ফেয়ারওয়েল ব্রুনো, ফেয়ারওয়েল এনজো

শৈবাল চৌধূরী | সোমবার , ১৬ জুন, ২০২৫ at ৮:৪৬ পূর্বাহ্ণ

চলচ্চিত্রের (১৮৯৫২০২৫) ১৩০ বছরের ইতিহাসে এমন কিছু অবিস্মরণীয় চরিত্রের আবির্ভাব ঘটেছে, যাদের স্মৃতি, যাদের প্রসঙ্গআমাদের প্রাত্যাহিক জীবনে নানা অনুষঙ্গে আলোচিত হয়। বিশেষ করে শিল্প সাংস্কৃতির জগতে। এদের বেশিরভাগই শিশুশিল্পী। এদের অনেকে জীবনে মাত্র একটি চরিত্রে একবারই অভিনয় করে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। পথের পাঁচালীর অপু দুর্গার চরিত্রে সুবীর মুখোপাধ্যায় ও উমা দাশগুপ্ত (সেন), দি কিডএ চার্লির শিশু সহযোগীর চরিত্রে জ্যাকি কুগান, ফোর হানড্রেড ব্লোজের আঁতোয়ান চরিত্রে জঁপিয়েবে লিয়ো, পোস্টমাস্টার ছবির রতন চরিত্রে চন্দনা বন্দ্যোপাধ্যায়, পিকু ছবির পিকু চরিত্রে অর্জুন গুহঠাকুরতা, বাড়ি থেকে পালিয়ে ছবির কাঞ্চন চরিত্রে পরম ভট্টারক লাহিড়ী, বাইসাইকেল থিভ্‌্‌স ছবির ব্রুনো চরিত্রে এনজো স্তেয়োলা এবং বাংলাদেশে মেঘের অনেক রং ছবির আদনান চরিত্রে আদনান ও এমিলের গোয়েন্দা বাহিনীর এমিল চরিত্রে শিশু অভিনয়শিল্পী পার্থ শহিদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

বিশ্বচলচ্চিত্রে এরকম উদাহরণ নিশ্চয়ই আরো অনেক রয়েছে। আমরা তার মধ্য দিকে এমন কয়েকটি শিশুচরিত্রের অভিনেতাদের নামোল্লেখ করলাম, যাদের অভিনীত চরিত্রগুলি আমরা সচরাচর দেখে থাকি। তবে এমন অনেক শিশু অভিনেতা রয়েছেন যাদের অভিনয় আমাদের স্মৃতি জাগরুক হয়ে রয়েছে। কিন্তু এ আলোচনায় আমরা বলছি, সেসব শিশু অভিনয় শিল্পীদের কথা, যারা কেবল একবারের অভিনয়ে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।

এমন আরও অনেক শিশু অভিনয়শিল্পী আছেন, যারা পরবর্তী সময়ে পরিণত বয়সে অভিনয় করলেও তাদের শৈশবের অভিনয়ের স্মৃতিই জেগে থাকে দর্শকদের মনে। যেমন সোনার কেল্লার কুশল চক্রবর্তী, মাসুমের যুগল হংসরাজ, শাখা প্রশাখার সোহম চক্রবর্তী। লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিওরও অনেক হৃদয়স্পর্শী অভিনয় রয়েছে তার শৈশব ও কৈশোর বয়সে।

তবে কৈশোরে একটি মাত্র ছবিতে অভিনয়ের সূত্রে যে ক’জন শিল্পী অমর হয়ে রয়েছেন তাদের কথা এ নিবন্ধের শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে। এদের মধ্যে বিশিষ্ট একজন এনজো স্তেয়োলা, যিনি ভিত্তোরিও ডিসিকার বাইসাইকেল থিভস ছবিতে পোস্টারম্যান আন্তোনিও রিচির (অভিনয়ে ল্যামবার্তো ম্যাজ্জিওরানি) শিশুপুত্র ব্রুনো রিচির চরিত্রে প্রাণবন্ত অভিনয় করেছিলেন। তাঁদের দুজনের অভিনয় এতোটাই স্বত:স্ফূর্ত ছিল, কখনোই মনে হয়নি তাঁরা সত্যিকারের পিতাপুত্র নন। দুজনেরই ছিল একটা প্রথম অভিনীত ছবি। ল্যামবার্তো ছিলেন একজন কারখানা শ্রমিক। ডিসিকা তাঁর ছবির চরিত্র উপযোগী অভিনয়শিল্পী খুঁজছিলেন সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে। খুঁজতে খুঁজতে তিনি এক কারখানায় কর্মরত শ্রমিক ল্যামবার্তোকে আবিষ্কার করেন এবং কাস্ট করেন আন্তোনিও চরিত্রে। এই চরিত্রে ল্যামবার্তোর মর্মস্পর্শী অভিনয় (প্রকৃতপক্ষে অভিনয় নয়, জীবনের অভিজ্ঞতার প্রকাশ) তাঁকে ভুবনখ্যাত করে তোলে এবং পরবর্তীকালে তিনি ইতালির চলচ্চিত্রাঙ্গনের একজন বরেণ্য অভিনেতায় পরিণত হন। অভিনয় করেন অনেক ছবিতে। কিন্তু ব্রুনো চরিত্রের অভিনেতা এনজো স্তেয়োলা পরবর্তী সময়ে আরো দুয়েকটি ছবিতে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করলেও তেমন মনোযোগ আকর্ষণে সমর্থ হননি। ল্যাম্পবার্তো ও এনজো দুজনেই বাইসাইকেল থিভস ছবিতে অভিনয়েরসূত্রে সারা বিশ্বের চলচ্চিত্র দর্শকদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। ল্যামবার্তো প্রয়াত হয়েছেন ২২ এপ্রিল ১৯৮৩ (জন্ম ২৮ আগস্ট ১৯০৯) ৭৪ বছর বয়সে। আর এনজো প্রয়াত হলেন সম্প্রতি, গত ৪ জুন (জন্ম ১৫ নভেম্বর ১৯৩৯) ৮৬ বছর বয়সে।

বিশ্ব চলচ্চিত্রের শীর্ষস্থানীয় পাঁচটি চলচ্চিত্রের অন্যতম ভিত্তোরিয়ো ডি সিকার বাইসাইকেল থিভস। নানাবিধ গুণে এই ছবি অনেক দিন ধরেই পাঠ্যচলচ্চিত্রে পরিণত। চলচ্চিত্র শিক্ষণের ক্ষেত্রে এই ছবির গুরুত্ব অপরিসীম। ইতালি বিশ্বচলচ্চিত্রে নিও রিয়ালিস্ট বা নব বাস্তবতাবাদ ঘরানার জন্মদাত্রী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিপর্যস্ত ইতালির দুঃসহ অর্থনৈতিক দুরাবস্থা ও সামাজিক বিশৃঙ্খলাই সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ চলচ্চিত্রকারদের এই ঘরানায় চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী করে তোলে। রসেলিনি, জাভাতিইন, ভিসকান্তি, ডি সিকাএঁদের নেতৃত্বে নিও রিয়ালিজম চলচ্চিত্র আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। এই ঘরানার তথাকথিত দৃশ্যজ নান্দনিক সৌন্দর্যের বিরোধী। স্টুডিওর কৃত্রিমতা থেকে সিনেমাকে বাইরের পরিবেশ নিয়ে আসা, পেশাদার ও তারকা অভিনয়শিল্পীর পরিবর্তে চরিত্রানুগ সাধারণ মানুষদের দিয়ে চরিত্র রূপায়ণ, তাদের জীবনের সাধারণ বিষয় অবলম্বনে চিত্রনাট্য রচনা, অহেতুক আলোরূপসজ্জা বর্জন এবং স্বল্প বাজেটে নির্মাণ এই ঘরানার বৈশিষ্ট্য। জীবনঘনিষ্ঠ ও বাস্তবানুগ এই চলচ্চিত্রধারা ক্রমশ দর্শক মনে গভীর গভীর প্রভাব ফেলতে থাকে এবং ধীরে ধীরে তা সারা চলচ্চিত্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

বস্তুত রবার্তো রসেলিনির ছবি ‘রোমওপেন সিটি’ যাতে নাৎসি বর্বরতা ও দখলদারীর বিরুদ্ধে ইতালির জনগণের জীবন সংগ্রামকে চিত্রায়ন করা হয়েছিল, সে ছবির মাধ্যমে নিও রিয়ালিস্ট চলচ্চিত্র ধারার সূচনা ঘটে। তবে সর্বার্থে এই ধারার সকল বৈশিষ্ট্যমন্ডিত প্রথম সার্থক চলচ্চিত্রবাইসাইকেল থিভস। সেই ছবিটির মতোই তার অভিনয়শিল্পীরাও পরবর্তী সময়ে কিংবদন্তীতে পরিণত হয়ে যান। তাদেরই অন্যতম এ ছবির প্রধান শিশু চরিত্র ব্রুনোর অভিনেতা এনজো স্তেয়োলা, যার অভিনয় ছিল প্রায় পুরো ছবিটা জুড়ে এবং তার অভিনয় দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল। এখনও যখন ছবিটি দেখা হয় সেই একই অনুভূতি সৃষ্টি হয় এই প্রজন্মের দর্শকের মনেও।

ব্রুনো চরিত্রটি হতদরিদ্র পিতামাতার এক সংবেদনশীল শিশুপুত্রের যে মাত্র ৫ কি ৬ বছর বয়সেই সংসারের দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত। সে তার বাবার সহকারী হয়ে কাজ করে। বাবার কাজ পোস্টার লাগানো। দরিদ্রক্লিস্ট সংসারে শিশু ব্রুনো দুঃখ কষ্টকে মানিয়ে নিয়ে হাসিমুখে থাকে। একদিন তার বাবার সাইকেলটি চুরি হয়ে গেলে পুরো পরিবার মহাসংকটে পড়ে যায়। কারণ এই সাইকেলে চড়েই তার বাবা পোস্টার লাগান। সারা রোম শহরে পিতাপুত্র দু’জনে মিলে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে চুরি যাওয়া সাইকেলের হদিস পায় না। শেষ পর্যন্ত ব্রুনোর বাবা নিজেই একটা সাইকেল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে এবং গণপিটুনির শিকার হয়। শিশু ব্রুনো বাবার কষ্টে অত্যন্ত মুষড়ে পড়ে। অপমানে সে তখন দীর্ণ। অসহায় বাবার হাতটা চেপে ধরে। তার সঙ্গে দর্শকেরাও আর্দ্র হয়ে পড়েন। বিপর্যস্ত পিতাপুত্র ভগ্নহৃদয়ে আবারও পথে নামে অসহায় পিতাপুত্র। অতি সাধারণ গল্পের অসাধারণ চিত্রনাট্য রচনা এবং তার অনবদ্য চলচ্চিত্রায়ন করেছিলেন ভিত্তোরিয়ো ডিসিকা।

পিতাপুত্রের চরিত্রে অসামান্য অভিনয় করেছিলেন ল্যামবার্তো ম্যাজ্জিওরানি ও এনজো স্তেয়োলা। পূর্বেই উল্লেখ হয়েছে এনজো প্রয়াত হয়েছেন কয়েকদিন আগে ৪ জুন। নিও রিয়ালিস্ট মাস্টারপিস বাইসাইকেল থিভসে অভিনয়ের সময় এনজোর বয়স ছিল নয়। তাঁর সাবলীল অভিনয় দারিদ্র্যক্লিস্ট পরিবারের নিষ্পাপ শিশুদের কঠিন জীবন সংগ্রামের বাস্তব প্রতীক হয়ে রয়েছে।

এনজো স্তেয়োলা রোম শহরের একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৯ সালের ১৫ নভেম্বর। মায়ের খুব কড়া শাসনে থাকতেন। অবশ্য খুব শান্ত প্রকৃতির ছিলেন শৈশব থেকেই। মায়াভরা দুটি আয়ত নয়ন ছিল তাঁর চেহারার অন্যতম বৈশিষ্ট্য যা ডিসিকাকে আকর্ষণ করেছিল এবং তিনি বাইসাইকেল থিভস ছবির অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্লোজআপে এনজোর এই মায়াভরা চোখকে ধরে রেখেছিলেন। একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে ডিসিকা এনজোর পিছু নিয়ে তাঁর বাড়িতে পৌঁছে যান। প্রথম দেখাতেই এনজোকে ডি সিকা ব্রুনো চরিত্রের জন্যে পছন্দ করে ফেলেন। এনজোর মাকে তাঁর অভিনয়ের জন্যে প্রস্তাব দিলে তিনি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। পরে এনজোর কাকার মধ্যস্থতায় ব্যাপারটি ফয়সালা হয়। কাকা এনজোকে ডিসিকার স্টুডিওতে নিয়ে গেলে ডি সিকা কোনো অডিশন ছাড়াই সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ব্রুনো চরিত্রে কাস্ট করেন।

ছবিটি তৈরিতে যতদিন সময় লেগেছিল, এনজো ততদিন স্কুল ও বাড়ি ছাড়া আর কোথাও যেতে পারতেন না। স্কুলও কামাই করতে হতো অনেক সময়, যা নিয়ে শিক্ষকদের বকুনি খেতে হতো। ২০০৩ সালে লা রিপাবলিকা পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে এনজো বলেছিলেন, ‘তখন আমার খুব মন খারাপ করতো। কারণ স্কুলে এবং বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা ও দুরন্তপনা করার অনুমতি ছিল না আমার। পরিচালক ভয় পেতেন, এতে যদি আমার চোখে বা মুখে কোনো আঘাত লাগে তবে তা ছবির জন্যে ক্ষতিকর হবে। অনেক কষ্ট করে তিনি আমাকে খুঁজে বের করেছিলেন।

তবে পরিচালক ডিসিকার প্রতি তাঁর অনেক অভিমানও ছিল। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘ছবিটি শ্রেষ্ঠ বিদেশি ছবি হিসেবে অস্কার পেলেওডিসিকা আমাকে আর কোনোদিন ডাকেননি। তিনি যদি আমাকে তাঁর আরও ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ দিতেন, তবে একজন নামকরা অভিনেতা হিসেবে আমি আমার ক্যারিয়ারটি গড়ে তুলতে পারতাম।’

অভিনয়ের প্রতি বেশ ঝোঁক ছিল এনজোর। চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু দুয়েকটি ছবিতে ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করে এক পর্যায়ে এজগৎ থেকে দূরে সরে যান। তিনটি মাত্র ছবি দি বেয়ারফুট কনটেসা, হার্টস উইদআউট বর্ডারস এবং ভলকানোতে গৌন চরিত্রে সুযোগ পেয়ে তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং ভিন্ন ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে মনোযোগী হন। এরপর প্রথমে গণিতের শিক্ষকতায় এবং পরে পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন সরকারি ভূমি নিবন্ধন দপ্তরে। তবে কিংবদন্তী চলচ্চিত্র বাইসাইকেল থিভসের ব্রুনো চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থেকে যাবেন এনজো স্তেয়োলো।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউজ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধঅপার সম্ভাবনার পটিয়ার পূর্ব হাইদগাঁও গ্রাম