অতিসম্প্রতি ঢাকায় ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে দেশের আপামর জনসাধারণ ও নানা শ্রেণি–পেশা–আবাল–বৃদ্ধ–বনিতার ফিলিস্তিনের নির্যাতিত জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশ এক অভিনব অধ্যায় রচনা করেছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন নগর–শহর এমনকি গ্রামীণ জনপদেও এ ধরনের প্রতিবাদ–সংহতি অনুষ্ঠান পরিলক্ষিত। ঐক্যবদ্ধ জনতার এমন স্বতঃফূর্ত সমর্থন এবং অন্যদিকে ইসরাইলের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ প্রকৃত অর্থেই অসাধারণ। উক্ত সমাবেশে পাঠকৃত পাঁচ দফা সম্বলিত ঘোষণাপত্রে ইসরাইলের সাথে বাংলাদেশ সরকারের সকল চুক্তি বাতিলের দাবিসহ গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন বন্ধ এবং মুসলিম বিশ্বকে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক ছিন্নের জোরালো আহ্বান উচ্চকিত। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এই বিক্ষোভের নানা দিক গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত মার্চ ফর গাজা কর্মসূচির জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘আরব বিশ্বসহ অন্য মুসলিম দেশগুলো যা পারেনি, বাংলাদেশ তা দেখিয়েছে। ফিলিস্তিনের প্রতি বাংলাদেশের সংহতি ও সহমর্মিতা সম্পর্কে ফিলিস্তিনের জনগণকে আরও সচেতন করতে আগামী ১৭ মে ফিলিস্তিন টিভির একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করবে। তারা এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহপূর্বক একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করবে যা পরবর্তীতে ফিলিস্তিন টিভিতে প্রচারিত হবে।’
পৃথিবীর অন্যান্য জাতিরাষ্ট্রে কয়েকশ বা হাজারের অধিক গণহত্যা হলে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন ব্যাপক ভূমিকা পালন করে থাকে। এ ধরনের উদ্যোগ প্রত্যেক বিবেকবান মানুষের কাছে উচুমার্গে ইতিবাচক কর্তব্যরূপে স্বীকৃত। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ফিলিস্তিনের ব্যাপারে চরম–নিকৃষ্টতম পর্যায়ে মানবাধিকার নিষ্পিষ্ট হলেও কারো পক্ষ থেকে কোন উচ্চবাচ্য উত্থাপিত নয়। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে মুসলিম দেশসমূহের প্রধানরাও অজানা কারণে প্রায় নিশ্চুপ। গণমাধ্যমের বদৌলতে যেসব দৃশ্যপট প্রতিনিয়ত বিশ্ববাসী পর্যবেক্ষণ করছে তাতে ফিলিস্তিনিদের সভ্যতা বিধ্বংসী এবং মানুষ হত্যার বিকৃত মানসিকতার দৃষ্টিভঙ্গিরই বহির্প্রকাশ ঘটছে। পুরো গাজা–পশ্চিমতীরসহ অন্যান্য অঞ্চলে এমন ধ্বংসযজ্ঞ স্মরণকালের বিশ্বে কোথাও হয়েছে কিনা তা ভাববার বিষয়। মৃত–গলিত লাশের স্তুপের সাথে ফিলিস্তিনিদের আহাজারি সত্যিই এতই হৃদয়বিদারক যা ভাষায় প্রকাশ দুরূহ। এমন কর্মযজ্ঞ সংঘটিত করার জন্য ন্যূনতম অনুশোচনা ইসরাইল সরকারের পক্ষ থেকে লক্ষনীয় নয়। বরং যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেও গণহত্যা পরিচালনার কদর্য অপতৎপরতা অধিকতর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইসরাইলের নৃশংস ও অমানবীয় কর্মকান্ডে গাজা পরিস্থিতি কঠিন থেকে কঠিনতর রূপ পরিগ্রহ করছে।
১৯৪৮ সাল থেকে নির্যাতিত–নিপীড়িত ফিলিস্তিনিরা যুগের পর যুগ চরম অবিচারের সম্মুখীন। দেশ থেকে জোরপূর্বক বিতাড়নের মাধ্যমে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল যে দখলদারিত্ব শুরু করেছিল; তা রোধে আজ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ পরিলক্ষিত নয়। ধারাবাহিক এ সংঘাতে নিরীহ মানুষের প্রাণহানির সঠিক পরিসংখ্যান বের করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য বিষয়। একটি স্বাধীন–সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এ সমস্যার একমাত্র ন্যায়সংগত সমাধান হলেও; ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষার্থে বা পক্ষপাততুষ্ট আচরণের কারণে কিংবা নতুন নতুন সংকটে এ বিষয়ে তথাকথিত উন্নত–ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের নানা রকম উদ্যোগ–প্রতিশ্রুতি বারংবার ব্যর্থই হয়েছে। জাতিসংঘ বা মুসলিম বিশ্বের ২২ সদস্যের আরব লীগও কোনো অর্থবহ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। বিগত দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে শান্তি আলোচনা চলছে ধীরে ধীরে। স্বাধীনতার প্রশ্নে পৃথিবীর বিপুল সংখ্যক দেশ ফিলিস্তিনের পক্ষে থাকলেও কথিত পরাশক্তি হিসেবে খ্যাত কতিপয় রাষ্ট্রের সরাসরি সমর্থন ইসরাইলকে আরো বেশিমাত্রায় বেপরোয়া করেছে বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা।
আমাদের সকলের জানা, গত ৭ অক্টোবর ২০২৩ ফিলিস্তিনের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে দীর্ঘকাল ধরে পরিচালিত যুদ্ধের অংশ হিসেবে হামাসের ইসরাইল আক্রমণকে কেন্দ্র করে ইসরাইলের পক্ষ থেকে গাজা ও পশ্চিম তীরে নৃশংসতম হত্যা–গণহত্যার দৃশ্যাদৃশ্য সুস্পষ্ট। বিশ্বের কতিপয় ক্ষমতাধর কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রনায়কের আর্থিক ও আধুনিক সামরিক সহযোগিতা অব্যাহত রেখে নারকীয় তান্ডবের নজিরবিহীন দৃশ্যপট তৈরি করে চলছে। পশুতুল্য দানবদের সার্বিক সহযোগিতায় ইসরাইল ফিলিস্তিনে শুধু গণহত্যা পরিচালনা করেনি; নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য সরবরাহে বাধা প্রদান করে নির্মম মানবেতর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে গণহত্যার শিকারে পরিণত শিশু–নারীসহ প্রায় ৬০ হাজারের কথা বলা হলেও অনেকের মতে তা লক্ষাধিক। পরাক্রমশীল রাষ্ট্রসমূহের প্রত্যক্ষ মদদ অবাক বিস্ময়ে পুরোবিশ্ব আবলোকন করছে।
চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি ইসরায়েল সরকার ও হামাসের যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তি চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ১৫ মাস ধরে ফিলিস্তিনে চলমান বর্বরতম হত্যা–গণহত্যা বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। বহুল প্রতীক্ষিত যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরপরই গাজাবাসীদের মাঝে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আনন্দে বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস দেখা দেয়। মিষ্টি বিতরণ, ফটকা ফুটানোসহ নানা উল্লাসে তারা মেতে ওঠে। যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুসারে ছয় সপ্তাহের প্রথম ধাপেই হামাস ৩৩ ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেবে। তার বিনিময়ে ইসরায়েল ছেড়ে দেবে তাদের জেলে আটক কয়েকশ ফিলিস্তিনি বন্দিকে। একই সময়ের মধ্যে ইসরায়েলি বাহিনীকে গাজার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ছাড়তে হবে এবং বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা পাবে বাড়ি ফেরার অনুমতি। পাশাপাশি প্রতিদিন শত শত ত্রাণবাহী লরিকে গাজায় ঢোকারও সুযোগ দেবে ইসরায়েল। চুক্তির দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে আলোচনা শুরু হবে প্রথম ধাপের ১৬তম দিনে। তৃতীয় ও শেষ ধাপে হবে গাজার পুনর্গঠন যা শেষ হতে লাগবে কয়েক বছর। গাজার ভেতর ৮০০ মিটারের একটি বাফার জোন তৈরি করা হবে যার নিয়ন্ত্রণ থাকবে ইসরায়েলের হাতে। যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর ইসরাইল ও হামাস চার ধাপে বন্দি বিনিময় করে। এরই মধ্যে মুক্তি দেওয়া হয়েছে ১৮ জিম্মি ও কয়েক শত ফিলিস্তিনিকে। কিন্তু গাজা থেকে ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহারে মতবিরোধ, বন্দি বিনিময় ও জিম্মিদের পরিস্থিতি, কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা, মানবিক সহায়তা বন্ধ করাসহ বিভিন্ন কারণে যুদ্ধবিরতি ভেস্তে যায়। যুদ্ধবিরতি এবং বন্দি বিনিময় চুক্তির প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ১৮ মার্চ থেকে শুরু হওয়া ইসরাইলি বাহিনীর অবরোধ ও নির্বিচার হামলায় গাজা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। নতুন হামলা শুরুর পর থেকে মৃত্যু তালিকায় যুক্ত হয়েছে ১ হাজার ৬০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনির নাম।
বোমা হামলায় ক্ষতবিক্ষত ফিলিস্তিনিদের তীব্র খাদ্য সংকট মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে প্রতিভাত। ছয় সপ্তাহের বেশি সময় বন্ধ রাখা হয়েছে গাজা উপত্যকার ২৩ লাখ বাসিন্দার জন্য সকল ধরনের সরবরাহ। চেকপয়েন্টগুলো বন্ধ থাকায় ঢুকতে পারছে না ত্রাণবাহী ট্রাক। অবিলম্বে চেকপয়েন্টগুলো খোলা না হলে অধিকাংশ গাজাবাসীর ক্ষুধার তাড়নায় মৃত্যুবরণের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ গাজায় ক্রমবর্ধমান ক্ষুধা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসের বিবৃতি মারফত জানা যায়, অবরুদ্ধ ছিটমহলে ভয়াবহ মানবিক ও পরিবেশগত বিপর্যয় নেমে এসেছে। ইসরাইল ৯০ শতাংশেরও বেশি পানি ও স্যানিটেশন অবকাঠামো পদ্ধতিগতভাবে ধ্বংস করেছে। ফলে গাজার ৭০ শতাংশ পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। গাজার এমন অমানবিক পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক সাহায্যকারী সংস্থা রেড ক্রসের প্রেসিডেন্ট গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘পৃথিবীর দোজখে পরিণত হয়েছে গাজা, যেখানে মানুষ বিদ্যুৎ–পানি ও খাবারের সংকটে রয়েছে। গাজায় সরবরাহ মারাত্মকভাবে কমে গেছে। গাজার মানুষের জন্য রসদের অভাবে অস্থায়ী হাসপাতালগুলো আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে বন্ধ করে দিতে হতে পারে।’ জাতিসংঘের ভাষ্য, ইসরাইলের সহিংস আক্রমণের কারণে গাজার প্রায় ৮৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত এবং অবরুদ্ধ এই ভূখন্ডের ৬০ শতাংশ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন মতে, হাসপাতালগুলোতে ওষুধের মজুত বিপজ্জনক ও নজিরবিহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে। ইসরাইলি হামলায় আহতদের চিকিৎসা প্রদানে প্রতিনিয়তই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন গাজার চিকিৎসকরা। ত্রাণসামগ্রী বন্ধ থাকায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম প্রবেশ করতে পারছে না। প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকার ৩৭ শতাংশের মজুত নেই। চিকিৎসা সরবরাহের ৫৯ শতাংশই মজুত শূন্য। ৫৪ শতাংশ ক্যানসার এবং রক্তের রোগের ওষুধ নেই। তাছাড়া ৮০ হাজার ডায়াবেটিক রোগী এবং ১ লক্ষ ১০ হাজার হাইপারটেনসিভ রোগীর যত্ন নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অ্যান্টিবায়োটিক এবং রক্তের ব্যাগের সরবরাহও দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। গাজার পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। অন্যান্য মানবিক সংস্থাসমূহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিকট এ সংকট সমাধানে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
এটি সুস্পষ্ট যে, গাজায় নারকীয় তান্ডবের বিরুদ্ধে পুরোবিশ্ব ঐক্যবদ্ধ। জাতিসংঘের মানবিক যুদ্ধবিরতিসহ পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক দেশেই প্রতিদিনই বিশাল জনসমাবেশ–র্যালির মাধ্যমে ইসরাইল ও সহযোগী কর্তৃত্ববাদীদের নির্মূলে জোরালো উচ্চারণ ধ্বনিত–প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ গাজায় গিয়ে ইসরাইলি হায়েনাদের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। বিভিন্ন মুসলিম দেশের সম্মিলিত উদ্যোগে এর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে বিশ্বের সকল মুসলমান সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণে আগ্রহী বলে আমার বদ্ধমূল বিশ্বাস। একই সাথে এটি বলতে হয় যে, বিভিন্ন সভা–সমাবেশ অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। তবে বিভিন্ন উপায়ে প্রত্যেকেই কমবেশি অর্থ সাহায্য দিয়ে সরকারকে অনুপ্রাণিত করার মাধ্যমে সেদেশে খাদ্য–পানি–ওষুধসহ অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী পাঠানো অনিবার্য। সম্প্রতি ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মিয়ানমারে যেভাবে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর নিজস্ব যান ব্যবহার করে যে বিপুল পরিমাণ দ্রব্যাদি প্রেরণ করা হয়েছে একই উপায়ে ফিলিস্তিনেও ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যাবশ্যক।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ–অপরাধবিজ্ঞানী