ফাতেহায়ে ইয়াজদাহুম ও বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)

আবুল ফরাহ মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন আলকাদেরী | মঙ্গলবার , ১৫ অক্টোবর, ২০২৪ at ৬:৪৭ পূর্বাহ্ণ

ফাতেহার অর্থ মহান ওলী আউলিয়া তথা মনীষীগণের জন্য দোয়া। ইয়াজদাহুম’ ফারসি শব্দ, যার অর্থ এগারো। ফাতেহায়ে ইয়াজদাহুম বলতে ১১তম দিনের ফাতেহা বোঝায়। এই ফাতেহায়ে ইয়াজদাহুম আবদুল কাদের জিলানি (রহ,) এর স্মরণে পালিত। এ দিবসটি সমগ্র বিশ্বের মুসলিমদের কাছে অতীব তাৎপর্যপূর্ণ।

কিন্তু অনেকেই জানেন না ফাতেহায়ে ইয়াজদাহুম কী। ফাতেহায়ে ইয়াজদাহুম হলো:- এদিন অলীকুল শিরমণি, শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ফকীহ, দার্শনিক, কাদেরিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা গাউসুল আজম, ইমামুল আউলিয়া হযরত শেখ সৈয়দ আবু মুহাম্মদ মুহিউদ্দীন আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) এর ওফাত বার্ষিকী।

তিনি ১ লা রমজান ৪৭০ হিজরিতে জিলান নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এজন্যই তিনি আবদুল কাদের জিলানি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। যখন তিনি জন্মগ্রহণ করেন তখন তার আম্মাজানের বয়স ছিল ৬০ বৎসর।

হযরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ,)-এর পিতার নাম সৈয়দ আবু সালেহ মোঃ মুসা জঙ্গি এবং মাতার নাম সৈয়্যদা উম্মুল খায়ের ফাতেমা। তিনি হযরত সৈয়্যদুনা ইমাম হাসান এবং হযরত ইমাম হোসাইন (রা,) এর বংশধর। এজন্যই তাকে হাসানী এবং হোসাইনী বলা হয়। তিনি বাগদাদের মহান পীর হজরত আবু সাঈদ ইবনে আলী ইবনে হুসাইন মাখজুমি (রহ,) এর কাছে মারেফাতের জ্ঞানে পূর্ণতা লাভ করেন এবং খেলাফত প্রাপ্ত হন।

হযরত আবদুল কাদির জিলানি (রহ.) হিজরি ৫৬১ সনের ১১ রবিউস সানি ইন্তিকাল করেন।

গাউছে পাক (রহ,) এর জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে তিনি ঘরের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র নিজেই খরিদ করতেন। ঘরের কাজ কর্ম নিজেই করতেন। এমনকি ঘরে ঝাড়ু দেওয়ার কাজও তিনি নিজে করতেন। অধিকাংশ সময় তিনি নিজেই কাঁধে করে বাইরে থেকে কলসিতে করে পানি নিয়ে আসতেন। তাঁর প্রতিটি কর্মকাণ্ড, কথাবার্তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জাতে আকদাস তথা পবিত্র সত্তার মধ্যে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। ফানা ফি রাসুল এর প্রকৃত মর্যাদা ও বুজুর্গি তিনি অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন অধিক দয়ালু, প্রতিশ্রুতি পালনকারী, উদারচিত্ত, ক্ষমাশীল। বিনয়নম্রতা, দয়াদাক্ষিণ্য, সদালাপী, পরোপকারিতা ও মমতা স্বভাবের অধিকারী। সুখে দুঃখে জীবনের সর্বাবস্থায় তার মধ্যে আল্লাহর উপর অটল নির্ভরশীলতা বিদ্যমান ছিল। আনন্দঘন মুহূর্তে তিনি যেমন আল্লাহর শুকরিয়া প্রকাশ করতেন, তেমনি বিষাদ মলিন পরিবেশেও তার মধ্যে পরিদৃষ্ট হত আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের নিদর্শন। তিনি সর্বোতভাবে আল্লাহর উপর নির্ভরশীল ছিলেন।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্দা করার পর সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও ইমামদের সোনালী যুগে কোরআনহাদিসের আলোকে দুনিয়া ছিল ঝলমল। পরবর্তীতে ভোগবাদী স্বার্থাম্বেষী ও বিজাতীয় ষড়যন্ত্রের ফলে উম্মতের ঐক্য নষ্ট হয়ে বিভিন্ন ফেরকার সৃষ্টি হয়। যার ফলে মুসলমানদের বিজয়ের ধারা মুখ থুবড়ে পড়ে। কিন্তু মহান অলীগণ জিহাদের ময়দান থেকে সামান্য সময়ের জন্যও পিছু হটেননি। তাঁরা শরিয়ত, তরিকত, হাক্কিকত ও মারিফাতের ঝাণ্ডা নিয়ে বিশ্বের আনাচেকানাচে ছুটে চলতে শুরু করেন। প্রতিষ্ঠা করেন লাখ লাখ দ্বীনি মারকাজ, মসজিদমাদ্রাসা ও খানকা। এরূপ প্রতিটি খানকাই ছিল তৎকালীন জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় ও শাসনকার্যের দফতর এবং ক্যান্টনমেন্ট স্বরূপ। এই সব প্রতিষ্ঠান থেকেই এলমি রুহানি যোগ্যতা নিয়ে বের হয়েছিলেন হাজার হাজার মর্দে মুজাহিদ। যারা ঘর ছেড়ে দুনিয়ার আনাচেকানাচে দ্বীনের প্রচার প্রসারে ভুমিকা রেখে তাদের উজ্জ্বল জীবন সমাপ্ত করেন যা ইতিহাস সাক্ষী দেয়। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো হযরত বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)। তাঁর জ্ঞানের পরিধি এত বিস্তুত ছিল যে তাঁর ইলমি মাহফিলে তৎকালীন জামানায় হাজার হাজার মানুষ হাজির থাকতেন। তাঁর দরসের মাহফিলে হেদায়ত প্রাপ্ত হয়ে এবং তাঁর আহ্বান শুনে অনেকেই আর ঘরে ফেরেননি, ইসলামী দাওয়াতী কার্যক্রম প্রচারে বিশ্বের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছেন। কোটি কোটি মানুষ তার নিকট ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ধন্য হয়েছেন। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বেশির ভাগ আল্লাহর অলিবুজুর্গ কাদেরিয়া, চিশতিয়া তরিকার শায়খ বা পীর এ দাওয়াতি কাজে ভূমিকা রেখেছে। এ মহান ব্যক্তির ৪৯ জন সন্তানের বংশধরগণ এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রেখে গেছেন। এমতাবস্থায় ফাতেহায়ে ইয়াজদাহুম শরীফ অনুষ্ঠানের গুরুত্ব কত বেশি তা একজন বিবেকবান লোকের জন্য বোঝা কঠিন নয়। এরপরও যারা ফাতেহায়ে ইয়াজদাহুমের গুরুত্ব দেবে না, বুঝবে না তারা গাফেল।

ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় মনীষী হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ) এর নাম প্রত্যেক মুসলমানের কাছে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনে তার প্রভাব অপরিসীম। তার জীবনী ও কীর্তিগাথা জীবন মুসলমানদের হৃদয়ে চিরদিন জীবন্ত হয়ে থাকবে।

একজন আদর্শ পুরুষ হিসেবে বিশ্ব জগতে মুসলমানদের কাছে তাকে পরম ভক্তি, শ্রদ্ধার সঙ্গে চিরকাল স্মরণ করবে। পৃথিবীতে আল্লাহ পাকের প্রেরিত নবীরাসূল এসেছেন ১ লাখ বা ২ লাখ ২৪ হাজার। অন্যদিকে কামেল পীর, অলি, দরবেশ, ফকির যে কত এসেছেন তার কোন হিসেব নেই। কিন্তু সব পীর, ফকির, দরবেশ, অলিদের সেরা ছিলেন হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)। তিনি মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের প্রায় ৫০০ বছর পর জন্মগ্রহণ করেন। ঐ সময়টা ইসলাম ধর্ম এক নাজুক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছিল। পবিত্র কুরআন ও আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ ভুলে মানুষ বিপথে পা বাড়িয়েছিল, ঠিক এমনই সময় বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ,) ইসলামের সঠিক পথে মানুষকে আহ্বান করে ধন্য করেছেন।

পরিশেষে আহ্বান জানাবো আল্লাহর অলিদের আদর্শ অনুসরণ করে নিজের জীবনকে ধন্য করে ইসলামের সঠিক রূপরেখা বাস্তবায়ন করার জন্য আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমিন।

লেখক :- অধ্যক্ষ, ছিপাতলী জামেয়া গাউছিয়া মূঈনীয়া কামিল মাদরাসা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানুষের মন ও মনস্তাত্ত্বিক পরিচয় কুরআন যা বলে
পরবর্তী নিবন্ধহিংসা-বিদ্বেষ নয়, চাই ভালোবাসায় সুন্দর পথপ্রদর্শন