ফরাসি ক্ষ্যাপাটে যুবক জ্যঁ ক্যা

রেজাউল করিম | বুধবার , ১০ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৮:২২ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। নয় মাসের এই যুদ্ধে অংশ নেন মানবতাবাদী অনেক বিদেশি বন্ধুও।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেক বিদেশির অবদান রয়েছে। বাংলাদেশ যখন চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, ঠিক তখন ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর প্যারিসের অরলি বিমানবন্দরে ঘটেছিল চাঞ্চল্যকর ঘটনা। এক ক্ষ্যাপাটে ফরাসি যুবক জিম্মি করেছিলেন পিআইএ’র একটি যাত্রীবাহী বিমান। উদ্দেশ্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অসহায় শরণার্থীদের পাশে দাঁড়ানো। বিমানে যাত্রী ও ক্রু মিলিয়ে মোট আরোহী সংখ্যা ২৮ জন। ঘড়িতে তখন সকাল ১১টা ৪৫ মিনিট। বিমানটি তখনও প্যারিসের রানওয়েতে, এখান থেকে উঠেছেন আরও পাঁচ যাত্রী। শেষ যাত্রী হিসেবে বিমানে ওঠেন জ্যঁ ইউজিন পল ক্যা আলজেরীয় বংশোদ্ভূত এক ফরাসি নাগরিক। আলজেরিয়ায় জন্ম নেয়া জন ইউজিন কলেজ শেষে ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। তার বাবা ও ভাইও ছিলেন সেনাবাহিনীতে। এই জীবন তার ভালো লাগেনি। ইয়েমেনে ফ্রান্সের এক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডে পোস্টিং হয়েছিল তার। চিন্তা ভাবনায় তখন খানিকটা মারমুখো ছিলেন তিনি। কেউ কেউ বলেন ১৯৭১ এর মার্চে সেনাবাহিনী থেকে ফিরে আসার আগেই বিশিষ্ট ফ্রান্স দার্শনিক আন্দ্রে মার্লো দ্বারা দারুণ প্রভাবিত হয়েছিলেন জন ইউজিন পল।

সেদিন জ্যঁ ক্যর হাতে ছিল কেবল একটি বাদামি রঙের ব্রিফকেস। বিমানটি রানওয়েতে চাকা গড়াতে শুরু করলেই তিনি নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। নাইন এমএম পিস্তল বের করে তিনি সোজা ককপিটে ঢুকে পড়েন। তাঁর হাতে থাকা ব্যাগের ভেতর থেকে বেরিয়ে ছিল বৈদ্যুতিক তার, যা দেখিয়ে তিনি হুমকি দেনদাবি না মানলে পুরো বিমানটিই উড়িয়ে দেওয়া হবে।

বিমান থামাতে বাধ্য হন পাইলট। জ্যঁ ক্যা নির্দেশ দেন পাইলটকে বিমানের ফুয়েল ট্যাংক কানায় কানায় পূর্ণ করতে। সাধারণত বিমান ছিনতাইকারীরা মুক্তিপণ বা রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি চায়। কিন্তু জাঁ ক্যাএর দাবি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।

ছিনতাইয়ের ১০ মিনিট পর জ্যঁ ক্যা রেডিওর মাধ্যমে প্রথম বার্তা পাঠান এটিসিতে। নিজেকে পরিচয় দেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থক হিসেবে। জানান, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শিশু ও শরণার্থীদের জন্য বিমানের সমপরিমাণ অর্থ ও ২০ টন ওষুধ ও ত্রাণ সামগ্রী দিতে হবে, অন্যথায় বিমানসহ সব আরোহীকে ব্রিফকেসে থাকা বোমা দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হবে।

কিছুক্ষণ পর অবশ্য অর্থের দাবি থেকে সরে আসেন। দুপুর ১২টা ১৪ মিনিটে জ্যঁ ক্যা ককপিটের জানালা দিয়ে একটি চিরকুট পাঠান। আল্টিমেটাম দেনদুই ঘণ্টার মধ্যে ২০ টন ওষুধ (ভ্যাকসিন, ভিটামিন ও অ্যাম্ফিটামিন) বিমানের পেছনের অংশে লোড করতে হবে। প্যারিসের এসোন ডিপার্টমেন্টের প্রিফেক্ট মিশেল অরিয়াক এবং বিমানবন্দর পরিচালক গিলবার্ট ড্রেইফাস দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছান। ফরাসি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কঠোর নির্দেশ আসেকোনোভাবেই যেন রক্তপাত না ঘটে।

মেনে নেয়া হয় জ্যঁএর দাবি। তবে কর্তৃপক্ষ সময়ক্ষেপণের কৌশল নেয়। তারা জ্যঁ ক্যাকে জানায়, ফ্রান্স সরকার এবং অর্ডার অব মাল্টার সৌজন্যে ওষুধের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, তবে তা পৌঁছাতে বিকেল সাড়ে ৪টা বেজে যাবে। এরই মধ্যে কৌশলে রেডক্রসের সহায়তায় বিমানের অসুস্থ, শিশু ও বয়স্ক যাত্রীদের নামিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়।

বাইরে যখন ওষুধের ট্রাক আসার অপেক্ষা, তখন আড়ালে চলছিল পুলিশের শ্বাসরুদ্ধকর প্রস্তুতি। এয়ার ফ্রান্সের পার্কিং জোনে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য একটি বোয়িং বিমানে মহড়া দিচ্ছিল পুলিশ। তাদের পরিকল্পনা ছিল বিমানের ‘নোজ গিয়ার’ বা সামনের চাকার সঙ্গে থাকা গোপন ‘ট্র্যাপ ডোর’ দিয়ে ককপিটে প্রবেশ করা। সাধারণ যাত্রীবাহী বিমানে এই পথটি লাগেজ হোল্ড হয়ে কেবিনের সঙ্গে যুক্ত থাকে।

ভার্সাই থেকে আসা পুলিশের বিশেষ দল এবং স্নাইপাররা চূড়ান্ত অভিযানের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে আসে চারপাশ। বিকেল ৫টা ১৬ মিনিটে ওষুধের একটি ছোট ট্রাক বিমানের পাশে এসে দাঁড়ায়। রেডক্রসের পতাকা হাতে দুজন লোক বিমানটির কাছে যান। ওষুধ লোড করার প্রক্রিয়াটি পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে ধীরগতিতে করতে থাকে।

৭টা ১৪ মিনিট। ওষুধের কার্টন লোড করার ভান করে রেডক্রসের জ্যাকেট ও আর্ম ব্যান্ড পরে চারজন ফরাসি পুলিশ কর্মী সেজে বিমানের পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকেন। ঠিক একই সময়ে এয়ার ফ্রান্সের টেকনিশিয়ান সেজে আরও দুজন পুলিশ ককপিটের গোপন দরজা (ট্র্যাপ ডোর) দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেন। রেডক্রসের ছদ্মবেশে থাকা পুলিশ সদস্য হঠাৎ জ্যঁ ক্যুয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। জ্যঁ ক্যাও পাল্টা গুলি চালান। তার পিস্তলের গুলি এক পুলিশ অফিসারের সোয়েটার ভেদ করে হাতে সামান্য আঘাত করে। অবসান ঘটে দীর্ঘ ৬ ঘণ্টার জিম্মি নাটকের। ৫ বছর সাজা হওয়ার কথা থাকলেও বিশেষ বিবেচনায় দুই বছর পরই মুক্তি পান জ্যঁ ক্যা। অবশ্য বিমান ছিনতাইয়ে ব্যর্থ হলেও নিজের দাবি আদায়ে সফল তিনি। রেডক্রসের কল্যাণে সেই ২০ টন ওষুধ আর ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে যায় বাংলাদেশের শরনার্থী শিবিরে। এমন একজন স্বাধীনতাকামী মানুষ ও সত্যি ঘটনাটা অবলম্বন করে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। নাম ‘জঁ ক্যা ১৯৭১’।

ছবির পরিচালক ফখরুল আরেফিন খান। মুক্তি পায় ২০২৩ সালে। ‘সবকটা জানালা খুলে দাওনা/ আমি গাইব গাইব বিজয়েরই গান/ ওরা আসবে চুপি চুপি/ যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সমর্থনে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে জাঁ ক্যাএর এই দুঃসাহসী পদক্ষেপ সেদিন বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিজয়ের হাসি
পরবর্তী নিবন্ধপ্রতিশ্রুতি নয়, কাজ দিয়ে প্রমাণ করতে চাই