ফেসবুক পেইজে হত্যার একটা ভিডিও শেয়ার করে একজন লিখেছিলেন, ‘কোরান পোড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত আফগান মেয়ে ফারখুন্দার কথা মনে আছে? আফগানিস্তানের মুসলিমদের দ্বারা তাকে পাথর ছুঁড়ে, পিটিয়ে, গাড়ির পিছনে টেনে নিয়ে গিয়ে হত্যার পর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল! হত্যা করা পর্যন্ত চিৎকার করতে থাকে ফারখান্দা। প্রতি বছর হাজার হাজার শিকারের মধ্যে সেও একজন ছিল !’
আফগানিস্তানের ঐতিহ্য ভেঙে শতশত নারীরাই কফিন কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। কালো কম্বলে মোড়ানো লাশ ধীরে ধীরে হাজির হচ্ছিল গোরস্তানে…
‘কোনো পুরুষ মানুষ তার কফিন ছোঁবে না!’ ঠিক এই রকম সময়–কাঁপানো চিৎকার দিয়েছিলেন কাবুলের শত শত নারী।
ফারখুন্দা মালিকজাদা। আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের বাসিন্দা ২৭ বছরের তরুণী।
মুসলিম জনতা দ্বারা তাকে হত্যা করা হয়েছিলো আফগানিস্তানের কাবুলে। তাকে হত্যা করা হয়েছিল কোরআন পোড়ানোর অভিযোগে।
দিনটি ছিল ২০১৫ সালের ১৯ মার্চ। ফারখুন্দা মালিকজাদা শাহ দো শামশিরা মসজিদের সামনে মোল্লা জয়নুদ্দিনের সাথে তর্ক করছিলেন যিনি একজন ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে সেখানে কাজ করতেন। ফারখুন্দা তার তাবিজ বিক্রি নিয়ে তর্কে ছিলেন। তর্কে হেরে গিয়ে এসময় জয়নুদ্দিন ফারখান্দার বিরুদ্ধে কুরআন পোড়ানোর অভিযোগ তোলেন। আসলে জয়নুদ্দিন জনগণের কাছে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য কোরআন পোড়ানোর মিথ্যা অভিযোগ তুলেছিলেন।
ফারখুন্দা উত্তর দিয়েছেন,“আমি একজন মুসলিম, এবং মুসলমানরা কখনও কোরআন পোড়ায় না!”
মোল্লার অভিযোগ শুনে শত শত ক্ষুব্ধ মৌলবাদী মাজারে ভিড় করেন। পুলিশ এসে ফারখুন্দাকে এক মাইল দূরে স্থানীয় একটি বিল্ডিংয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু সে একজন মহিলা পুলিশ অফিসারকে তার সাথে যেতে বলে।
এসময়ে জনতা ফারখুন্দাকে রাস্তায় টেনে নিয়ে যায়, যেখানে তারা মাটিতে ফেলে তাকে মারধর ও লাথি মারতে থাকে। আর পুলিশ এসে উপরের দিকে ফাঁকা গুলি চালায় এবং সাময়িকভাবে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তাকে রক্ষা করার চেষ্টায় তারা তাকে শাহ দো শামশিরা মসজিদে নিয়ে যান। ভিড় আকারে বাড়তে থাকে। ফারখুন্দা আমেরিকানদের সাথে কাজ করছেন বলে গুজব ছড়াতে শুরু করেন। ক্ষুব্ধ জনতা হামলা চালানোর চেষ্টা করেন। পুলিশ তাকে ভিড়ের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টায় ভবনের ছাদে তুলে দেন। কিন্তু জনতার ছোড়া পাথর ও তক্তার আঘাতে ফারখুন্দা হঠাৎ পিছলে ভিড়ের মধ্যে পড়ে যায়।
উত্তেজিত জনতা এই সুযোগে ফারখুন্দাকে টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় নিয়ে যায় এবং মারধর করেন। এর কিছুক্ষণ পরে, তাকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়, জনতার বেশ কয়েকজন সদস্য তাকে ধাক্কা দেয় এবং তারপর তাকে একটি গাড়ি দিয়ে টেনেহিঁচড়ে প্রায় ১০০ মিটার পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। পরে তাকে কাবুল নদীর কাছে নিয়ে এসে, উত্তেজিত জনতা, তাকবীর এবং আমেরিকা বিরোধী স্লোগান দিতে থাকে, তার মৃতদেহকে আগুন দেওয়ার আগে আরও একবার পিটিয়ে নেয়। হামলাকারীদের কেউ কেউ তাদের জামাকাপড়ের কিছু অংশ ছিঁড়ে ফেলে জ্বালানোর জন্য ব্যবহার করে। মালেকজাদা রক্তে ভিজে গেলেন আর আগুনের ভেতরে জ্বলতে থাকলেন।
মেয়েটির অপরাধ ছিলো নিজের বিশ্বাসকে সবার ওপরে স্থান দিয়েছিল বলে। বলেছিল ‘আমার বিশ্বাসের চেয়ে বড় কিছু নেই’। তার এমনই ‘ঔদ্ধত্য’র জবাব দিয়েছিল পাষণ্ড, উন্মত্ত জনতা।
আফগান প্রেসিডেন্ট এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছিল। আবার কিন্তু কিছু মহল থেকে প্রশংসাও পেয়েছিল, যার মধ্যে ছিলেন একজন বিশিষ্ট ধর্মগুরু। যিনি জোর দিয়েছিলেন যে পুরুষদের দ্বারা মুসলিম বিশ্বাসকে যে কোনও মূল্যে রক্ষা করার অধিকার রয়েছে।
যুগে যুগে নারীদেরকে বহন করতে হয়েছে অপবাদ, অবহেলা, শোষণ। অত্যাচারিত হতে হয়েছে প্রতিবাদের ভাষার জন্যে। তবুও কেউ না কেউ প্রতিবাদের ঝড় তুলেই যায়। এমনই WLUML networker in Afghanistan থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়– “No Man Will Touch Her Coffin“!
তারপর শত শত আফগান নারী পথে নেমে আসে। নারী অধিকার কর্মীরা ফারখুন্দার কফিন বহন করেছেন।
কবরে নামানোর সময় জোরে জোরে “আল্লাহু আকবর” ধ্বনি দিয়ে তাকে কবরস্থ করা হয়। “আমরা ন্যায়বিচার চাই” বলে স্লোগান দিয়ে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় শত শত মানুষ উপস্থিত ছিলেন। নারীরা দেখিয়ে দিয়েছেন তাঁরাও কবর খুড়ো করে দাফন করতে পারেন।
মালিকজাদার হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এবং আফগানিস্তানে নারী অধিকারের ইস্যুতে নতুন করে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সেই বছরের শেষের দিকে, আফগানিস্তানের সলিডারিটি পার্টি কাবুলে তার জন্য একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন।
ফারখুন্দা ছিলেন একজন পর্যবেক্ষক মুসলিম যিনি বোরখা পরতেন। হামলার সময়, তিনি সবেমাত্র ইসলামিক স্টাডিজে একটি ডিগ্রি শেষ করেছিলেন এবং একটি শিক্ষকতার পদের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
ফারখুন্দাকে যে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল সেখান থেকে বিক্ষোভকারীরা মিছিল শুরু করেন। মিছিলে বেশ কয়েকজন মহিলা তার রক্তাক্ত মুখের মুখোশ পরে আফগানিস্তানে নিরাপত্তা আনতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য সরকারের নিন্দা করেছিলেন। বারাকজাই, কাবুল প্রদেশের প্রতিনিধিত্বকারী পার্লামেন্ট সদস্য এবং দীর্ঘদিনের নারী অধিকারকর্মী, আল জাজিরাকে বলেছেন যে, এই হত্যাকাণ্ড শহর ও দেশের বাকি অংশকে নারীর অধিকার নিয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছে। তিনি বলেছিলেন: “এটি কোনও পুরুষ বা মহিলা বিষয় নয়, এটি একটি মানবিক সমস্যা এবং হত্যাকারীদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরা থামব না।” পার্লামেন্টের একজন প্রাক্তন সদস্য রোশন সাইরেন বলেছেন যে, এই হত্যাকাণ্ডটি দেশের নারীর প্রতি সহিংসতাকে তুলে ধরে এবং একটি তরুণ প্রজন্মের নারীদের জন্য “নারীর সুরক্ষা ও অগ্রগতি” প্রচারের জন্য একটি সমাবেশস্থল হয়ে উঠেছে।
পরে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত হয়। সে তদন্তে ফারকুন্দার অপরাধের প্রমাণ মেলেনি। হাইকোর্টের নির্দেশে ওই অঞ্চলের পুলিশ সুপারসহ ১৪ জনকে সাসপেন্ড করে এক বছরের জেল দেয়া হয়। মামলায় ৪৯ জন সন্দেহভাজন ব্যক্তির মধ্যে বিচার করা হয়েছিল। ফারখুন্দার ভূমিকার জন্য মূলত চারজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল । ২০১৫ সালের ২ জুলাই একটি আপিল আদালত লিঞ্চিং–এ দোষী সাব্যস্ত চার ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড বাতিল করে । তাদের মধ্যে তিনজনের সাজা কমিয়ে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
ফারখুন্দা আর ফিরে আসবে না। তার মৃত্যু দেখিয়ে দিয়েছিলো আফগান নারীদের জাগরণ।
তালেবানের কঠোর ইসলামি শাসনের অধীনে মহিলারা স্কুলে যেতে পারে না, বাইরে কাজ করতে পারে না এবং পুরুষ অভিভাবক ব্যতীত বাড়ি থেকে বের হওয়া নিষিদ্ধ ।
ফারখুন্দার মৃত্যুতে আফগান নারীরা স্বাধীনভাবে কথা বলবার, নারীর অধিকার আদায়ে এখনও সোচ্চার । ফারখুন্দার মৃত্যুতে নারীরা যে তেজ–অহম দেখিয়েছিলো, এখন তা বড্ড প্রয়োজন নারীদের আত্মরক্ষার্থে ।