বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদী নায়ক

মৌলভী সৈয়দ আহমদ

রোকন উদ্দীন আহমদ | শুক্রবার , ১১ আগস্ট, ২০২৩ at ৯:০৭ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি বিশ্ববিখ্যাত ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকা সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব একান্ত জরুরি। এই নতুন জাতির পুনর্বাসন ও অগ্রগতির জন্য তাঁর নেতৃত্বের বিকল্প নেই’।

১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডে সাত বছরের শিশু রাসেল খুনীদের কাছে আকুতি করেও প্রাণে বাঁচতে পারেনি। এই বিভৎস হত্যাকাণ্ডে বিশ্ব বিবেক স্তম্ভিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর দেশের পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তোলা হয়। এতে সেনাবাহিনীকেও ব্যবহার করা হয়। দেশব্যাপী বঙ্গবন্ধুর সহচর ও অনুসারীদের নির্যাতন করা হয়। নির্যাতন থেকে চট্টগ্রামের রাজনীতিকরাও রেহাই পাননি। চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের তৎকালীন কার্যনির্বাহী সদস্য বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য শফর আলীকে (বর্তমানে শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি) গ্রেফতার করে পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্পে সেনাবাহিনীর নির্যাতন সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁকে প্রায় একমাস আটক রেখে বর্বরোচিতভাবে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইনামুল হক দানুকে আটক করে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে প্রায় এক বছর জেলখানায় বন্দি রাখা হয়। এসময় তাঁকে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন করা হয়। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি সুলতানুল কবিরকে আটক করে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তাঁকে কিছুদিন জেলখানায় বন্দি রাখা হয়। এসময় তাঁকেও অমানুষিক শরীরিক নির্যাতন করা হয়। অবস্থার প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতারা মুখ খুলতে পারেননি। এই বিভিষিকাময় পরিস্থিতিতে জাতির পিতার রক্তঋণ শোধে দক্ষিণ চট্টগ্রাম যুবলীগ সভাপতি মৌলভী সৈয়দ আহমদ বীরের ভূমিকা পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করে জীবন দিয়েছেন। মৌলভী সৈয়দ আহমদ চৌধুরী বাঁশখালী থানার শেখেরখীলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা একরাম মিয়া ও মাতা ওমেদা খাতুন। তাঁকে প্রাণ দিতে হওয়ার কারণ হিসেবে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মোসলেম উদ্দিন আহমদের লেখা থেকে জানা যায়, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মৌলভী সৈয়দ আহমদ, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার ইব্রাহিম ও মোসলেম উদ্দিন আহমদ ঢাকায় ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে মৌলভী সৈয়দ ক্ষিপ্ত হন। হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। খুনিদের প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নেন’।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর মৌলভী সৈয়দ চট্টগ্রামে সহকর্মীদের নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু করেন। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। সংগ্রামে জড়িয়ে বিবাহের কথা চূড়ান্ত হলেও বিবাহ না করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ বীরোত্তমের নেতৃত্বে রক্তপাতহীন অভ্যূত্থানে মোশতাক সরকারের সেনাবাহিনী প্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দি করা হয়। এই অভ্যূত্থানের পক্ষে ঢাকায় মিছিলে নেতৃত্বদানকারীদের একজন ছিলেন মৌলভী সৈয়দ আহমদ। ৭ নভেম্বর পাল্টা অভ্যূত্থানে খালেদ মোশাররফ নিহত হলে মৌলভী সৈয়দ বেশ কয়েকজন সঙ্গী সহ ভারতে আশ্রয় নেন। ভারত থেকে আসাযাওয়া করে দেশের অভ্যন্তরে সহকর্মীদের নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন। এসময় তাঁরা হঠাৎ হঠাৎ কোনো কেনো জায়গায় আক্রমন করতেন। চট্টগ্রামের নিউ মার্কেট সংলগ্ন সড়কে, দামপাড়াস্থ পুলিশ লাইনসহ কয়েক স্থানে গ্রেনেড হামলায় তিনি নেতৃত্ব দেন। এসব সংগ্রামে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও পটিয়ার এস.এম ইউসুফ জড়িত ছিলেন। তৎকালীন সামরিক সরকারকে বাধাগ্রস্ত করতে তিনি এসব কর্মকাণ্ড চালাতেন। ১৯৭৩ সালের সংসদের এমপিদের নিয়ে তিনি প্রবাসী সরকার গঠনের চেষ্টা করেন। এতে ব্যর্থ হন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধ সংগ্রাম করার সময় মৌলভী সৈয়দ ডবলমুরিং থানার উত্তর আগ্রাবাদের সৈয়দ বাড়ির সৈয়দ আবু সিদ্দিকের ঘরে থাকতেন। সৈয়দ আবু সিদ্দিক তাঁকে প্রতিরোধ সংগ্রাম করতে আশ্রয় ও সহযোগিতা দিয়েছিলেন। আবু সিদ্দিকের ঘর মৌলভী সৈয়দের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধ সংগ্রামীদের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের এক পর্যায়ে ১৯৭৬ সালের ৭ নভেম্বর সামরিক সরকার মৌলভী সৈয়দ ও তার সহকর্মীদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা, মামলা, মামলা৩ নামে তিনটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় মৌলভী সৈয়দকে প্রধান আসামী ও এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে ২ নম্বর আসামী করা হয়। এসব মামলায় এডভোকেট শ্যামল প্রসাদ সেন, সৈয়দ আবু সিদ্দিক, আবু সিদ্দিকের দুই সন্তান সৈয়দ আবদুল গণি, সৈয়দ মাহমুদুল হক, মোহাম্মদ জাকারিয়া, ইঞ্জিনিয়ার দিপেশ চৌধুরী, এডভোকেট সালাউদ্দিন, মোহাম্মদ ইউনুছ, কেশব সেন, পিযুশ, নায়েক শফিসহ ১৫/১৬ জনকে আসামী করা হয়। এদের মধ্যে কেশব সেন ও এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ছাড়া অন্যরা গ্রেফতার হন।

উল্লেখ্য ১৯৭৭ সালে ভারতের নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার পরাজিত হলে মোরারজি দেশাইর দল ক্ষমতায় আসে। বাংলাদেশের জিয়ার সরকারের সাথে মোরারজি দেশাই সরকারের চুক্তিবলে ময়মনসিংহ বর্ডার দিয়ে ভারত থেকে মৌলভী সৈয়দ আহমদ ও তাঁর সহকর্মীদের বাংলাদেশে প্যুশব্যাক করা হয়। বর্ডার থেকে মৌলভী সৈয়দ ও বগুড়ার যুবলীগ নেতা খালেকুজ্জামান খসরু সহ অনেককেই গ্রেফতার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে যাওয়ার পর জি.জি.এফ.আই এর জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে নেওয়া হয়। সেনা গোয়েন্দা সংস্থা জি.জি.এফ.আই এর জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে অমানবিক নির্যাতন করে বিনা বিচারে ১৯৭৭ সালের ১১ আগস্ট বগুড়ার খসরু ও চট্টগ্রামের মৌলভী সৈয়দকে হত্যা করা হয়। মৌলভী সৈয়দকে হত্যার পর তাঁর পিতাকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে লাশ সনাক্ত করান। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার যোগে চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম থেকে লঞ্চ যোগে মৌলভী সৈয়দের লাশ বাঁশখালীতে নেয়। পুলিশ, বিডিআর ও আর্মির উপস্থিতিতেও বাঁশখালীতে মৌলভী সৈয়দের জানাযায় মানুষের বিশাল সমাবেশ হয়। দাফন করার পর প্রায় ১ মাস পুলিশ তাঁর কবর পাহাড়া দেয়। যাতে জনগণ বা অনুসারীরা হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ কিংবা জনমত সৃষ্টি করতে না পারে।

মৌলভী সৈয়দের রাজনৈতিক দর্শন ছিল ভিন্নমাত্রার। বঙ্গবন্ধু থেকেই এই দর্শন পেয়েছিলেন। ছিলেন বিরল রাজনৈতিক আদর্শ। প্রথম দিকে মাদ্‌্রাসায় শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরে কারাবন্দী অবস্থায় চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৮ সালে সরকারি সিটি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মৌলভী সৈয়দ চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি থাকাকালে চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি বাকশালের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। মৌলভী সৈয়দ উনসত্তরের গণআন্দোলনে চট্টগ্রামে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতাদের অগ্রভাগে ছিলেন। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে দীর্ঘদিন কারাভোগ করেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান বীরত্বপূর্ণ। ছাত্রযুবকদের সমন্বয়ে তিনি একটি গেরিলা বাহিনী গঠন করেন। তাঁর নেতৃত্বে গেরিলা বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতায় যুদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমানের তথ্যমতে ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম শহরে বিএলএফ ও এফএফভুক্ত বেশিরভাগ গ্রুপের অপারেশনের যাবতীয় দায়িত্ব মৌলভী সৈয়দ পালন করতেন।’ মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম শহরে কয়েকটি সফল অভিযান তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়।

মেধা, যোগ্যতা ও জাতির প্রতি দায়বোধ থেকে তিনি স্বাধীনতা পরবর্তী চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু মৌলভী সৈয়দকে বাঁশখালীতে মনোনয়ন দেন। কিন্তু জননেতা এম.. হান্নানের প্রভাবে তাঁর পরিবর্তে শাহ জাহান চৌধুরীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে তিনি দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম না করলে মৌলভী সৈয়দকে প্রাণ দিতে হত না। বরং খুনিদের কাছ থেকে সুবিধা নিতে পারতেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে জীবন উৎসর্গ করে তিনি দেশ প্রেমিক হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছেন। জীবন দিয়ে জাতির পিতার রক্তঋণ শোধ করেছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যার সরকারের আমলেও তাঁর অবদান এবং আত্মত্যাগের স্বীকৃতি মেলেনি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধক্ষুদিরাম বসু : স্বদেশের জন্য আত্মত্যাগী বিপ্লবী
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু : একুশ শতকের তারুণ্যের রোল মডেল