প্রায় দেড় দশক পর ফতেয়াবাদবাসীর সমস্যার অবসান হতে যাচ্ছে। অবসান ঘটতে যাচ্ছে পতেঙ্গা এলাকার মানুষের দুর্গতিও। ‘ডেভেলপমেন্ট অব ফতেয়াবাদ নিউ টাউন’ এবং ‘বে ভিউ স্মার্ট সিটি’ নামে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) দুটি আবাসন প্রকল্পের জন্য আটকে থাকা ফতেয়াবাদ এবং পতেঙ্গা এলাকার কয়েক হাজার একর ভূমি উন্মুক্ত করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। এসব ভূমিতে আবাসন প্রকল্প করা যৌক্তিক বা অর্থনৈতিকভাবে ঠিক হবে কিনা তা খতিয়ে দেখে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য সিডিএ একটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটির রিপোর্টের পর উক্ত দুটি এলাকার ভূমির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আবাসন এলাকা করা হলেও যতটুকু জায়গা লাগবে তা রেখে বাকি ভূমি উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। তবে এসব ভূমিতে কী ধরনের অবকাঠামো গড়ে তোলা যাবে তার একটি গাইডলাইনও সিডিএ থেকে করে দেওয়া হবে।
সিডিএর বোর্ড মেম্বার মানজারে খোরশেদকে প্রধান করে বোর্ড মেম্বার এবং প্রকৌশলী ও পরিকল্পনাবিদদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি ইতোমধ্যে বৈঠক করেছে। অচিরেই এই কমিটি পুরোদমে কাজ শুরু করবে বলে কমিটির সদস্য সচিব উপ–প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ এবং মাস্টার প্ল্যান প্রকল্পের পরিচালক আবু ঈসা আনসারি জানিয়েছেন।
সূত্রে জানা যায়, নগরীর দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের ফতেয়াবাদ এলাকাটি শহর লাগোয়া চট্টগ্রাম সেনানিবাস এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে। ফতেয়াবাদ এলাকাকে উপশহর হিসেবে গড়ে তুলতে ২০০৭ সালে ‘ডেভেলপমেন্ট অব ফতেয়াবাদ নিউ টাউন’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয় সিডিএ। আবাসন প্রকল্পটির জন্য ওই সময় ৪ হাজার ৭শ একর জায়গা চিহ্নিত করা হয়। প্রকল্পটির প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু কার্যক্রম চললেও শেষ পর্যন্ত সেটি আলোর মুখ দেখেনি। এর মধ্যে সিডিএ ২০১৩ সালে ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান বা ড্যাপ প্রণয়ন করে। শহরের কোন এলাকায় কী হবে, কোথায় আবাসন এলাকা হবে, কোথায় শিল্পায়ন হবে, কোথায় জলাধার হবে, কোথায় ভবিষ্যতে রাস্তা হবে এসব বিষয়ের বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে ড্যাপে। ড্যাপে শিল্পাঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত জায়গায় কোনো আবাসিক ভবনের অনুমোদন দেওয়া হয় না। আবার আবাসিক এলাকায় শিল্পায়নের অনুমোদন নেই। পরিকল্পিত নগরায়নের সুবিধার জন্য প্রণীত ড্যাপে ফতেয়াবাদের আবাসন প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত এলাকার সাথে আরো ২ হাজার ৩শ একর বাড়িয়ে মোট ৭ হাজার একর ভূমি চিহ্নিত করা হয়। ২০১৩ সালে শুরু করে ২০১৮ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ সম্পন্ন করার কথা ছিল। কিন্তু সংশোধিত প্রকল্পটি গত ১০ বছরে আলোর মুখ দেখেনি।
প্রকল্পটি আলোর মুখ না দেখলেও এলাকার প্রায় দুই লাখ বাসিন্দা সমস্যায় পড়েছেন। তারা তাদের বাপ–দাদার ভিটায় ঘর বানাতে পারছেন না। পুরো এলাকায় কোনো প্ল্যান দেওয়া হচ্ছে না। অনেক মানুষ প্রয়োজনেও ঘর বড় করতে পারেননি। অনেকে মেয়ের বিয়ে দেওয়া, চিকিৎসা খরচ বা সন্তানের লেখাপড়া বা বিদেশ পাঠানোর টাকার জন্যও জমি বিক্রি করতে পারেননি। সিডিএর প্রকল্প নিয়ে দুর্ভোগে পড়া এলাকাবাসী নিজেরা একটি সংগঠন করে। ওই সংগঠনের ব্যানারে নেতাদের দুয়ারে দুয়ারে ঘোরাঘুরির পাশাপাশি সিডিএ কার্যালয়ে যাওয়া–আসা করতে করতে পায়ের জুতা ক্ষয় করেছেন। আন্দোলন করেছেন। কিন্তু তাদের দুর্ভোগের অবসান হয়নি।
সিডিএর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয় মন্তব্য করে স্থানীয়রা জানান, এলাকার ভূমির মৌজা ভ্যালু অনেক। এর তিন গুণ টাকা পরিশোধ করার পর ভূমি উন্নয়ন করে তাতে প্লট তৈরি করে প্রতি কাঠা জমি ৪০/৫০ লাখ টাকায় বরাদ্দ দিতে হবে। শহরের এত দূরে গিয়ে এত চড়া দামে কেউ প্লট কিনবে না। প্রকল্পটি ব্যর্থ হবে।
হাটহাজারী ভূমি অফিস থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, দক্ষিণ পাহাড়তলী মৌজায় ভিটা হিসেবে চিহ্নিত প্রতি শতকের মৌজা ভ্যালু ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৮৭০ টাকা। নাল জমির মৌজা ভ্যালু ৩ লাখ ৯৭ হাজার ১০১ টাকা। খিলা, বাগান, পাউন্ডি প্রতি শতক ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৬৭৪ টাকা। পুকুর, ডোবা এবং খাই ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৬৩২ টাকা। পাহাড় টিলা ৩৫ হাজার টাকা। এসব জায়গা সিডিএ হুকুম দখল করতে হলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে মূল্য পরিশোধ করতে হবে তিন গুণ। ভিটা হিসেবে চিহ্নিত জায়গাগুলো হুকুম দখল করতে হলে কাঠাপ্রতি মৌজা ভ্যালু ১৪ লাখ ৩১ হাজার ৪৫০ টাকার তিন গুণ ৪২ লাখ ৯৪ হাজার ৩৫০ টাকা শুধু ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রদান করতে হবে। পরবর্তীতে এই ভূমি উন্নয়ন এবং রাস্তাঘাট নির্মাণ করে সিডিএর পক্ষে কাঠাপ্রতি ৬০ লাখ টাকার কমে বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হবে না। নাল জমি কাঠাপ্রতি মূল্য ৬ লাখ ৬১ হাজার ৮৩৫ টাকার বিপরীতে হুকুম দখল করলে মূল্য পরিশোধ করতে হবে ১৯ লাখ ৮৫ হাজার ৫০৫ টাকা। এর সাথে উন্নয়ন খরচ যুক্ত করলে ৩০ লাখ টাকার কমে বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হবে না।
অপরদিকে পতেঙ্গায় সাগরপাড়ে বে ভিউ স্মার্ট সিটি নামে একটি আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিল সিডিএ। আউটার রিং রোডের পাশের বিস্তৃত এলাকা এই প্রকল্পের জন্য চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু প্রকল্পটিও আলোর মুখ দেখেনি।
প্রকল্প দুটি আলোর মুখ না দেখলেও ওই দুই এলাকার হাজার হাজার একর ভূমিতে সিডিএ কোনো প্ল্যান অনুমোদন করছে না। এতে করে স্থানীয় বাসিন্দাদের ভোগান্তি এবং দুর্ভোগ চরমে ওঠে। স্থানীয় বাসিন্দাদের পক্ষ থেকে দিনের পর দিন বিষয়টি নিয়ে নানা মহলে ধর্ণা দিলেও তাদের দুর্ভোগের অবসান হচ্ছিল না।
অবশেষে অনেক হিসেব–নিকেশের পর সিডিএ ফতেয়াবাদ এবং পতেঙ্গা এলাকার ভূমির ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। সিডিএর বোর্ড সদস্য মানজারে খোরশেদকে প্রধান করে ৮ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে বোর্ড সদস্য জেরিনা হোসাইন এবং স্থপতি ফারুক আহমেদ ছাড়াও সিডিএর প্রকৌশল বিভাগের চারজন প্রকৌশলীকে রাখা হয়েছে। কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন উপ–প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আবু ঈসা আনসারি। কমিটি একটি বৈঠক করে অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করেছে। কমিটির সদস্য সচিব জানান, অচিরেই এই কমিটি পুরোদমে কাজ শুরু করবে।
সিডিএ চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ নুরুল করিম বলেন, বহুদিন ধরে জায়গাগুলো আটকে আছে। মানুষ কিছু করতে পারছে না। আমরা জায়গাগুলো নিয়ে ফিজিবিলিটি স্টাডি করব। সেখানে আদৌ আবাসিক এলাকা করা যাবে কিনা, করলেও ঠিক কতটুকু জায়গা লাগবে তা নিশ্চিত করে বাকি জায়গা উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। তবে ওসব জায়গায় ইচ্ছেমাফিক কিছু করতে দেওয়া হবে না। সিডিএ থেকে একটি গাইডলাইন দেওয়া হবে। কোথায় আবাসিক এলাকা করা যাবে, কোথায় বাড়িঘর করা যাবে, কোথায় বাণিজ্যিক বা পর্যটন কেন্দ্রিক স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে, তার একটি গাইডলাইন সিডিএ দেবে। ওই গাইডলাইন অনুসরণ করে জায়গাগুলো ব্যবহার করতে হবে।
তিনি বলেন, পতেঙ্গা এলাকার জায়গার ব্যবহার নিয়ে আমরা বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথেও বৈঠক করব। বন্দরের এসব জায়গা ভবিষ্যতে লাগবে কিনা তাও আমরা জেনে নেব। আমরা একটি পরিকল্পিত নগরী গড়তে চাই। একইসাথে মানুষের দুর্ভোগও কমাতে চাই। ভূমির সুষ্ঠু এবং সর্বোচ্চ ব্যবহারও নিশ্চিত করতে চাই। সবকিছু মিলে চট্টগ্রামকে সবার বাসযোগ্য একটি সুন্দর শহরে পরিণত করতে চাই। এ লক্ষ্য অর্জনে সবাই কাজ করছেন।