প্লাস্টিক : প্রয়োজন, ভয়াবহতা ও বিকল্প ভাবনা

সৈয়দ জিয়াউদ্দীন | সোমবার , ১১ আগস্ট, ২০২৫ at ৬:১৬ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বের উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে বিভিন্ন প্রযুক্তিপণ্য ও সহজলভ্য উপকরণের ব্যবহার। ঠিক এভাবেই, আমাদের দেশে এক সময়ের নিত্যপ্রয়োজনীয় মাটির তৈরি তৈজসপত্রের জায়গায় সামর্থ্য, রুচি বা সবমিলিয়ে সঙ্গত কারণে অ্যালুমিনিয়াম, চিনামাটি ও কাঁচের তৈরি তৈজসপত্রের ব্যবহার প্রতিষ্ঠিত হয়। বাঙালির ঐতিহ্যের মৃৎশিল্পের সংস্কৃতিতে এটি বিকল্প এবং নতুন সংযোজন হিসেবে বলা যেতে পারে। সময়ের ক্রমধারায় দেশ ও দেশের বাইরে অর্থাৎ উন্নত বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের ফলে দ্রুত দেশীয় কৃষ্টিসংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। যেমন মাটির তৈরি হাঁড়ি পাতিল কলসির জায়গা দখল করে নেয় অ্যালুমিনিয়াম আর সানকি বাটির জায়গা নেয় চিনামাটি ও উন্নতমানের কাচের তৈরি তৈজসপত্র। ফ্রান্স, ইউরোপ বা আমেরিকার একটি ডিনার সেট, কফি বা টিসেট হয়ে দাঁড়ায় পরিবারের মর্যাদার প্রতীক। ফলে বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প ক্রমান্বয়ে যাদুঘরের অ্যানটিক্সে পরিণত হয়। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। সভ্যতা ও আধুনিকতার ক্রমবর্ধমান ধারায় কাচের তৈরি দামি তৈজসও শোকেসের কাচের পেছনে শোভাবর্ধনের আইটেমে পরিণত হয়। আর আবারও সঙ্গত কারণে তার জায়গা দখল করে নেয় বিভিন্ন জাতপাতের প্লাস্টিকের নিত্যপ্রয়োজনীয় তৈজসপত্র।

ব্যবহারিক পণ্য সস্তা বা স্বল্পমূল্যে সহজলভ্য হলে তা নিঃসন্দেহে জনপ্রিয় হওয়াটা স্বাভাবিক। তেমনই এক উপাদান হলো প্লাস্টিক। এটি যেমন জীবনযাত্রাকে সহজ করেছে তেমনই পরিবেশের ওপর ফেলেছে নেতিবাচক প্রভাব। প্লাস্টিক বর্তমানে প্রয়োজনীয় পণ্যের চেয়েও মারাত্মক একটি বৈশ্বিক সমস্যা যা জল, স্থল ও বায়ুর পরিবেশকে দূষিত করে আমাদের অস্তিত্বের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্লাস্টিক পেট্রোলিয়ামজাত রাসায়নিক উপাদান থেকে তৈরি এবং তার অস্তিত্ব মাইক্রোপ্লাষ্টিক রূপে বহু শতাব্দী পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। তথাপি শুধুমাত্র মূল্য ও সহজলভ্যতার কারণেই বাজারের ব্যাগ, পানির বোতল, প্যাকেটজাত খাবার, খেলনা, ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ, পানি সহ তরল প্রবাহী পাইপ ফিটিংস, এমনকি মেডিকেল পণ্য পর্যন্ত সর্বত্রই আজ এই বিধ্বংসী প্লাস্টিকের ছড়াছড়ি।

বিশেষ করে এককালীন ব্যবহারের (ফরংঢ়ড়ংধনষব) সুবিধার কারণে ধীরে ধীরে এই প্লাস্টিক সরঞ্জামের ব্যবহার সর্বক্ষেত্রে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। ঘরোয়া অতিথি আপ্যায়ন থেকে শুরু করে মাঝারি ধরনের খাওয়াদাওয়ার সমাগমে প্লাস্টিক প্লেট গ্লাসের ব্যবহার এখন অতি সাধারণ ব্যাপার। এমনকি বাঙালি আভিজাত্যের দৈনন্দিন ব্যবহারের সরঞ্জাম বেতের তৈরি শীতল পাটির স্থলাভিষিক্ত হয়েছে প্লাস্টিক ম্যাট, ঝুড়ি সেলফ ইত্যাদি। অবশ্য এর পেছনে অন্যতম যৌক্তিক কারণটি হলো গৃহস্থালি কাজে প্রয়োজনীয় কর্মোদ্যম ঘরের মানুষ ও গৃহকর্মীর অভাব। চড়া পারিশ্রমিকেও সময়মতো দুষ্প্রাপ্য গৃহকর্মীর সংকট এই এককালীন পণ্যের ব্যবহার অনেকটাই নিয়ম সিদ্ধ করে তুলেছে। কিন্তু দেখার বিষয় হলো কাঁচ মাটি বা ধাতব সামগ্রির বিকল্প হিসেবে এই প্লাস্টিক জায়গা করে নিলেও তার বিকল্প হিসেবে অন্য কিছু এখনো বা সহসা চোখে পড়ছে না। প্লাস্টিক অপচ্য পদার্থ ও এককালীন ব্যবহারের কারণে এর বর্জ্য এবং তার ভয়ংকর ধ্বংসাত্মক রূপটি নাগরিক জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ও দীর্ঘমেয়াদী হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে আকাশ থেকে পাতাল কোন জায়গাই প্লাস্টিকমুক্ত নয়।

বিভিন্ন জরিপ ও গবেষণায় প্লাস্টিক বর্জ্যের হিসাব এখন বিলিয়ন টনের ব্যাপার। পর্যবেক্ষণ মতে আট মিলিয়ন টনেরও অধিক প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে বিভিন্নভাবে ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে এবং সমপরিমাণ বর্জ্য প্রতিবছর নতুন করে যোগ হচ্ছে। সংশ্লিষ্টজন ও পরিবেশবিদদের শঙ্কা প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশ, জীববৈচিত্য ও মানব সভ্যতা ধ্বংসের পাশাপাশি অদূর ভবিষ্যতে অনেকটা আনবিক বোমার মতো অস্তিত্ব সঙ্কটের মারাত্নক ঝুঁকি হয়ে দেখা দিতে পারে। সমপ্রতি এক ডকুমেন্টারিতে দেখা গেছে প্রশান্ত মহাসাগরের সবচেয়ে গভীরতম স্থান হিসেবে পরিচিত মারিয়ানা ট্রেঞ্চ যার গভীরতা প্রায় ১১ কিমি, সেখানেও প্লাস্টিক সামগ্রী পাওয়া গেছে। পাশাপাশি সেখানকার মাটি ও প্রাণীর দেহে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি ধরা পড়েছে। গবেষণার নিরিখে জানা যায়, প্রায় চারশ থেকে এক হাজার বছরেও প্লাস্টিক ধ্বংস হয় না। ফলে বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়া মোকাবিলা করেও এটি মাইক্রোপ্লাস্টিক রূপে সক্রিয় থাকে যার অস্তিত্ব শুধু জলজ প্রাণী নয় মানবদেহেও পাওয়া গেছে। আজকাল প্লাস্টিকের চাল আবিষ্কারের কথাও শোনা যায়!

প্লাস্টিকের যাত্রা শুরু হয় প্রায় ১৯০৭ সালের দিকে এবং তখন থেকেই এটি শিল্পবিপ্লবের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। বহুল ব্যবহারের কারণে চলতি বছরের মধ্যে বিশ্বে প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন টনের বেশি প্লাস্টিক উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এর একটি বিশাল অংশ ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া হয় যা বিধ্বংসী বৈর্জ্যরূপে পরিবেশে থেকে যায়। বিশ্বব্যাপী এই সমস্যার সমাধানে বিজ্ঞানীদের নিরলস গবেষণা ও বিকল্প প্রক্রিয়া আজো তেমন উৎসাহব্যঞ্জক ভূমিকা রাখতে পারেনি। গত ২০০৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কোভিড১৯ মহামারিকালে ফরংঢ়ড়ংধনষব প্লাস্টিকের ব্যবহার ও বর্জ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এসব প্লাস্টিক বর্জ্যের পুনর্ব্যবহারের অনুপাতে ঘাটতি ও ৩ জ পদ্বতি (জবফঁপব, জবঁংব, জবপুপষব) কৌশলের সঠিক প্রয়োগের অভাবে এই বর্জ্য সংকট মোকাবিলা সম্ভব হচ্ছে না।

প্রথমত, বাংলাদেশ একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর ক্ষুদ্রতম দেশ। সুতরাং, দৈনন্দিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পর্যাপ্ত জায়গা এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির ঘাটতির বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। ব্যবহার হ্রাস, ব্যবহারের বিধিমালা নিয়ন্ত্রণ ও পুনঃব্যবহারের বিষয়টির পাশাপাশি প্লাস্টিকের বিকল্পের বিষয়টি আমলে নেওয়া দরকার। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে ঢাকায় বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার বর্তমানে সোয়া বাইশ কেজি। ঢাকায় প্রতিদিন প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ প্রায় ৬৪৬ টন যা দেশের মোট বর্জ্যের ১০ শতাংশ। ইউরোপের দেশগুলোতে মাথাপিছু গড় প্লাস্টিক ব্যবহার ১০০ কেজিরও বেশি। অথচ ঢাকার উৎপাদিত প্লাস্টিক বর্জ্যের মাত্র ৩৫ শতাংশ পুনঃব্যবহার বা অন্য কাজে লাগানো হয়। তারপরও প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনার ফলে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষ প্লাস্টিকদূষিত দেশগুলোর অন্যতম। দেশে প্রতিদিন প্রায় তিনহাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৫০ সালে বিশ্বে প্লাস্টিক উৎপাদন ছিল মাত্র দেড় মিলিয়ন টন যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৪০০ মিলিয়ন টন এবং ২০৫০ সাল নাগাদ তা ৮০০ মিলিয়ন টনে গিয়ে দাঁড়াবে।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ডলারের প্লাস্টিক পণ্যের বাজার রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের রপ্তানি মাত্র ১.২ বিলিয়ন ডলার যা থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামের তুলনায় অনেক কম। এছাড়া বাংলাদেশে প্লাস্টিকের অভ্যন্তরীণ বাজার প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। সুতরাং, বিদেশে রপ্তানি ও দেশীয় চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ প্রতিবছর বাইশ লাখ টন প্লাস্টিকের কাঁচামাল আমদানি করে যা প্রায় পাঁচ হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যোগান দেওয়া হয়। বাংলাদেশের প্লাস্টিক প্যাকেজিং শিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত যেখানে বিশ শতাংশ নারীসহ প্রায় পনের লাখ মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে এবং এখান থেকে সরকার সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব আয় করে। সবমিলিয়ে, প্লাস্টিক একটি অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ খাত হলেও এর বৈশ্বিক বিরূপ প্রভাবের ভয়াবহতা অনস্বীকারযোগ্য।

যেহেতু প্রতিদিনই প্লাস্টিক বর্জ্যের স্তূপ বেড়ে চলেছে সুতারাং দেশীয় সমস্যার পাশাপাশি বৈশ্বিক জলবায়ু সমস্যার মতোই প্লাস্টিক ব্যবহারের ভয়াবহতার বিষয়টিকেও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা প্রয়োজন। অর্থাৎ টেকসই বিকল্প ব্যবস্থার মাধ্যমে অস্তিত্বের জন্য হুমকি এই প্লাস্টিক সমস্যার সমাধানের পথ উদ্ভাবন এখন সময়ের দাবী। এই ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ৩জ ব্যবস্থাপনার যথাযথ প্রয়োগ এবং পাটের তৈরি পণ্যের ব্যবহার প্লাস্টিকের কার্যকর বিকল্প হতে পারে। সোনালীআঁশ খ্যাত পাট আমাদের অন্যতম প্রধান ফসল এবং পাটের তৈরি সহজে দ্রাব্য ও পচনশীল পণ্যের উৎপাদন ও ব্যবহার প্লাস্টিক দূষণ হ্রাস করতে পারে। পরিবেশবান্ধব এই পাটের তৈরী পণ্য দেশের চাহিদা পূরণ করে বিশ্ববাজারে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রায় ১৮০টির মতো পাটকল উৎপাদনশীল আছে। আরো প্রায় অর্ধেকের মতো পাটকল বিভিন্ন কারণে বন্ধ আছে। পাট উৎপাদনের পরিমাণও বর্তমানে আশাব্যঞ্জক। পাট চাষের সাথে প্রায় ৪০/৫০ লাখ কৃষকের জীবিকা সম্পৃক্ত। প্রতিবছর প্রায় চুরাশী লাখ বেল বা দেড় মিলিয়ন টন পাট উৎপন্ন হয়। পাট ও পাটজাত পণ্যের অবদান দেশের জিডিপিতে দেড় শতাংশ ও কৃষিজ জিডিপিতে ছাব্বিশ শতাংশের মতো। সুতরাং দেশীয় বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে প্লাস্টিকের কার্যকর বিকল্প হিসেবে সরকারি উদ্যোগ, গবেষণা, আইনগত বাধ্যবাধকতা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পাটজাত পণ্যের বহুল ব্যবহার নিশ্চিত করার এখনই সময়। বিষয়টির গুরুত্ব ও বিকল্প ব্যাবস্থা যথাযথভাবে মূল্যায়িত হলে দেশে প্লাস্টিকের ভয়াবহতা হ্রাস পাবে এবং বিশ্বব্যাপি সোনালী আঁশের গৌরবও সমুন্নত থাকবে।

লেখক: কবি, শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভেজাল খাদ্য, ভেজাল ওষুধ ও অনিয়মিত জীবন যাপনে রোগ সৃষ্টি
পরবর্তী নিবন্ধঅধ্যক্ষ রওশন আখতার হানিফ : অনন্য যিনি