ঘরে ফিরছেন ২৩ নাবিক। প্রিয়জনকে ফিরে পাওয়ার দিন আজ। তাই ২৩ নাবিকের পরিবার এবং তাদের স্বজনদের ঘরে উৎসবের আমেজ শুরু হয়েছে। নানা আয়োজনে নাবিকদের বরণ করতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন তারা। সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়াসহ শ্বাসরুদ্ধকর ৬৪ দিনের যাত্রা শেষ করে আজ মঙ্গলবার বিকালে ঘরে পৌঁছাবেন নাবিকেরা।
চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান কেএসআরএমের মালিকানাধীন বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিকই বাংলাদেশের। চট্টগ্রামসহ দেশের নানা অঞ্চলে তাদের বাড়ি। চরম অনিশ্চয়তার দীর্ঘ যাত্রা শেষে আজ বিকাল ৪টায় নাবিকেরা পৌঁছাবেন চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনালের (এনসিটি) এক নম্বর জেটিতে। ওখানেই তাদের বরণ করা হবে। এরপর ঘরে ফিরতে শুরু করবেন তারা। এসব নাবিক কারো বাবা, কারো ভাই। কারো আদরের সন্তান, প্রিয়তম স্বামী। আর সকলেই অধীর আগ্রহে তাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। তাদের দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হতে যাচ্ছে আজ।
দীর্ঘ সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে দুবাই থেকে গতকাল সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরের কুতুবদিয়ায় নোঙর করেছে এমভি আবদুল্লাহ। জাহাজটিতে নতুন নাবিক পাঠানো হয়েছে। গতকাল একটি লাইটারেজ জাহাজে চড়ে নতুন নাবিকদের একটি দল জাহাজটির দায়িত্ব বুঝে নেবে। নতুন নাবিকেরা দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর জিম্মি দশা থেকে মুক্ত হওয়া ২৩ নাবিককে আনা হবে এনসিটি–১ জেটিতে। কেএসআরএম শিল্প গ্রুপের লাইটারেজ জাহাজ এমভি জাহান মনি–৩ যোগে তারা এনসিটিতে পৌঁছাবেন। সেখানে তাদের বরণ করা হবে। নাবিকদের বরণের জন্য আত্মীয়স্বজনদের সেখানে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নাবিকদের সংবর্ধনা প্রদান করবে বলে বন্দর সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক জানিয়েছেন।
জাহাজটির মালিক প্রতিষ্ঠান কেএসআরএমের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানে বরণের পর নাবিকেরা ঘরে ফিরতে শুরু করবেন। চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ সারা দেশে তাদের পাঠানোর ব্যবস্থাও কোম্পানির পক্ষ থেকে করা হচ্ছে। বরণ অনুষ্ঠানের পরপরই নাবিকেরা ঘরে ফিরবেন।
নাবিকদের ঘরে ফেরার আনন্দে বিভোর পরিবার–পরিজন। ঘরে ঘরে বিরাজ করছে ঈদের আনন্দ। বিগত ঈদে যাদের পরিবারে ছিল শোকের মাতম তারা ঈদের এক মাসের বেশি সময় পর উৎসবের আয়োজনে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
গতকাল এমভি আবদুল্লাহর ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদের স্ত্রী ফাহমিদা আকতার এ্যানি আজাদীকে বলেন, কী যে ভালো লাগছে বোঝাতে পারব না। আমার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একমাত্র মেয়ে বাবার জন্য নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। সে তার বাবাকে ফিরে পেতে যাচ্ছে–এই আনন্দে বিভোর। স্বামীর প্রিয় সব খাবার আজ রান্না করবেন বলে জানান তিনি।
জাহাজটির চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খানের বাসা নগরীর নন্দনকাননে। তার ভাই সিএ অধ্যয়নরত মোহাম্মদ আরিফ জানান, তার মা, ভাবী এবং তিন ভাইঝি পুরো সংসারটিকে উৎসবে ভরিয়ে দিয়েছেন। ঘরে রান্নাবান্না শুরু হয়েছে। ভাইয়ের পছন্দের গরুর মাংস ভুনা, চিংড়ি মাছের কারি, পুঁটি মাছ সবই রান্না করা শুরু হয়েছে। সেমাই রান্না করা হবে ভাইসহ পরিবারের সবার জন্য। গত ঈদে তারা সেমাই খাননি বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ভাইকে ফিরে পাচ্ছি–এটাই আমাদের অনেক বড় উৎসব।
ইয়াসরা ফাতেমা, উনাইজা মাহরীন ও খাদিজা আরাবিয়া নামে তিন কন্যা সন্তান রয়েছে আতিকুল্লাহ খানের। স্বামী ফিরছেন এই আনন্দে আতিকুল্লাহর স্ত্রী ফিরোজা আকতারও খুব খুশি।
নাবিক নুর উদ্দীনের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস আড়াই বছরের ছেলেসহ বসবাস করেন নগরীর কর্ণফুলী থানা এলাকায়। উচ্ছ্বসিত জান্নাতুল গতকাল আজাদীকে বলেন, গরুর মাংস, দেশি মুরগি থেকে শুরু করে ওর পছন্দের সব খাবারই রান্না করছি। এখনো আমি রান্নাঘরে। কালও রান্না করব। তিনি বলেন, ও কেক পছন্দ করে, চকলেট কেক। আমি নিজেই তার জন্য কেক বানাচ্ছি। আমার শাশুড়িও ছেলের জন্য রান্নাবান্না করছেন। আমার দুজন ভাসুর আছেন। সবাই অধীর আগ্রহে সময় পার করছি।
জাহাজটির থার্ড ইঞ্জিনিয়ার রোকন উদ্দিনের বাড়ি নেত্রকোনা। গতকাল তার ভাই সাইদুল ইসলাম বলেন, আমরা সবাই অনেক খুশি। এই খুশি কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। আমরা সবাই পথের দিকে চেয়ে আছি। ভাই কখন নেত্রকোনা পৌঁছাবে, তাকে একটু বুকে জড়িয়ে ধরার জন্য। তিনি বলেন, মাত্র সাতদিন আগেই আমার ভাইয়ের একটি কন্যা সন্তান হয়েছে। ভাই ঘরে ফিরে তার প্রথম সন্তানের মুখ দেখবে। এটিও আমাদের পরিবারে বড় আনন্দের বিষয়।
আনোয়ারায় দুই নাবিকের পরিবারে ঈদের খুশি
আনোয়ারা প্রতিনিধি এম নুরুল ইসলাম জানান, এমভি আবদুল্লাহর দুই নাবিকের বাড়ি আনোয়ারায়। আনোয়ারার দুই নাবিক শামসুদ্দিন শিমুল ও মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেনের পরিবারে এখন ঈদের আনন্দ বিরাজ করছে। দুই পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, তারা ক্ষণ গণনা শুরু করেছেন। একেকটি মিনিট অনেক দীর্ঘ মনে হচ্ছে। তাদের প্রতীক্ষা যেন ফুরাচ্ছে না।
নাবিক শামসুদ্দিন শিমুলের মা শাকেরা বেগম (৫৫), স্ত্রী রিমা আকতার (২৬), তিন কন্যা রামিছা (১০), সাইদা (৭) ও সূরার (৩) শিমুলের জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুণছে। শিমুলের মা শাকেরা বেগম বলেন, মহান আল্লাহর কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া, আমার শিমুল আজ আমাদের মাঝে ফিরবে। আমি আল্লাহর কাছে আমার ছেলের জন্য কত কেঁদেছি! আল্লাহ আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এর চেয়ে বড় আনন্দ কী হতে পারে?
শিমুলের স্ত্রী রিমা আকতার বলেন, স্বামীর জন্য নফল রোজা রেখেছি। আল্লাহর কাছে ভিক্ষা চেয়েছি। মহান আল্লাহ আমার তিন মেয়ের ওসিলায় তাকে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
তিনি কন্যা বলল, বাবার জন্য দিন–রাত কেঁদেছি। বাবাকে দেখার অপেক্ষায় আছি।
নাবিক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেনের বাবা মো. গাজু মিয়া, মা শমশেদ বেগম ও তার চার ভাই শাহাদাতের ফেরার আনন্দে বিভোর। শমশেদ বেগম বলেন, আমার ছেলে এলে আমরা পুরো পরিবার ঈদের খুশি উদযাপন করব ইনশাল্লাহ। এবার আমাদের পরিবারে ঈদ হয়নি। আমার ছেলে ফিরে আসবে–এটাই আমাদের মহা খুশি। ঈদের চেয়ে আরো বেশি আনন্দ।
পিতা মো. গাজু মিয়া বলেন, নামাজ পড়ে ছেলেকে ফিরে পেতে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি। আল্লাহ সহায় হয়েছে।
৬৪ দিনের সমুদ্রযাত্রা
শুধু এই ক’জন নাবিক নন, ২৩ নাবিকের ঘরে উৎসবের আমেজ চলছে। সবার স্বজনরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন তাদের জন্য। যাদের অভাবে ২৩ সংসারে নেমে এসেছিল অন্ধকার। এই অন্ধকারের শুরু হয়েছিল গত ১২ মার্চ। ওইদিন ভারত মহাসাগরের প্রায় ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূর থেকে জাহাজটিকে ২৩ নাবিকসহ জিম্মি করে সোমালিয়া উপকূলে নিয়ে গিয়েছিল সোমালিয়ার জলদস্যুরা। জাহাজটি ৪ মার্চ আফ্রিকার মোজাম্বিকের মাপুতো বন্দর থেকে ৫৬ হাজার টন কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত যাওয়ার পথে ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে পড়ে। এরপর থেকেই নাবিকদের পরিবারে সব আনন্দ চলে গিয়েছিল। এমনকি গত ঈদেও পরিবারগুলোতে আনন্দ ছিল না।
জিম্মি দশায় জাহাজটিতে নাবিকদের নানাভাবে মানসিক নির্যাতন করা হয়। ফোন করতে দেওয়া হতো না। পরিবারের সাথে যোগাযোগ ছিল না দিনের পর দিন। কথায় কথায় অস্ত্র তাক করা এবং খাবার ও পানির সংকটসহ নানাভাবে কষ্ট সয়ে দিন পার করছিলেন নাবিকেরা। আর তাদের দুর্দশার খবর যতই আসছিল নাবিকদের স্বজনেরা ততই ভেঙে পড়ছিলেন। নাবিকদের ফিরে পাওয়ার আশাও ছেড়ে দিয়েছিলেন কেউ কেউ। কখন যে তারা কাকে গুলি করে মারে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং শ্বাসরুদ্ধকর সময় পার করছিলেন নাবিক এবং তাদের পরিবার পরিজন।
এমভি আবদুল্লাহর মালিকপক্ষ বরাবরই আশাবাদী ছিলেন। তারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ভারতীয় নৌবাহিনীর কমান্ডো অভিযানের বিরোধিতা করে বলেছিলেন, কোনো রক্তের বিনিময়ে তারা জাহাজ ফেরত চান না। আলাপ–আলোচনা এবং দস্যুদের সন্তুষ্ট করেই তারা সবাইকে নিরাপদে দেশে ফেরাতে চান। অবশেষে বীমা কোম্পানিসহ মধ্যস্থতাকারীদের সহায়তায় বিপুল অর্থের মুক্তিপণ দিয়ে ৩৩ দিনের মাথায় নাবিকদের মুক্ত করা হয়। মুক্তিপণ বুঝে পাওয়ার পর ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় দিবাগত রাত ৩টা ৮ মিনিটে জাহাজ থেকে দস্যুরা নেমে যায়।
দস্যুরা নেমে যাওয়ার পরপরই জাহাজটি দুবাইয়ের আল হামরিয়া বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। ইউরোপীয় নেভাল ফোর্সের অপারেশন আটলান্টার কমান্ডোরা জাহাজটিকে পাহারা দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল পার করে দেয়। গত ২১ এপ্রিল এমভি আবদুল্লাহ নিরাপদে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরে নোঙর করে। ওখানে ৫৬ হাজার টন কয়লা খালাস করে জাহাজটি পাশের এমভি মিনা সাকার বন্দরে যায়। সেখানে ৫৫ হাজার টন চুনা পাথর বোঝাই করার পর জাহাজটি আরব আমিরাতের ফুজাইরা বন্দরে গিয়ে জ্বালানি তেল সংগ্রহ করে। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে জাহাজটি ৩০ এপ্রিল দুবাই থেকে চট্টগ্রামের পথে যাত্রা করে। গতকাল সন্ধ্যায় জাহাজটি কুতুবদিয়ায় নোঙর করে। এর মাধ্যমে সম্পন্ন হয় জাহাজটির ৬৪ দিনের সমুদ্রযাত্রা।
জাহাজের ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ জানান, জাহাজটি গতকাল সন্ধ্যায় কুতুবদিয়ায় নোঙর করেছে। নাবিকদের সকলে সুস্থ এবং ভালো আছেন। অবশ্য কেএসআরএমের একটি সূত্র জানিয়েছে, জিম্মি দশার দুর্ভোগ এবং ট্রমা কাটাতে ২৩ নাবিক দীর্ঘমেয়াদে ছুটিতে যেতে পারেন।
এমভি আবদুল্লাহর আগের নাম ছিল এমভি গোল্ডেন হক। ২০১৬ সালে কেএসআরএমের বহরে যুক্ত হওয়ার পর জাহাজটির নতুন নামকরণ করা হয়। খোলা পণ্য পরিবহনকারী জাহাজটি দৈর্ঘ্য ১৮৯ দশমিক ৯৩ মিটার এবং প্রস্থ ৩২ দশমিক ২৬ মিটার। জাহাজটি প্রায় ৬০ হাজার টন খোলা পণ্য পরিবহন করতে পারে। কেএসআরএমের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের বহরে মোট ২৩টি জাহাজ রয়েছে। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে এই কোম্পানির এমভি জাহান মনি জাহাজটি ২৫ জন নাবিকসহ আরব সাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল। ওই সময় জাহাজের ২৫ নাবিক এবং প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রীকে জিম্মি করে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায় করেছিল দস্যুরা। জাহাজটি মুক্ত করতে ১০০ দিন সময় লেগেছিল।