প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের অবদান

জাহান আখতার হোসাইন | মঙ্গলবার , ১৯ জানুয়ারি, ২০২১ at ১০:৪৭ পূর্বাহ্ণ

শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর অন্যতম। একটি শিশুর জন্মের পর চার পাঁচ বছর অতিক্রম না হতেই পিতা মাতা তথা অভিভাবকগণ ভাবনায় পড়ে যান-সন্তানকে কোথায় ভর্তি করাবেন।
যেহেতু বাংলাদেশে বহু ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে; শিক্ষার গুণগত মান এবং নিজেদের আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় রেখে অভিভাবক তাঁর সন্তানের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পছন্দ করেন।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় দেশে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেসরকারি কিন্ডার গার্টেন স্কুলের সংখ্যা এবং মান দুটোই যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় রাখা হয়। কিন্ডারগার্টেন বা কে.জি. স্কুল এখন আর বিলাসিতা নয় বরং বলা চলে অভিভাবকদের আস্থার স্থল।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। সদ্য-স্বাধীন একটি দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সাথে তাল মিলিয়ে আশির দশক থেকে কে.জি স্কুল প্রতিষ্ঠার হিড়িক পড়ে যায়। সরকারি ভাবে তখন ৬ বছর বয়সী শিশুর প্রথম স্কুল যাত্রার প্রচলন ছিল। এই দশকেই প্রথম বাংলাদেশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ধারণা প্রবর্তিত হয় এবং প্লে-গ্রুপ, নার্সারি পর্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষার সম্প্রসারণ ঘটে। দেশের প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তারে এসব স্কুলের অবদান অনস্বীকার্য।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার জনপ্রিয়তার কারণে ২০১০ সালে সীমিত আকারে এবং ২০১৪ সালে প্রায় সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক বছর মেয়াদী প্রাক-প্রাথমিক চালুর সরকারি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সরকারি প্রাথমিক ব্যবস্থা চালু আছে। কিন্তু দেশের যে সকল এলাকায় (শহরে ও গ্রামে গঞ্জে) কিন্ডারগার্টেন স্কুলের অস্তিত্ব বর্তমান সেখানকার অভিভাবকগণ সরকারি স্কুলের পরিবর্তে কে.জি. স্কুলকে প্রাধান্য দেন। এর কারণ হিসেবে জনমত জরিপে দেখা গেছে সরকারি স্কুলের শিক্ষার গুণগত মান, স্কুলের অব্যবস্থাপনা, শিক্ষক-কর্মচারীদের নিম্নমান অভিভাবকদের শংকিত করে।
অনেকে মনে করেন কোন রকম সরকারি সাহায্য ব্যতীত গড়ে তোলা এসকল স্কুলের অধিকাংশ যেহেতু অবসরপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে তাঁরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য, অভিভাবক আকৃষ্ট করার জন্য, ছাত্র ছাত্রীদের ধরে রাখার উদ্দেশ্যে নতুন নতুন কৌশল ও প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করতে থাকেন। তছাড়া এসকল স্কুলে কর্মরত শিক্ষকগণ তাদের জীবিকার তাগিদে মন প্রাণ উজাড় করে দিয়ে সততা ও আন্তরিকতার সাথে পাঠদান করেন। অন্যদিকে অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগ সরকারি স্কুলে জবাবদিহিতার অভাবে কোন প্রকার কার্যক্রম পরিচালিত হয়না, পাঠদানও মানসম্মত নয়।
২০১৬ সালে জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে (পরিসংখ্যান) জানা যায় বাংলাদেশে মোট কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সংখ্যা প্রায় ৬৫ হাজার যা বর্তমানে এক লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। এসব স্কুলে যদি গড়ে ১০০ জন করেও ছাত্র ছাত্রী থাকে তাহলে দেশের কে.জি. স্কুলের ছাত্র সংখ্যা কোটির ঘরে।
জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ. কে.এম. শাহনেওয়াজের মতে এই স্কুল গুলোতে প্রায় ১৫ লক্ষ শিক্ষক-শিক্ষিকা কর্মরত আছেন। সেই সাথে যদি প্রতিটি স্কুলে ২-৩ জন করে আয়া-দারোয়ান-পিয়ন কর্মরত থাকে তাহলে আরো কমপক্ষে দুই থেকে আড়াই লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে এসব স্কুলে। উপরোল্লিখিত পরিসংখ্যান বিবেচনা করলে পাঠক মাত্রই কিন্ডারগার্টেন স্কুলের আবশ্যকতা উপলব্ধি করতে পারবেন।
করোনা সংক্রমণের কবলে পড়ে বর্তমানে দেশের অন্যান্য খাতের সাথে সাথে শিক্ষাখাতেও ধ্বংস নেমেছে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১৭ ই মার্চ থেকে শুরু করে অদ্যাবধি বন্ধ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে প্রায় একটি বছর নষ্ট হয়ে গেছে।
ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া সচল রাখার কথা বিবেচনা করে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান “অনলাইনে” পাঠদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে “অনলাইনে” পাঠদানের ব্যবস্থা গৃহীত হলেও বাস্তবতা হচ্ছে এ দেশের নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এর আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।
এই মহামারী আমাদের সকল খাতেই আঘাত হেনেছে, সরকার বিভিন্ন খাতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, দেশের শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে সহায়তাকারী, জনগণের কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে সরকারি সহায়তা নেই বললেই চলে। এ সকল স্কুলের অধিকাংশ ভাড়া করা বাড়িতে চলে, আবার ছাত্র ছাত্রীদের ‘টিউশন ফি’ এদের আয়ের একমাত্র উৎস। ফলে করোনাকালে ‘টিউশন ফি’ আদায়ে ব্যর্থতার কারণে বাড়ি ভাড়া অনাদায়ী রেখে ইতোমধ্যে অনেক স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
জীবন থেমে থাকে না, সকল দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠার জন্য মানুষ নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই এ বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে শিশুদের শুয়ে বসে বছরের পর বছর পার করে দেওয়া যাবে না। করোনা কখন নিঃশেষ হবে-সেই আশায় বসে থাকলে শিশুদের শিক্ষার ভিত তৈরিতে অনেক সময় অপচয় হবে। তাই বিবেকবান, সচেতন অভিভাবক গণ ‘অনলাইন’ শিক্ষাকে স্বাগত জানিয়ে অতীতে যেমন স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে যুক্ত ছিলেন তেমনি আগামীতে সংশ্লিষ্ট থাকবেন আশা করি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
লেখক : অধ্যক্ষ, চিটাগাং প্রিপারেটরী স্কুল, দামপাড়া, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅসামপ্রদায়িক চেতনার সমপ্রীতির বাংলাদেশ
পরবর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল