নগরীর ব্যস্ততম সবকটি সড়কের ফুটপাত হকারদের দখলে। এসব ফুটপাত দখল করে অস্থায়ী চুক্তিতে ভাসমান হকারদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়া এসব দোকান থেকে সমিতির নামে দৈনিক ১০ টাকা হারে চাঁদাও আদায় করা হচ্ছে। আদায়কৃত চাঁদা থেকে ভাগ পান সংশ্লিষ্ট সবাই। কোটি কোটি টাকা চাঁদা আদায়ের সুযোগ থাকায় রাজনৈতিক বলয়ের হকার নেতারা দীর্ঘদিন ধরে ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করছে। ফুটপাতের পাশাপাশি রাস্তার বিশাল অংশও হকারদের দখলে চলে যাওয়ায় যানবাহন চলাচলে চরম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। এখন আর ফুটপাত দিয়ে সাধারণ মানুষ চলাচল করতে পারছে না। ঝুঁকি নিয়ে সড়কেই হাঁটতে হচ্ছে পথচারীদের।
বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন আজাদীকে বলেন, নগরবাসীর অধিকার রক্ষা আমার প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব। তাই হকারদের আমি বলে দিয়েছি, বসতে হলে নিয়মতান্ত্রিকভাবে বসতে হবে। প্রয়োজনে আমি কার্ড করে দেব। সেখানে নিয়মাবলী লেখা থাকবে। বিকেল তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত হকাররা চার পায়া টেবিল নিয়ে বসবে। রাত আটটার পর চলে যাবে। এরপর আমি পরিচ্ছন্নতার কাজ করব, যাতে সকালে মানুষ একটি সুন্দর নগরী দেখতে পায়। এ বিষয়ে পুলিশ প্রশাসনের সাথেও আমার কথা হয়েছে। পুলিশ মাঝখানে এদের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছিল। হঠাৎ কেন নীরব হয়ে গেল বুঝতে পারছি না।
হকারদের থেকে রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজির বিষয়টিও স্বীকার করেছেন প্রশাসক। তিনি বলেন, এটা অস্বীকার করার কিছু নেই যে স্থানীয় তথাকথিত কিছু নেতা কর্মী দলের নাম ভাঙিয়ে এ কাজ করছে। এদেরকে জীবনে কখনো আমি আন্দোলন সংগ্রামে দেখিনি। এদের অনেকে আবার আড়ালে আমার বিরুদ্ধে হকারদের উস্কানি দিচ্ছে, এ খবরও আমার কাছে আছে। আমার বিরুদ্ধে এসব করে যে সুবিধা হবে না, তা তারা বুঝতে পারছে না। আমার কথা হলো- এ শহরকে মানবিক শহরে পরিণত করতে হলে আমাদের সকলকে জাগতে হবে। আমি সেই জাগানিয়ার কাজটি করে চলেছি।
চট্টগ্রাম ফুটপাত হকার সমিতির হিসাব মতে, নগরীতে স্থায়ী ও ভাসমান মিলে প্রায় ১৫ হাজার হকার রয়েছে। যারা চট্টগ্রাম ফুটপাত হকার্স সমিতি, মেট্রোপলিটন হকার্স সমিতি, হকার্স লীগসহ বিভিন্ন সমিতির সদস্য। যাদের থেকে বড় অঙ্কের চাঁদা আদায় নিয়ে প্রায় সময় সংঘর্ষসহ অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। তবে বাস্তবে নগরীতে হকারের সংখ্যা অনেক বেশি। এসব হকারের মধ্যে একটি বড় অংশ দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক ভিত্তিকে চাঁদা দিতে বাধ্য হচ্ছে। সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও যুবলীগসহ বেশ কয়েকটি সংগঠনের নাম ব্যবহার করে স্থানীয় পাতিনেতা ও সন্ত্রাসীরা চাঁদা আদায় করছে। এছাড়া হকারদের থেকে সমিতির ব্যানারে দৃশ্যমান দৈনিক ১০ টাকা হারে চাঁদা তোলা হয়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তোলা হয় ৫০ থেকে ১০০ টাকা। আবার সেই টাকার ভাগ জ্যামিতিক হারে বাড়ে রমজান মাসের আগে।
সরেজমিনে দেখা যায়, নগরীর নিউ মার্কেট, বহদ্দারহাট, ২ নম্বর গেইট, মুরাদপুর, চকবাজার, কাজির দেউরি, দেওয়ানহাট মোড়, আগ্রাবাদ, আন্দরকিল্লা, নাসিরাবাদ, কর্ণফুলী নতুন ব্রিজ, লালদীঘির দুই পাড়, তিনপুলের মাথা, বন্দর ফকিরহাট, পতেঙ্গা ইপিজেড এলাকা, অক্সিজেন মোড়সহ অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ এলাকার ফুটপাথে ৩০ বছর ধরে গড়ে উঠেছে এসব অবৈধ স্থাপনা।
নগরীতে সবচেয়ে বড় ফুটপাথ ব্যবসা হচ্ছে নিউমার্কেট এলাকায়। স্টেশন রোড থেকে শুরু করে রেয়াজউদ্দিন বাজারের প্রবেশ মুখ, পিডিবি অফিস, নূপুর মার্কেট, নিউমার্কেট মোড়, জলসা মার্কেট, মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট, আমতলা পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। ওই দিকে শাহ আমানত মার্কেট থেকে বঙ্গবন্ধু ল টেম্পল কলেজ পর্যন্ত। ওই এলাকায় ছোট বড় সব মিলিয়ে প্রায় তিন হাজারের উপরে দোকান রয়েছে।
একই অবস্থা নগরীর বহদ্দারহাট এলাকায়। বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারের সামনে ফুটপাত ও গাড়ি পার্কিংয়ের নির্দিষ্ট স্থান দখল করে বসানো হয়েছে দোকান। মোড়ে নালার ওপর অবৈধভাবে রয়েছে ফলের দোকান। তাছাড়া ওই এলাকায় সন্ধ্যার পর রাস্তার ওপর বসে কাঁচাবাজার ও শতাধিক ভ্রাম্যমাণ দোকান। অধিকাংশই স্থানীয় সন্ত্রাসীদের দখলে। বহদ্দারহাটের মতো নগরীর মুরাদপুর, ২ নম্বর গেট, নাসিরাবাদ, অক্সিজেন মোড় বাসস্টেশন, চান্দগাঁও বাসটার্মিনাল, আগ্রাবাদ বাদামতলী মোড়, বাণিজ্যিক এলাকার ব্যাংকপাড়া, কাজির দেউরি, আন্দরকিল্লা, দেওয়ানহাট মোড়সহ নগরীর অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সন্ত্রাসীরা ফুটপাথ এমনকি রাজপথ দখল করে আছে।
একই অবস্থা কর্ণফুলী তৃতীয় সেতু এলাকায়। ফুটপাতের বিশাল জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে প্রায় ২০টি ফলের দোকান। ফলে যানজট লেগে থাকে সব সময় ওই এলাকায়। স্থানীয় সন্ত্রাসীরা সাপ্তাহিক হারে চাঁদা নেয় তাদের কাছ থেকে।
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, তাদের দোকানের সামনে একেবারে আড়াল করে চলছে ফুটপাত ব্যবসা। ফুটপাত ও রাজপথ দখল করে দোকান বসানোর কারণে বঙ্গবন্ধু ল টেম্পল, মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুল ও অধিকাংশ মার্কেট দেখা যায় না। অনেকবার বলার পরও কোনো কাজ হয় না। এ ব্যাপারে চসিক ও পুলিশ প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিয়েও কোন সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। একবার উচ্ছেদ করলেও কয়েক ঘন্টার মধ্যে আবারও দখল হয়ে যায় ফুটপাত।
সিএমপির কোতোয়ালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন আজাদীকে বলেন, সড়ক আইনে যেমন জরিমানা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে সেভাবে যদি রাস্তা দখলের বিরুদ্ধেও কঠোর আইন করা হয় তাহলে তাদের উচ্ছেদ করা সহজ হবে।