বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধে একদিন ও স্বপ্নের পদ্মা সেতু প্রসঙ্গ

জসীম চৌধুরী সবুজ | শনিবার , ১৪ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৩৬ পূর্বাহ্ণ

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন সেনাবাহিনীর যেসব বেজন্মা কাপুরুষ, তারা তাঁর লাশটি নিয়েও ছিল শঙ্কিত। ঢাকায় সমাহিত করা হলে জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে কবরে শায়িত বঙ্গবন্ধু আরও শক্তিশালী, আরও স্পর্ধিত-শাণিত হয়ে উঠতে পারেন- এই শঙ্কা যেমন ছিল তেমনি পরবর্তীতে তাঁর সমাধিস্থল আপামর বাঙালির তীর্থস্থানে পরিণত হতে পারে -এই ভয়টা ঘাতকদের মনে কাজ করেছিল আরও বেশি। তাইতো তারা জাতির পিতার লাশটি দুর্গম এক জনপদের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় অত্যন্ত অনাদরে সমাহিত করেছিল। তারা ভেবেছিল রাজধানী ঢাকা থেকে অনেক দূরে অজপাড়াগাঁয়ে টুঙ্গিপাড়ায় সমাহিত করলে মানুষ একদিন ভুলে যাবে বঙ্গবন্ধুকে- জাতির জনককে। ইতিহাস থেকে বিস্মৃত হয়ে যাবেন তিনি। কুখ্যাত অপরাধী চোর-ডাকাত- খুনিরা এরকম অনেক হিসাব সরলিকরণ করলেও আখেরে সেই সরলাংক মিলে না। হিসাবের উল্টোটাই হয়। যেমনটি হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে। তাঁর নাম ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যাবে এই ধারনা করেছিল যেই ঘাতকচক্র তারাই আজ ইতিহাসের চরম নিন্দিত খলনায়ক। বঙ্গবন্ধু স্বমহিমায় উদ্ভাসিত এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে দেদীপ্যমান। তাঁর সমাধিস্থল এখন পরিণত হয়েছে আপামর মানুষের এক তীর্থকেন্দ্রে। গত ৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের নবনির্বাচিত ব্যবস্থাপনা কমিটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধে পুস্পিত শ্রদ্ধা জানিয়ে আসলাম। আমরা আগের রাতে তূর্ণা নিশিথা ট্রেনের স্লিপিং বাথে চেপে ভোরে ঢাকা পৌঁছাই।

সেখান থেকে একটি টিপটপ মিনিবাসে টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে মাত্র সোয়া তিন ঘণ্টায় আমরা পৌঁছে যাই গন্তব্যে। আসা যাওয়ার পথে স্বপ্নের পদ্মা সেতু এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মহাসড়ক দর্শন আমাদের দীর্ঘপথের ভ্রমণে বাড়তি পাওনা। বদলে যাওয়া বাংলাদেশের নবরূপ আমরা দেখলাম আগ্রহ ভরে।

ঢাকার যাত্রাবাড়ি অতিক্রম করার পর পদ্মাসেতু মুখী বঙ্গবন্ধু মহাসড়কে বুড়িগঙ্গা নদী এবং আড়িয়াল খাঁ নদ পেরিয়ে পদ্মার এপারে মাওয়া এবং ওপারে জাজিরা পয়েন্ট ছাড়িয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা ক্রসিং পর্যন্ত দীর্ঘপথে বেশক’টা ফ্লাইওভার- ওভারপাস- আন্ডারপাস (ভাঙ্গা ফরিদপুর জেলার একটি উপজেলার নাম)। ছয় লেনের প্রশস্ত সড়কে চলতে চলতে মনে হচ্ছিল যেন বিদেশের মাটিতে ভ্রমণ করছি। জাপানের কোবে থেকে ওসাকা, সেখান থেকে নাগোয়া, নাগোয়া থেকে টোকিও সড়কপথে দীর্ঘ যাত্রার ভ্রমণকালে এমন সড়ক-মহাসড়ক দেখে বা সৌদী আরব, আবুধাবি-দুবাই বা ওমান সফরেও বাহারি সড়ক- মহাসড়ক দেখে কত যে মন খারাপ করেছি আমার দেশ কত পিছিয়ে আছে তা ভেবে। ঢাকা থেকে ভাঙ্গা মোড় পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু মহাসড়কটি দেখে আমরা সবাই বেশ উৎফুল্ল।

বিদেশে বিভিন্ন মহাসড়কের চেয়ে অনেক সুন্দর ও নান্দনিক হয়েছে আমাদের এই মহাসড়ক। ভাঙ্গা থেকে টুঙ্গিপাড়া পর্যন্ত সড়কও যথেষ্ট ভাল। এ এলাকার সড়ক-মহাসড়ক সমূহে যানবাহনের তেমন চাপ নেই। নেই ভিড়-ভাট্টা, অসহনীয় যানজট। যা আমাদের ভ্রমণকে করে তোলে উপভোগ্য। ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক হচ্ছে দেশের সবচেয়ে ব্যস্ততম সড়ক। অথচ এর উন্নয়ন ও সমপ্রসারণ কাজটা যত দ্রুত করা উচিত ছিল সেটা সেভাবে এগুচ্ছে না বলেও আমাদের আলোচনায় উঠে আসে। আমরা আশায় আছি একদিন এই দুই মহাসড়কের দুর্দশাও ঘুচবে বলে।

গোপালগঞ্জ জেলা সদরে পৌঁছে আমরা কিছু সময় যাত্রা বিরতি নিই পুষ্পস্তবক সংগ্রহের জন্য। জেলা শহরটি এখনো আটপৌড়ে রয়ে গেছে। মার্কেট বা বহুতল ভবনের জৌলুস নেই। অনেক টিনশেড বাড়ি ও দোকানপাট দেখলাম। মধুমতি নদীর তীরে এই জেলা শহরটি আয়তনেও তেমন বড় নয়। তবে ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ।
মধুমতি নদীর তীরে শান্ত-সুনিবিড় এক ছায়ামাখা গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম গ্রহণ করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মধুমতির তীর ধরে জেলা সদর থেকে বিশ কিলোমিটার এগুলে টুঙ্গিপাড়া। ১৯৩৮ সালে বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জ সদরের মিশনারি স্কুলের ছাত্র ছিলেন। তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ আসেন। সেখানে এক বিরাট সভায় বক্তব্য রাখেন। ফিরে যাওয়ার সময় লঞ্চঘাটে আসার পথে শহীদ সাহেব ডেকে কথা বলেন মুজিবের সাথে। জানতে চান নাম-ঠিকানা ইত্যাদি টুকটাক। কিছুদিন পর মুজিব পেলেন কলকাতা থেকে প্রেরিত শহীদ সোহরাওয়ার্দীর চিঠি। আপ্লুত মুজিবও পাঠালেন উত্তর। সেই থেকে আজীবন মুজিবর ছিলেন সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী। (সূত্র : বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী)।

মধুমতি নদী একসময় ছিল টইটম্বুর। এখন সেখানে পানি নেই। মনেই হবে না এখানে একসময় লঞ্চ চলাচল করত। গোপালগঞ্জের সাংবাদিক বন্ধু এবং অন্যান্য লোকজন জানালেন এই স্থানটাতেই ছিল লঞ্চঘাট। নদীটি মরে গিয়েছিল সম্পূর্ণ। শুকিয়ে একটি জীর্ণ ছড়ায় পরিণত হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্যোগ নিয়ে নদীটি পুনখনন করেছেন, কিন্তু আগের সেই রূপ ফিরে পায়নি। ঐতিহাসিক এই মধুমতি নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে চেষ্টা করি। যেখানে সোহরাওয়ার্দীর আশীর্বাদের হাতের স্পর্শ পাওয়া মুজিবর কালের পরিক্রমায় হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি। টুঙ্গিপাড়ায় পৌঁছে আমরা প্রথমে যাই জেলা পরিষদের রেস্ট হাউস ‘বিজয়’ এ। সেখানে ফ্রেশ হয়ে যাই বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধে। ফাতেহা পাঠ ও শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে পরিকল্পিত কমপ্লেক্সের বিভিন্ন স্থান আমরা ঘুরে ঘুরে দেখি। সব জায়গায় বিভিন্ন স্থান থেকে আসা নারী-পুরুষের দেখা মিলল।

আমরা চট্টগ্রাম থেকে গেছি জেনে স্থানীয় অনেকেই স্মরণ করলেন এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরীকে। ১৫ আগস্ট জাতির পিতার শাহাদাত বার্ষিকীতে চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মহিউদ্দীন চৌধুরী বড় আকারের ‘চাঁটগাইয়া মেজবান’ এর আয়োজন করতেন। রেস্ট হাউসের কর্মচারীরা জানালেন, মহিউদ্দীন চৌধুরী টুঙ্গিপাড়ায় আসলে এই রেস্ট হাউসে উঠতেন। গোপালগঞ্জের সাংবাদিকরা জানালেন, মহিউদ্দীন চৌধুরী তাদের খোঁজ-খবর নিতেন। স্থানীয় লোকজনদের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। মহিউদ্দীন চৌধুরীর এলাকার লোক হিসেবে টুঙ্গিপাড়া-গোপালগঞ্জে আমরাও যথেষ্ট সমাদর-আন্তরিকতা পেলাম। স্মরণীয় হয়ে থাকবে বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধে কাটানো দিনটি। বিনম্র শ্রদ্ধা জাতির জনক।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধতুমি এলে
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে