরি খেয়ে দোকানে আসলে হয়ত কিছু মালামাল বের করতে পারতাম।

বঙ্গবাজারে জিন্স প্যান্টের দুটি দোকান ছিল রফিকুল ইসলামের, ঈদ উপলক্ষে আগেই নতুন কাপড় তুলেছিলেন তিনি। কিন্তু গতকাল ভোরে লাগা আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে তার দোকানও। আর্তনাদ করে বলছিলেন, ভাই কিছুই নাই। ছাই আর ছাই। আমি শূন্য হয়ে গেছি, কেমন চলমু। আল্লাহ গো

বঙ্গবাজারের বেশিরভাগ ব্যবসায়ীরই আর্তনাদ এখন এমন। গতকাল আগুনে জীবিকার সহায়সম্বল হারিয়েছেন তারা।

পোড়া কাপড়ের স্তূপে যদি কিছু মেলে : বঙ্গবাজারের একটি কাপড়ের দোকানের কর্মচারী ১৬ বছরের জামাল। তার সমবয়সী সোহেল, কামাল, সিহাবসহ আরও কয়েকজন পোড়া কাপড়ের স্তূপ থেকে ভালো কাপড়টা বের করার চেষ্টা করছেন। বঙ্গবাজারের পশ্চিম দিকের রাস্তাটি পোড়া কাপড়ের স্তূপে পরিণত হয়েছে। আগুন নেভানোর ছিটানো পানিতে সেগুলো চুপসে ছিল। এর মধ্যে কয়েকজনকে এ পোড়া কাপড়ের মধ্যে ভালোটা বেছে নিতে দেখা যায়।

জামাল জানান, আগের রাত ১১টা পর্যন্ত কাজ করে বাসায় গেছেন। সকালে শুনেই যাত্রাবাড়ী থেকে ছুটে আসেন। ততক্ষণে পুড়ে গেছে সালাম নামে তার মালিকের দোকান। এখানে কিছু (পোড়া কাপড়ের স্তূপ) ভালো কাপড় পাওয়া যাচ্ছে। এগুলো সংগ্রহ করে পরে শুকিয়ে কী করা যায়, সেটা ভেবেই বাছাই করছি এগুলো।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানবতার কল্যাণে ঐশী বিধান কোরআন মজিদ
পরবর্তী নিবন্ধবায়েজিদে যুবকের আত্মহত্যা