চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) শিক্ষার্থী শোয়াইব। গতবছর বইমেলা থেকে কিনেছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যয়ের উপন্যাস ‘দূরবীন’। পড়া শেষ হওয়ায় উপন্যাসটির বিনিময়ে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে তিনি সংগ্রহ করেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’। তাকে এ বই বিনিময়ের সুযোগ করে দিয়েছে স্টোরি টেলিং প্লাটফর্ম ‘ফেইল্ড ক্যামেরা স্টোরিজ’ আয়োজিত ষষ্ঠ বই বিনিময় উৎসব। গতকাল নগরের জামালখান মোড়ে সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় এ উৎসব। যেখানে একজন পাঠক তার পঠিত বইটি রেখে অন্য বই বিনিময় করে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পান। তাই জুলাইয়ের রঙ্গে সাজানো এবারের উৎসবে বিনিময় হয়েছে ২৩ হাজার ২০০ বই। সকাল ১০ টায় এ বই বিনিময় উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। উদ্বোধক ছিলেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ পরিচালক শাব্বির ইকবাল। নজরুল ইন্সটিটিউটের পরিচালক ও প্রখ্যাত লেখক লতিফুল ইসলাম শিবলী বই বিনিময় উৎসবের নজরুল কর্ণার উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বই বিনিময় উৎসবের সমন্বয়ক সাইদ খান সাগর।
একুশে পদক প্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব এম এ মালেক বলেন, সত্যজিৎ রায় তার ‘হীরক রাজার দেশে’–এ খুব সুন্দর কথা বলেছেন; ‘জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই’। এটা রূপক। কারণ জানার যখন শেষ নেই তাই আমাদের জানতে হবে। একজন মানুষের পক্ষে তার সামান্য জীবনে সবকিছু জানা সম্ভব নয়। যতটুকু সম্ভব ততটুকু জানা প্রয়োজন। আর মানুষের জানার পরিধি বাড়িয়ে দেয় বই।
এম এ মালেক বলেন, বই পড়তে হবে। বই না পড়লে জ্ঞানের বিকাশ ঘটবে না। বই জানার এবং জ্ঞানের শক্তি অনেক বেশি বাড়িয়ে দেয়। আমরা যত বেশ বই পড়ব তত বেশি জ্ঞানী হব এবং আমাদের জানার পরিধি তত বাড়বে। পৃথিবীকে জানার জন্য এবং সমসাময়িক বিষয়কে জানার জন্য বই পড়তে হবে। আমরা যদি সমসাময়িক বিষয়কে উপলব্ধি করতে না পারি তাহলে আমাদের অগ্রযাত্রা থেমে যাবে।
তিনি বলেন, সবার পক্ষে সব বই কিনে পড়া সম্ভব নয়। তাই বই বিনিময় খুবই ভালো উদ্যোগ। বইয়ের আদান–প্রদান সহজলভ্য করে তুলতে তিনি বইয়ের আর্কাইভ গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়ে বলেন, বছরে একবার বা দুইবার শুধু উৎসব থেকে বই বিনিময়ের সুযোগের চেয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে আর্কাইভ গড়ে তোলা যেতে পারে। কারণ কয়েকদিনের মধ্যে একটি বই পড়া শেষে পাঠককে সেটি বিনিময় করতে উৎসবের জন্য আর অপেক্ষা করতে হবে না। আর্কাইভ থেকে সহজেই বই সংগ্রহ করে নিতে পারবেন। এর জন্য অ্যাপস্ও প্রস্তুত করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে কার কাছে কোন বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে সেটিও অন্যজন জেনে নিতে পারবেন। এতে করে বইয়ের আদান–প্রদান বাড়বে। এক পাঠকের সাথে অন্য পাঠকের যোগাযোগও স্থাপন হবে।
আজাদী সম্পাদক বই বিনিময় উৎসবের প্রশংসা করে এই ধরনের আয়োজন আরো বেশি বেশি হওয়া জরুরি বলে মন্তব্য করেন।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, বিদ্যার বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ বই বিনিময় উৎসব। বিনাপয়সায় এ রকম বই পড়তে পারার সুযোগ আমরা পাইনি। তাই বলা যায় বই বিনিময় উৎসব একটি মহতি উদ্যোগ। এই উদ্যোগ আমাদের জাতীয় মানস গঠনে ভূমিকা রাখছে। এই উদ্যোগ অব্যাহত রাখা জরুরি। তিনি বলেন, এই উদ্যোগের একটা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রয়োজন। তরুণরা দেখিয়ে দিয়েছে। এবার রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে এটি নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া, পড়ালেখার বাঁধ ভেঙে দেয়া, বাণিজ্যিকীকরণের বাঁধ ভেঙে দেয়া।
শাব্বির ইকবাল বলেন, ষষ্ঠ বারের মত বিনিময় উৎসব ‘ফেইল্ড ক্যামেরা স্টোরিজ’ এ শক্তিমত্তাই প্রকাশ করে। এটা যে জনসম্পৃক্ত হয়েছে, মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে তার প্রমাণ। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা এটা গ্রহণ করায় এ উৎসব এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে। শীতের সকালে যেখানে মানুষ কম্বল থেকে বেরুতে চায় না সেখানে আজকের উৎসবে বিপুল লোকের সমাগম প্রমাণ করছে এই উৎসব আরো বেশি সমাদৃত হচ্ছে।
ফেইল্ড ক্যামেরা স্টোরিজ পরিচালক সাইদ খান সাগর বলেন, আমরা আজ থেকে চার বছর আগে পাঠক তৈরির মহান উদ্দেশ্যে যে বই বিনিময় উৎসব শুরু করেছিলাম সেটা আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক জীবনে বৈচিত্র্য ঘটিয়েছে। বইমেলার মতো বই বিনিময় উৎসবের জন্যও পাঠক এখন অপেক্ষা করে থাকেন। বিশেষ করে যারা বই কিনতে চান কিন্তু পারেন না অর্থাভাবে তাদের জন্য বই বিনিময় উৎসব বই পড়া অব্যাহত রাখতে সাহায্য করছে। বই বিনিময় উৎসব এই প্রজন্মের প্রতীক। আর এই প্রজন্মের গর্বের নাম জুলাই অভ্যুত্থান। তাই আমরা এবার ৬ষ্ঠ বই বিনিময় উৎসবকে জুলাইয়ের রঙ্গে সাজিয়েছি। জুলাইয়ের স্বাধিকারবোধ যেন সর্বদা জাগ্রত থাকে।
আয়োজকরা জানান, ২০২১ থেকে নিয়মিত বিরতিতে আয়োজন করে আসা বই বিনিময় উৎসবের এবারের আয়োজনটি উৎসর্গ করা হয় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের উদ্দেশ্যে। সেই সাথে স্মরণ করা হয় ফিলিস্তিনকেও। উৎসবস্থল তথা জামালখানের ফুটপাতকে সাজানো হয় জুলাই অভ্যুত্থানের নানা চিত্রে। সেসব চিত্রে ফিরে ফিরে আসে দ্রোহ–বেদনা–ক্ষোভের সেই দিনগুলো।
উৎসবের দুটো রেজিস্ট্রেশন বুথ এর নাম ছিল শহীদ ওয়াসিম আকরাম রেজিস্ট্রেশন বুথ ও শহীদ ফয়সাল আহমেদ শান্ত রেজিস্ট্রেশন বুথ। ফ্রেম ব্যানার, গ্রাফিতিতে আয়োজকরা ফুটিয়ে তোলেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে। সেসব দেখেও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন হাবীবুর রহমান নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র। তিনি বলেন, বই বিনিময় উৎসব তাদেরকে সেই রক্তাক্ত দিনগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
বই সংগ্রহের ১১টি স্টলও ছিল জুলাই–এর শহীদদের নামে। যেমন হুমায়ুন আহমেদের বইয়ের ক্যাটাগরি স্টলের নামও রাখা হয়েছে শহীদ আহসান হাবীব স্টল, কবিতার ক্যাটাগরির স্টলের নাম রাখা হয়েছে শহীদ ইউসুফের নামে। এছাড়া অন্যান্য শহীদদের নামে করা স্টলগুলোর ক্যাটাগরি ছিল; যেখানে প্রবন্ধ ও অন্যান্য, হুমায়ুন আহমেদ, কথাসাহিত্য, কবিতা, রাজনীতি, ইতিহাস, বিজ্ঞান, ক্যারিয়ার, শিশুসাহিত্য ও ম্যাগাজিন, একাডেমিক বই স্থান পায়। আয়োজকরা জানান, সব মিলিয়ে অন্তত ৫৫০০ বই ছিল নানা স্টলে।
আয়োজকদের একজন রিনভী বলেন, বই বিনিময় উৎসব পাঠকদের বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করে রাখার অন্যতম উপায়। তাই এই উৎসবের আবেদন কমছে না। বই বিনিময় করতে আসেন অসংখ্য তরুণ। তাদের ভেতর একাডেমিক, কথাসাহিত্য এবং হুমায়ুন আহমেদের বই–ই অধিক বিনিময় হয়েছে। শিশুসাহিত্যে ছিলো উপচে পড়া ভিড়।