বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে একটি অভিন্ন শব্দসত্তা। সেই অভিন্ন সত্তাটুকু ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র চলছে। আজকের বাংলাদেশ টের না পেলেও অনুগামীরা টের পাচ্ছে নিরন্তর। তাঁরা নাড়ি কেটে যাওয়ার বেদনায় আত্মচিৎকার করছেন। বেদনাহত আত্মচিৎকারকারীদের অংশ হিসাবে ফিরে তাকাতে চাই বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির দিকে।
বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি পর্যালোচনা করলে নিশ্চয় নতুন করে জেগে উঠার প্রেরণা সঞ্চার হবে আজকের বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের মননে। আজকের বাংলাদেশকেই যাপিত কালের প্রতারক শূন্যতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল অতীত ঐতিহ্যের সঙ্গে ভবিষ্যতের সেতু বন্ধন করার দায়িত্ব নিতে হবে জনক কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে।
বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি পর্যালোচনা করতে আওয়ামী লীগের জন্মের সময়কালটা প্রথমেই বিবেচনায় নিতে হয়। এর আগের সময়কালটা ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির প্রস্তুতিপর্ব, যা পৃথক পর্যালোচনার দাবি রাখে। আওয়ামী লীগের জন্মের সময়কালটাতে বাংলার শিক্ষিত মুসলমানের মানসে চলছিল আত্মপরিচয়ের সংকট-বাঙালি না মুসলমান। অপরদিকে চলছিল বৃটিশের সাম্প্রদায়িক বিভেদ নীতি, মুসলমান সামন্ত ও অভিজাত শ্রেণির হিন্দুবিরোধী ব্যাপক অপপ্রচার। এমন একটি সংকটকালীন সময়ে পাকিস্তান জন্মের দুই বৎসর পর ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামের রাজনৈতিক দলটি ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে আত্মপ্রকাশ করে। সেদিন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশ ‘মুসলিম লীগ’ থেকে বেরিয়ে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই একাংশের নেতৃত্বে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, আবুল হাশেম, আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ। অচিরেই ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিকল্প হয়ে ওঠে। ‘মুসলিম লীগ’ এবং ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’-এর মধ্যে শ্রেণিগত চেতনার পাশাপাশি জাতীয়তাবাদী চেতনাগত মত পার্থক্য ছিল। বাংলার প্রভাবশালী সামন্ত ও অভিজাত শ্রেণির মুসলমান নেতৃবৃন্দ মূলত মুসলীম লীগের পক্ষে ছিল। অপরদিকে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’-এর পক্ষে ছিল মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি।
‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ খুব দ্রুত পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে সংগ্রামে পূর্ব পাকিস্তানে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষের সক্রিয় সংগঠন হিসাবে নেতৃত্বে চলে আসে। এর মূল কারণ ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’কে ভরসাস্থল হিসাবে বিবেচনায় নিয়ে এর পতাকা তলে সমবেত হয়। পরিণতিতে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ বিজয় লাভ করে।
অসংগতির ছাপ তারপরও মুছে যায়নি। নৃতাত্ত্বিক এবং জাতিগত যেদিক থেকে বিবেচনা করি না কেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার হাজার বছরের ইতিহাসে কোথাও সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই। বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা এক সঙ্গে কখনও হাত ধরাধরি করে চলেনি। এ ছিল পরস্পর বিপরীতমুখী। ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’কে সাম্প্রদায়িক আলখেল্লা গায়ে জড়িয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার আলোকে পথ চলতে তাই বার-বার হোঁচট খেতে হচ্ছিল। এই বেদনা সর্বাধিক উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। সেই হোঁচটের বেদনা উপশম করতে মূলত তাঁরই প্রচেষ্টায় দলীয় নেতৃত্ব ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবরের তৃতীয় কাউন্সিল সভায় ‘ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি’কে প্রাধান্য দিয়ে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়। তখন দলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘আওয়ামী লীগ’। ১৯৫৭ সালে পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে আওয়ামী লীগে ভাঙন দেখা দেয়। ওই বছরের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি কাগমারি সম্মেলনে দলে বিভক্তি স্পষ্ট হয়। অতপর আওয়ামী লীগ ‘বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগে’ রূপান্তরিত হয়।
বঙ্গবন্ধু শুরু থেকেই রাজনীতিকে একটি দর্শনের আলোকে পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু এই রাজনৈতিক দর্শন পেয়েছিলেন চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে। বাংলার হাজার বছরের এই ইতিহাসই শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু বানিয়েছে। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগকে একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক দর্শনেরভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সে দর্শন বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু একমাত্র মৌলিক বাঙালি রাজনৈতিক দার্শনিক, যাঁর দর্শনচিন্তা বাঙালির হাজার বছরের জীবন-জিজ্ঞাসা, নৈতিকতা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত সমন্বয়ের দিক নির্দেশনা রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর এই রাজনৈতিক দর্শনচিন্তায় দর্শনের জ্ঞানবিদ্যা, অধিবিদ্যা এবং মূল্যবিদ্যা রয়েছে। অপরাপর বাঙালি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কিংবা রাজনৈতিক দলসমূহ পাশ্চাত্য বস্তুবাদী দর্শন কিংবা ধর্মভিত্তিক দর্শন চর্চায় অনুপ্রাণিত হয়ে ভ্রান্তির চোরাবালিতে মুক্তির পথ খুঁজেছেন।
১৯৬৬ সালে পাঁচ ও ছয় ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছয় দফা পেশ করেন। ছয় দফা দাবির মূল উদ্দেশ্য ছিল–পাকিস্তান হবে একটি যৌথ রাষ্ট্র। ছয় দফার ভিত্তিতে এই যৌথ রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ রাজ্যকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। ছয় দফার সমর্থনে সর্ব প্রথম চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী লালদিঘির পাড়ে চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর তৎকালীন বৃহত্তর চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক চট্টল শার্দুল জননেতা এম এ আজিজের নেতৃত্বে প্রথম প্রকাশ্যে সভা করেন বঙ্গবন্ধু। যৌথ পরিবার, একত্রিত জীবনযাপন বাঙালি মধ্যবিত্তের চিরায়ত সংস্কৃতির অংশ। বঙ্গবন্ধু সেই চিরায়ত সংস্কৃতিকে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় যুক্ত করতে যৌথ রাষ্টের ধারণা উপস্থাপন করেছিলেন। এর মাধ্যমে জাতির জনকের শ্রেণি চেতনার একটি ইংগিতও পাওয়া যায়।
ছয় দফার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু রাজনীতিতে দর্শন চর্চার অবতারণা করেছিল। আওয়ামী লীগের মূলধারার চিন্তা-চেতনায়, অনুভূতিতে বঙ্গবন্ধুর দর্শনের প্রতিফলন লক্ষ্যণীয় ছিল বলেই ইতিহাসের প্রতিটি বাঁক পরিবর্তনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হতে পেরেছিল। যেকোনো কারণেই হোক বঙ্গবন্ধু তাঁর সমকালের অন্য সব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের চাইতে চিন্তা-চেতনায়, অনুভূতিতে অনেক বেশি আধুনিক এবং অগ্রসর ছিলেন। ফলে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ হতে পেরেছিল বাঙালির আশ্রয়স্থল। আজকের দিনে ভাবতেও অবাক লাগে কি গভীর সম্মোহনী শক্তি ছিল বঙ্গবন্ধুর! তাঁর নামের উপর ভিত্তি করে, তাঁর একটি মাত্র ডাকে সাড়া দিয়ে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি (কিছু বিপথগামী কুলাঙ্গার ব্যতিত) মরণ সাগর পেড়িয়ে স্বাধীনতা নামের স্বর্ণকমলকে করতলগত করেছিল। তৎকালীন সময়ে বিজ্ঞানের এমন অগ্রগতিও হয়নি, যে জনে জনে আজকের মতো সে আহবান পৌঁছে দিবে। কেউ নিজে শুনে, কেউ বা লোকমুখে শুনে সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বঙ্গবন্ধু পেরেছিলেন। কারণ তখন বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগে বঙ্গবন্ধুর জহুর-আজীজের মতো বন্ধু ছিলেন। তাজউদ্দিন-মনসুর আলী-সৈয়দ নজরুল ইসলাম-কামারুজ্জামানের মতো একনিষ্ট অনুগামী কর্মী ছিলেন। কিন্তু আজ?
স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু থেমে থাকেননি। তিনি ছিলেন আধুনিক এবং অগ্রগামী চিন্তা-চেতনার ধারক। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু সমাজ পরিবর্তনের সেই দর্শন দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখব, তিনি একজন সমাজ সংস্কারকও বটে। বঙ্গবন্ধু এ কারণে একটি সিভিল রিলিজিয়নেরও প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনের উদ্বোধনী ভাষণে বলেছিলেন, ‘রাজনীতিতে যারা সামপ্রদায়িকতা করে তারা হীন, নীচ, তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালোবাসে সে কখনো সামপ্রদায়িক হতে পারে না।…আওয়ামী লীগের কর্মীরা তোমাদের জীবন থাকতে যেন বাংলার মাটিতে আর কেউ সামপ্রদায়িকতার বীজ বপন করতে না পারে’। জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি নামের বঙ্গবন্ধুর সমাজ পরিবর্তনের সেই বৈপ্লবিক দর্শনচিন্তা ধর্মহীন বস্তুবাদী যেমন ছিল না, ঠিক তেমনি ধর্মভিত্তিক ভাববাদীও ছিল না। তিনি তাঁর দর্শন ভাবনায় বাংলার রেনেসাঁর প্রভাবকেও তুলে এনেছিলেন। কারণ তিনি একটি সিভিল রিলিজিয়ন সোসাইটি গঠন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেননি। এর আগেই প্রতিবিপ্লবী শক্তি তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাঙালি মধ্যবিত্তের নাড়ির যে টান, অনুভূতি, উত্তেজনা জড়িত ছিল কেমন জানি ৭৫ পরবর্তী আজকের বাংলাদেশে সে টান ক্রমেই আলগা হতে বসেছে। আজকের মেধা ও মননহীনতার নষ্ট সময়ে বঙ্গবন্ধুকে শুধু ছবিতে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হচ্ছে। তাঁর আদর্শ, চেতনার চর্চা হচ্ছে না। আজকাল বঙ্গবন্ধু শুধু আওয়ামী লীগের হয়ে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু শুধু আওয়ামী লীগের ছিলেন না। বাংলা-বাঙালির ইতিহাস, দর্শন আজকের বাংলাদেশ জানে না। কারণ আজকের বাংলাদেশে এসবের চর্চা নেই। পাঠচক্রই নেই। আজকের আওয়ামী লীগেও বঙ্গবন্ধুর দর্শন চর্চা আর তেমন হচ্ছে না। বঙ্গবন্ধুকে জানার, জানানোর মতো আওয়ামী লীগে তেমন আয়োজনও দেখি না। নতুন প্রজন্মকে এসব ইতিহাস, দর্শন জানাতে হবে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জানতে হলে জানতে হবে হাজার বছরের বাংলা-বাঙালির ইতিহাস।
আজকের ছাত্রলীগ একটা স্লোগান দেয়– ‘চলছে লড়াই চলবে, শেখ হাসিনা লড়বে’। কেন? শেখ হাসিনা একা কেন লড়বেন? বঙ্গবন্ধুর সময়ে কেউ বলেনি–‘চলছে লড়াই চলবে, শেখ মুজিব লড়বে’। তখন স্লোগান ছিল– ‘চলছে লড়াই চলবে, বীর বাঙালি লড়বে।’ ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’। আজকের বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর চেতনাবহনকারী আদর্শবান অনুসারীর বড়ই অভাব। এখন পোষাকী অনুসারীর জয় জয়কার।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও নাট্যজন।