বর্ষপঞ্জির একটি মাস যে একটি জাতির ললাটে গভীরতম শোকের ক্ষতচিন্থ এঁকে দিতে পারে তা বিশ্বের কোনো দেশ এবং জাতির ইতিহাসে বিরল। ইংরেজি বর্ষপঞ্জির অতি সাধারণ একটি মাস আগস্ট। যে নৃশংসতা, বর্বরতা আর পৈশাবিকতার অপর নাম হয়ে যাবে তা ৭৫ সালের আগে কেউ কি ভেবেছে কখনও? বাংলাদেশ আর আগস্টকে শোকের বন্ধন ছিড়ে কোনো দিন ভিন্ন বা আলাদা করা যাবে না, সম্ভবও নয়। বাঙালির জীবনে আগস্ট তাই দুর্বিষহ শোকের মাস। শোকের দাবানলে পুড়ে শক্তি অর্জনের মাস।
প্রতিবছর অপরিসীম বেদনা আর শোকাশ্রু নিয়ে আগস্ট মাস আসে স্বাধীন বাংলায়। পৃথিবীর একমাত্র ভাষা ও জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্রষ্টা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শিশুপুত্র রাসেল সহ পবিবারের সকলকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের কালো রাত্রিতে।
বঙ্গবন্ধু মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত মহানায়ক। ১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকলেও তাঁর নামেই বাংলাদেশ যুদ্ধ করেছে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। ১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারি যুদ্ধপীড়িত স্বাধীন দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে অন্যতম হলো একটি পরিপূর্ণ সংবিধান প্রণয়ন। সংবিধানে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি নির্ধারিত হলো ‘গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র’।
১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। ইসলামের অবমাননা আমি চাই না। এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সবাই সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে’।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন এক অগ্নিশিখার নাম, যেটি দেশপ্রেমের চিরন্তন আলোয় প্রজ্বলিত। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সততা, মেধা, মমত্ববোধ ও অসামান্য নেতৃত্বের কারণে তিনি জাতি সত্তার প্রতীক হয়ে আছেন। মৃত্যুকে পরোয়া না করে তিনি গোটা বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করেছিলেন স্বাধীনতার মন্ত্রে। বাঙালির আর্থসামাজিক মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রথম ও প্রধান মানবিক দর্শন ছিলো ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। তিনি ছিলেন আজন্ম অসাম্প্রদায়িক। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে কিশোর বয়সের কথা লিখতে গিয়ে বলেছেন, ‘তিনি লিখেছেন, আমার কাছে তখন হিন্দু-মুসলমান বলে কোনো জিনিস ছিল না। হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল’।
বঙ্গবন্ধু সব সময় কামনা করতেন একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তিনি মনে প্রাণে চাইতেন এমন একটি দেশ- যে দেশে থাকবে না ধর্মের ভিত্তিতে বিভেদ-বিভাজন, সব নাগরিকই নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে স্বাধীনভাবে। ছয় দফা দাবি পেশ করার পরে তাঁর ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘ছয় দফা মুসলিম-হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধদের নিয়ে গঠিত বাঙালি জাতির স্বকীয় মহিমার আত্মপ্রকাশ আর নির্ভরশীলতা অর্জনের চাবিকাঠি’। তিনি ধারণ করেছিলেন এমন এক সত্তা, যেটি ছিলো ধর্ম-বর্ণের উর্ধ্বে মানব জীবনের বেঁচে থাকার অমোঘ প্রত্যয়।
বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশ সরকার একটি পোস্টার প্রকাশ করে। সেটি ছিল ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান, বাংলার মুসলমান-আমরা সবাই বাঙালি’।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, ‘ব্যক্তিগত জীবনে নিষ্ঠাবান মুসলিম এবং সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ দর্শন ছিল বাংলার মানুষের সংস্কৃতির সঙ্গে সমাঞ্জস্যপূর্ণ।
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর জাতীয় সংসেদ বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দেন তাতেও ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার বাণী। তিনি বলেছিলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করব না।
মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নাই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারও বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের কেউ বাধাদান করতে পারবে না। খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেঈমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, ধর্মের নামে খুন, ধর্মের নামে ব্যভিচার-এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করছি’।
বঙ্গবন্ধু প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা ও হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) চিরন্তন মানবিকতার সাম্য, উহার নৈতিক, শান্তির আদর্শকে নিজের জীবনের সাথে উতপ্রোতভাবে জড়িয়ে নিয়েছিলেন বলেই তিনি বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংযুক্ত করেছেন। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা সামাজিক সংঘর্ষ এড়াবার উপায়ও বটে। শিক্ষা, জ্ঞান ও তথ্যের বহুল প্রসার এবং শিক্ষার মাধ্যমে অলসও নিরপেক্ষ মুক্ত মননের চর্চাকে সামগ্রিকবাবে মানসিক অভ্যাসে রূপান্তরকরণ, রাষ্ট্রনীতি ও সমাজনীতিতে এই নিরপেক্ষতার বাস্তবায়ন এর বহুল উচ্চারিত কর্তব্য ও সমাধান সামগ্রিকভাবে সংস্কৃতির রূপান্তরের মধ্যে এই প্রবণতা পূর্ণতা পাবে। মানুষের যে আত্মপরিচয় এক সময় গোষ্ঠী বা ধর্মকে আশ্রয় করে বিকশিত হয়েছিল তার ক্ষুদ্র বেড়া ভেঙে সংস্কৃতির বৃহত্তর আঙ্গিনায় তার নতুন পরিচয় লাভ হবে। বাংলাদেশ এই প্রবণতাকেই সত্যতর ও ভবিষ্যমূখী বলে জোর দিয়েছে।
ধর্মের উদ্ভবের মতই ধর্মনিরপেক্ষতা ও সামাজিক চাহিদা থেকেই উদ্ভুত হয়েছে। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের কল্পনাবিলাস থেকে নয়। এটা একটা আন্তর্জাতিক সামাজিক সত্য। এর ভবিষ্যৎ আন্তর্জাতিক প্রবণতার সঙ্গে গ্রথিত। সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে ধর্মীয় প্রশ্নের নিষ্পত্তি অতীতেও হয়নি, ভবিষ্যতে ও হবে না। ধর্মের নামে অন্ধবিশ্বাস বা সমপ্রদায়গত সংস্কারকে উস্কে দিয়েও সমস্যার সমাধান হবে না। সব ধর্ম বিশ্বাসের উপর শেষ পর্যন্ত নির্ভর করে…..। আমরা সমাজকে বদলাতে চাই। সমাজ আজ যেখানে আছে সেখানে ফেলে রাখতে চাই না। ভীরুতা দিয়ে পরিবর্তন সাধন করা যায় না। ধর্ম নিরপেক্ষতার জন্যও সাহসের প্রয়োজন (অধ্যাপক আলী আনোয়ার সম্পাদিত, ধর্ম নিরপেক্ষতা, বাংলা একাডেমি-১৯৭৩)।
শেখ মুজিবের চিন্তা এবং বিচার-বিশ্লেষণ যে সব দিক থেকে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন, তার অন্যতম হলো ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। অমর্ত্য সেন বলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবক্তা হিসেবে শেখ মুজিব ছিলেন অগ্রগণ্য। তাঁর দৃষ্টান্ত থেকে এই বিষয়ে সব দেশেরই শেখার আছে। বর্তমান ভারতের পক্ষে তো বটেই, বঙ্গবন্ধুর ধারণা ও চিন্তা উপমহাদেশের সব দেশের পক্ষেই শিক্ষণীয়…..। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা পরিষ্কার: ধর্মনিরপেক্ষতার এমন কোনও অর্থ কখনওই তাঁর চিন্তায় স্থান পায়নি, যা মানুষের ধর্মাচারণের সক্ষমতাকে অস্বীকার করবে। যাঁদের ধর্মবিশ্বাস গভীর তাঁদের কাছে এই সক্ষমতা যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না’।
সোনার বাংলায় আজকে যারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার চেষ্টা করেন, জঙ্গীবাদকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিচ্ছেন তাদের দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘বাংলাদেশে বিভিন্ন সমপ্রদায়ের লোকের বসবাস। ধর্ম আলাদা হলেও আমাদের সবার আজ একটাই পরিচয় আমরা বাঙালি। এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ বা সংখ্যালঘিষ্ঠ বলে কোনো শ্রেণি বৈষম্য বিচার্য হতে পারে না। আমাদের ধর্ম বা বর্ণ আলাদা হতে পারে…… কিন্তু বাঙালি হিসেবে এ স্বাধীন বাংলার সকল নাগরিকের বড় পরিচয়। যার যা ধর্ম তিনি তা স্বাধীনভাবে পালন করুন……. কিন্তু একের সাথে অপরের যেন বিরোধ না ঘটে’। আজ আমরা বলতে চাই পরস্পর এ ভ্রাতৃত্ব ভাবের মাধ্যমেই বাঙালি হিসেবে আমাদের পরিচয়। সেই পরিচয়ের মাধ্যমেই আমরা সঠিক পথের ঠিকানা লাভ করতে পারি এবং উদার পরমতসহিষ্ণু একটি সমাজ গড়ে উঠবে। যে সমাজ ব্যবস্থার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারাজীবন কাজ করেছেন।
কোনো ধর্মীয় ভেদাভেদ নয়। ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্যই হচ্ছে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে বিকাশিত হয়েছিল বলেই তিনি বাংলার মানুষের নয়নের মণি।
তিনি আপোস করেননি বলেই বাংলাদেশে মৌলবাদের ও সামপ্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করেছেন শেষ পর্যন্ত নিজের রক্ত দিয়ে তিনি প্রমাণ করে গেছেন বঙ্গবন্ধু একজন খাঁটি ধার্মিক ও বাঙালি।
সমাজ, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি, ইতিহাস, গণতন্ত্র, মানুষের অধিকার প্রভৃতি বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছিল স্বতন্ত্র ও প্রজ্ঞাময় নিজস্ব ভাবনা। যা প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন সময়ে তাঁর বক্তব্যে। তিনি ছিলেন দেশের ও দুনিয়ার মেহনতি মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ, সে দায় থেকে তিনি নিজের ন্যায্য অধিকার আমাদের পক্ষে জনসাধারণকে সচেতন করে গেছেন। লড়াই করতে শিখিয়েছেন, তিনি স্বপ্ন দেখেছেন, স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য মানুষের অন্তরে তিনি তাঁর ‘সোনার বাংলার’ স্বপ্ন প্রণীত করেছেন, যা শুধুমাত্র একজন রাষ্ট্রনায়ক ও পরিপক্ষ নেতার পক্ষেই সম্ভব। পুঁজিবাদ. সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, পুরুষতন্ত্র সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবস্থান, রাজনৈতিক সমঝোতা ও সহনশীলতা, আত্মসমালোচনা, দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধাচারণ, নারীর প্রতি আস্থা ও সম্মান, সকল ধর্মের সকল শ্রেণি-পেশায় মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রয়েছে। তাঁর প্রতিটি বক্তব্যে ও আলোচনায়। তিনি বাঙালি জাতির মুক্তির কাণ্ডারি, আজীবন আপসহীন এবং লড়াই সংগ্রামে ক্লান্তিহীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক ভাষণ, বক্তব্য ও বিবৃতি আমাদের জাতীয় জীবনের অমূল্য সম্পদ ও অন্তহীন প্রেরণার উৎস। আগামী প্রজন্ম ও শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দেশনামূলক পাথেয়। বঙ্গবন্ধুর জীবনী, কথামালা ও বক্তব্য এবং ভাষণ আমাদের জাতীয় সম্পদ এবং ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কেবল বাঙালির জন্যই নয়, পৃথিবীর নানা দেশে মুক্তি সংগ্রামে অনিঃশেষে প্রেরণা, যাতে রয়েছে প্রত্যক মানুষের জন্য সময়োপযোগী দিক নির্দেশনা।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সম্পাদক, শিল্পশৈলী