বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনাকে মোটা দাগে চিহ্নিত করতে রবীন্দ্রনাথেই আশ্রয় নিতে হয়। ‘শিক্ষা সংস্কার’ প্রবন্ধে তিনি শিক্ষা–ব্যবস্থাকে স্পষ্ট দুই ভাগে ভাগ করে দিয়ে লেখেন, ‘নিজে চিন্তা করিবে, নিজে সন্ধান করিবে, নিজে কাজ করিবে এমনতরো মানুষ তৈরি করিবার প্রণালী এক, আর পরের হুকুম মানিয়া চলিবে, পরের মতের প্রতিবাদ করিবে না, ও পরের কাজের জোগানদার হইয়া থাকিবে মাত্র, এমন মানুষ তৈরির বিধান অন্যরূপ’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। আলোচনায় আমরা দেখতে পাবো বঙ্গবন্ধু বরাবরই প্রথম ব্যবস্থা বাস্তবায়নের পক্ষে সংগ্রাম করেছেন। কেননা বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলের ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতিগুলো পরের ব্যবস্থা বহাল রাখতে সদা তৎপর থেকেছে। তারই ধরাবাহিকতায় পাকিস্তানী শাসকদের প্রেতাত্মার মতো এদেশের সামরিক শাসকেরা এবং তাদের তৈরি করা রাজনৈতিক দলগুলো কৌশলে ক্ষমতা দখল করে ঐ প্রথাগত প্রতিবাদহীন শিক্ষিত বানানোয় ব্যস্ত থেকেছে। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেলে তরুণ সমাজ মুক্তবুদ্ধি–চর্চায় ও স্বাধীন–চিন্তায় অনুপ্রাণিত হতো; এতে এই প্রথাগত দাস উৎপাদনের বিধানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে উঠতে পারতো। তরুণরা অন্তত অনুধাবন করতে পারতো কোন বাস্তবতায় শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মূল্যায়ন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, আমলা নয়, মানুষ সৃষ্টি করুন’ (মুহম্মদ মনিরুল হক) আজও সেই বাস্তবতা থেকে মুক্তির সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা প্রেরণা শুধু নয় অবিকল্প অবলম্বন।
শিক্ষাজীবন: বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা তাঁর শিক্ষাজীবন এবং রাজনৈতিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাবনার বিষয় নয়। কিশোর বয়সেই তিনি শিক্ষকের সহায়তায় মুষ্টিভিক্ষার চাল সংগ্রহ করে গ্রামের অসহায় মানুষের শিক্ষার খরচ বহন করেছেন। শের–এ–বাংলার কাছে স্কুলের ছাত্রদের সমস্যা সাহসের সাথে তুলে ধরেছেন। সমকালে গুরুসদয় দত্ত ১৯৩২–এ ‘ব্রতচারী নৃত্যসংঘ’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৪১–এ ‘সর্বভারতীয় ব্রতচারী সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই (১৯৩৪) বঙ্গবন্ধু খেলাধুলা করতেন, গান গাইতেন এবং খুব ভালো ব্রতচারী করতে পারতেন (শেখ মুজিবুর রহমান)। তখন থেকেই তিনি শিক্ষার সাথে সংস্কৃতির অভিন্নতা অনুভব করতে অনুপ্রাণিত হন। ব্যক্তিগত জীবনেও বঙ্গবন্ধু শিক্ষকগণের প্রতি প্রচণ্ড শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন যে শিক্ষার্থীরা অটোপ্রমোশনের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের লাউঞ্জ ঘেরাও করে আটকে রেখেছে শুনে বঙ্গবন্ধু আমেরিকান কনসাল জেনারেলের সাথে সাক্ষাৎ স্থগিত করে গণভবন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটে যান; শিক্ষার্থীদের ভৎসনা করেন: মুক্তিযুদ্ধ কি এইজন্য করেছ? মুক্তিযুদ্ধের শেষার্ধে অনেকে ‘খাঁটি পাকিস্তানী সেজে’ কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থায়ী চাকরি জোগাড় করেন। কোমলহৃদয় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে এদের নিয়মিতকরণের নির্দেশ দেন (গোলাম কবির)। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হবার পরও তাঁর শিক্ষকদের সাথে সাক্ষাৎ হলে কদমবুসি করতেন তাঁদের সাথে সময় দিতেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর শিক্ষকের প্রতি এমন শ্রদ্ধাবোধ বঙ্গবন্ধু সারাজীবন লালন করেছেন।
গ্রন্থে শিক্ষাভাবনা: চীন সফরে গিয়ে (১৯৫২) বঙ্গবন্ধু লক্ষ করেছেন, চীনের নতুন সরকার কীভাবে তাদের শিক্ষাব্যবস্থা পাল্টে গণমুখী করেছে। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘সকল দিক খোঁজ নিয়া জানা গেল যে, মাত্র চার বৎসরে তারা শতকরা ৩০ জন লোককে লেখাপড়া শিখিয়ে ফেলেছে’ (শেখ মুজিবুর রহমান)। তিনি মুগ্ধ হয়ে দেখেছেন যে, নয়াচীনে শিশুরাই ‘প্রিভিলেইজ ক্লাস’ (স্বার্থ–সংশ্লিষ্ট শ্রেণি)। তাই বত্রিশ বছর বয়সী মুজিব ভবিষ্যৎবাণী করেছেন, ‘নতুন মানুষের একটা জাত গড়ে তুলেছে নয়াচীন। ১৫/২০ বৎসর পর এরা যখন লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়ে দেশের জন্য কাজ করবে তখন ভেবে দেখুন নয়াচীন কোথায় যেয়ে দাঁড়াবে?’ (শেখ মুজিবুর রহমান)।
বক্তৃতা–বিবৃতিতে শিক্ষাভাবনা: সম্প্রতি প্রকাশিত গোয়েন্দা–গোপন নথি থেকে জানা যায় যে, নরসিংদীতে ১লা জুন ১৯৪৮–এ এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত’। রেডিও–টিভিতে নির্বাচনী ভাষণ দিতে গিয়ে ২৮ শে অক্টোবর ১৯৭০–এ বঙ্গবন্ধু মানবসম্পদ সৃষ্টির ওপর গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষা সম্পর্কে নীতিনির্ধারণী বক্তব্য রাখেন: ‘সু–সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাখাতে পুঁজি বিনিয়োগের চাইতে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না। ১৯৪৭ সালের পর বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার পরিসংখ্যান একটা ভয়াবহ সত্য। ৫বছর বয়স্ক শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য একটা ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালু করতে হবে। মাধ্যমিক শিক্ষার দ্বার সব শ্রেণির জন্য খোলা রাখতে হবে। দ্রুত মেডিক্যাল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়সহ নয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দারিদ্র্য যাতে উচ্চশিক্ষার জন্য মেধাবী ছাত্রদের অভিশাপ হয়ে না দাঁড়ায় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।’
ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনে (১৯শে আগস্ট ১৯৭২) সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘শুধু বিএ, এমএ পাশ করে লাভ নেই। আমি চাই কৃষি কলেজ, কৃষি স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও স্কুল। যাতে সত্যিকার মানুষ পয়দা হয়। বুনিয়াদী শিক্ষা নিয়ে কাজ করে খেয়ে বাঁচতে পারবে। কেরানি পয়দা করেই একবার ইংরেজ শেষ করে গেছে দেশটা। তোমাদের মানুষ হতে হবে।’ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, বক্তব্য, বিবৃতি ও আলাপচারিতা বিশ্লেষণ করে বরেণ্য অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন তাঁর শিক্ষাভাবনার দুটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেন: ১. উপযোগী শিক্ষাকে তিনি বাঙালিত্বকে সমৃদ্ধ করা এবং তার যথাযথ বিকাশের সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করতেন। ২. সর্বজনীন শিক্ষাকে তিনি মানব–সম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে সবচেয়ে লাভজনক বিনিয়োগ মনে করতেন (আনোয়ার হোসেন)। ধাপে ধাপে তিনি বাঙালিকে বিদ্রোহী বীরের জাতিতে রূপান্তরিত করে স্বাধীনতা অর্জন করেন কিন্তু ঘাতকের বুলেট তাঁর মানব–মুক্তির সংগ্রামকে লক্ষ্যে পৌঁছার সময় দেয়নি।
শিক্ষাভাবনা বাস্তবায়নে গৃহীত পদক্ষেপ: উনিশশো বাহাত্তরের দশই জানুয়ারি দেশে ফিরে বারোই জানুয়ারি ক্ষমতাগ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারলেন বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হলে মানবসম্পদ উন্নয়ন অপরিহার্য, আর এর প্রধান অবলম্বন শিক্ষা। তাইতো দেশের প্রথম বাজেটে তিনি প্রতিরক্ষা খাতের চেয়ে শিক্ষা খাতে বেশি বরাদ্দ প্রদান করেন। শিক্ষার নীতিমালা করতে হলে আগে চাই রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ও নীতিমালা; তাই অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি সংবিধান প্রণয়নে মনোনিবেশ করেন এবং বাহাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর থেকে সংসদের মাধ্যমে সংবিধান কার্যকর করেন। সে সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগ: ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’র সতেরো অনুচ্ছেদে ‘অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা’ শিরোনামে একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং নিরক্ষরতা দূরীকরণে রাষ্ট্রের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার করা হয়। আর একারণেই রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূন্য হলেও শিক্ষাকমিশনের রিপোর্টের অপেক্ষা না করে তিনি সকল প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ (১৯৭৩) করলেন এবং শিক্ষকদের বেতন–ভাতা সব জেলা–বোর্ডের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ওপর ন্যস্ত করলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে এমন বৈপ্লবিক পদক্ষেপ ইতিহাসে বিরল (গোলাম কবির)। বঙ্গবন্ধু জানতেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনো ধরনের একাডেমিক স্বাধীনতা ছিল না। তথাকথিত পাকিস্তান ও ইসলামের তাহজিব–তমদ্দুনের বিরুদ্ধে যায় তেমন কিছু আলোচনা করাও শিক্ষকদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল; যেমন, মার্কসবাদ বাা ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্ব আলোচনা করাকে এককথায় চরম অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো (আবদুল মান্নান)। তাইতো তাঁর নির্দেশনায়, ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স ঘোষণা করা হয়, স্বায়ত্তশাসনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিন্তার স্বাধীনতা ও মুক্তবুদ্ধিচর্চার পরিবেশ সৃষ্টি করা। তবে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনার পুরোটাই প্রতিফলিত হয়েছে ‘খুদা শিক্ষা–কমিশনে’।
বঙ্গবন্ধু সবসময় চেয়েছেন শিক্ষা বিষয়টি শিক্ষকের হাতে থাকুক। তাঁর প্রথম সরকারের শিক্ষামন্ত্রী একজন শিক্ষক, অধ্যাপক ইউসুফ আলী। পর্যায়ক্রমে শিক্ষাসচিব ছিলেন ড. এ আর মল্লিক, ড. আবদুল্লাহ আল–মুতী শরফুদ্দীন, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী–সবাই শিক্ষক। সেই ধারাবাহিকতার সমাপ্তি অনেক আগে হয়েছে (আবদুল মান্নান)। ফ্রান্সিস বেকনের আপ্তবাক্য, ‘শিক্ষাই শক্তি’। বাংলা প্রবাদ: শিক্ষাই আলো, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। সে–মেরুদণ্ড সোজা করে বাঙালি জাতিকে দাঁড়করানো বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনার লক্ষ্য। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনাকে তাই দেখতে হবে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের পটভূমি ও বাংলাদেশের মানুষের উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে (আবদুল খালেক)। দেশপ্রেমে বলিয়ান গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতিবান উদার শিক্ষিত মানুষ তিনি চেয়েছিলেন। আশার কথা তাঁর সুযোগ্য সন্তানের হাত ধরে ‘খুদা–শিক্ষাকমিশন’ রিপোর্টের আলোকে প্রণীত ‘শিক্ষানীতি ২০১০’ বাস্তবায়িত হচ্ছে ভূরাজনৈতিক নানান প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে। ভরসা রাখি, মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে একমুখী প্রাথমিক শিক্ষা প্রচলের সংগ্রাম কিংবা ‘আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ এখনও ম্রিয়মান হয়ে যায়নি।
লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলেজ শিক্ষক।