ফার্নেস অয়েল যখন বিপিসির মাথাব্যথা

বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বাড়তি সুবিধার কারণে তৈরি হয় সংকট

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ২৮ অক্টোবর, ২০২০ at ১০:১৩ পূর্বাহ্ণ

সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে চাহিদা থাকলেও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ফার্নেস অয়েল। চাহিদা বেড়ে গিয়ে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে উৎপাদিত ফার্নেস অয়েলের কখনো সংকট তৈরি হয়, কখনো মজুদ বেড়ে গিয়ে শাটডাউন (বন্ধ) রাখতে হয় রাষ্ট্রীয় একমাত্র রিফাইনারিটি। অভিযোগ রয়েছে, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে বাড়তি সুবিধা হিসেবে আমদানির সুযোগ করে দেওয়ায় ফার্নেস অয়েল নিয়ে বছরের বিভিন্ন সময়ে সংকটে পড়ছে বিপিসি।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, সরকারি-বেসরকারি মিলে দেশে বর্তমানে ফার্নেস অয়েল নির্ভর ৪৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে ২৬টি হচ্ছে বেসরকারি আইপিপি (ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট) এবং ২০টি সরকারি। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে মাসে ৬০ হাজার টন ফার্নেস অয়েলের চাহিদা রয়েছে। সূত্রে জানা গেছে, বছরের বেশিরভাগ সময়ে সরকারি প্ল্যান্টগুলোর উৎপাদন বন্ধ থাকে। কারণ বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকলেও কমার্শিয়াল চার্জ পায় বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে। তাই বেসরকারি প্ল্যান্টগুলো বেশিরভাগ চালু থাকে। সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে চাহিদা রয়েছে মাসে ১৫ হাজার টন। আইপিপিগুলোতে চাহিদা থাকে ৪৫ হাজার টন। দেশীয় কিছু শিল্প কারখানায় ৩-৫ হাজার টন ফার্নেস অয়েলের চাহিদা থাকে। অন্যদিকে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেয়ে ২০১৪ সাল থেকে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ফার্নেস অয়েল আমদানি শুরু করে। এরপর আইপিপিগুলো বিপিসি থেকে ফার্নেস অয়েল নেওয়া বন্ধ করে দেয়।
বিপিসি সূত্র জানায়, ইস্টার্ন রিফাইনারিতে প্রতি মাসে ৩৫ হাজার টন ফার্নেস অয়েল উৎপাদন হয়। কিন্তু বেসরকারি প্ল্যান্টগুলোর চাহিদা না থাকায় প্রতি মাসে কমপক্ষে ১৫ হাজার টন অবিক্রিত রয়ে যায়। ইস্টার্ন রিফাইনারিতে ফার্নেস অয়েল স্টোরেজ ক্যাপাসিটি রয়েছে ৬২ হাজার মেট্রিক টনের। বেশ কয়েক মাসের অবিক্রিত ফার্নেস অয়েল নিয়ে গত এপ্রিল মাসে বিপাকে পড়ে বিপিসি। এসময় ইস্টার্ন রিফাইনারির স্টোরেজ ট্যাংকসহ সারা দেশে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা অয়েলের ডিপোগুলোতে প্রায় দেড় লাখ টন ফার্নেস অয়েল অবিক্রিত থাকে। পরে স্টোরেজ করার সক্ষমতা না থাকায় ওই মাসে প্রায় ২৫ দিন বন্ধ শাটডাউন করতে হয় ইস্টার্ন রিফাইনারি।
বিপিসির কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এপ্রিল মাসে ইস্টার্ন রিফাইনারি শাটডাউন থাকার পর আইপিপি মালিকদের ফার্নেস অয়েল নেওয়ার অনুরোধ করে বিপিসি। আইপিপি মালিকদের সাথে আলাপের প্রেক্ষিতে প্রতি লিটারে ৮ টাকা দাম কমিয়ে ফার্নেস অয়েলের দাম নির্ধারণ করা হয় ৩৪.০৩ টাকায়। এর আগে ফার্নেস অয়েল বিক্রি হতো প্রতি লিটার ৪৩.০৩ টাকায়। এসময় আইপিপিগুলো বিপিসি থেকে ফার্নেস অয়েল নেওয়া শুরু করলে ইস্টার্ন রিফাইনারির উৎপাদন পুনরায় শুরু হয়। কিন্তু আইপিপিগুলো অতিরিক্ত ফার্নেস অয়েল নিয়ে নিলে নতুন করে ফার্নেস অয়েলের সংকট তৈরি হয়। এতে করে অক্টোবর মাসের শুরু থেকে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে ফার্নেস অয়েল সরবরাহ দেওয়া নিয়ে ঝুঁকি তৈরি হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিসির এক কর্মকর্তা বলেন, ফার্নেস অয়েলের যে মজুদ রয়েছে তাতে এক সপ্তাহ চলতে পারে। কিন্তু চাহিদা বেশি রয়েছে। হঠাৎ মজুদ কমে যাওয়ায় ফার্নেস অয়েল আমদানি করতে চাইলে আন্তর্জাতিক সরবরাহকারীরা আগামী ৬ নভেম্বরের আগে সরবরাহ দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে বিপাকে পড়ে বিপিসি।
তিনি বলেন, ফার্নেস অয়েলের দাম কমিয়ে দেওয়ার পর আইপিপিগুলো হুলুস্থূল করে ফার্নেস অয়েল নেওয়া শুরু করে। এখন আবার দাম বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে প্রতি লিটার ৪১ টাকা হিসেবে গেজেট হওয়ার কথা রয়েছে।
আরেক কর্মকর্তা বলেন, ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধন করার জন্য বিপিসি এরাবিয়ান লাইট ও মারবান দুই ধরনের ক্রুড অয়েল আমদানি করে। ইস্টার্ন রিফাইনারিতে মারবান পরিশোধন করলে দৈনিক ১২শ টন আর এরাবিয়ান লাইট ক্রুড ব্যবহার করলে দৈনিক ১৫শ টন ফার্নেস অয়েল তৈরি হয়। বর্তমানে সংকট কাটাতে শুধুমাত্র এরাবিয়ান লাইট ক্রুড ব্যবহার করা হচ্ছে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ফার্নেস অয়েল আমদানি করলে প্রতি লিটারে ৩৩ টাকা খরচ পড়ে। বিপিসি বেশি দামে ক্রুড আমদানি করে ফার্নেস অয়েল বানিয়ে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে সরবরাহ করছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারের দরের তারতম্যের সুযোগ নিয়ে বিপিসি থেকে ফার্নেস অয়েল না নিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করে। এখন দাম কমিয়ে দেওয়ায় আইপিপিগুলো বেশি করে নিয়ে স্টোরেজ করছে। দাম বাড়িয়ে দিলে তারা আবার নেওয়া বন্ধ করে দেবে।
বিপিসির পরিচালক (অপারেশন ও পরিকল্পনা) সৈয়দ মেহদী হাসান আজাদীকে বলেন, গত এপ্রিলে মজুদ বেড়ে যাওয়ায় ফার্নেস অয়েল স্টোরেজ করার আর জায়গা ছিল না। এতে বাধ্য হয়ে ইস্টার্ন রিফাইনারি শাটডাউন রাখতে হয়েছে। পরে আইপিপিগুলোর সাথে বৈঠক করে ফার্নেস অয়েলের দাম কমিয়ে দেওয়া হয়। এখন উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সাময়িক সমস্যা হওয়ার আশংকায় কৌশল পরিবর্তন করে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে উৎপাদন বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে ফার্নেস অয়েল প্রতি লিটার ৪১ টাকায় দর নির্ধারণ করেছি। আজ-কালের মধ্যে গেজেট হয়ে গেলে আইপিপিগুলো চাহিদা কমে যাবে। এতে ফার্নেস অয়েলের সংকট কেটে যাবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম বন্দরে দুদকের অভিযান
পরবর্তী নিবন্ধকাস্টম হাউসে যাত্রা শুরু ই-অকশনের