প্রাথমিক শিক্ষা করা জাতির অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য

জোনাকী দত্ত | রবিবার , ৮ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৭:১৮ পূর্বাহ্ণ

প্রত্যেক অভিভাবক চায় তার সন্তানকে একটি ভালো স্কুলে ভর্তি করাতে। কারণ আজকের শিশু আগামী দিনের জাতির ভবিষ্যৎ নাগরিক। তার শিক্ষার শুরুটা যদি ভালো হয় তবে তার ভবিষ্যতও উজ্জ্বল হবে। সেজন্য পরিবারেরও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি বাল্য শিক্ষার কিছু নীতিবাক্য শেখানো উচিত যা দ্বারা তার জ্ঞান প্রসারিত হয়। যেমন পড়িতে শীঘ্র অভ্যাস কর/ অনভ্যাসে বিদ্যা হ্রাস পায়/ পাঠশালায় যাইতে বিলম্ব করিও না/ গুরুজনকে ভক্তি কর ইত্যাদি। প্রাথমিক শিক্ষা সাধারণত আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম পর্যায়।

১৯৯৭ সালে আই এস সিইডি প্রাথমিক শিক্ষার সংজ্ঞাটি দিয়েছিল এইভাবে যে, প্রাথমিক শিক্ষা সাধারণত ৫ থেকে ৭ বছর বয়সের মধ্যে শুরু হয় এবং এটি অন্যান্য মৌলিক বিষয়গুলো বোঝার পাশাপাশি পড়া, লেখা এবং গণিতে একটি যথাযথ প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য নকশা করা হয়েছিল। অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুরা প্রাথমিক পড়া, লেখা এবং গাণিতিক দক্ষতা শিখে যা তাদের ভবিষ্যৎ শিক্ষা জীবনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও তাদের শিক্ষাগত যাত্রার এই অংশটি সমালোচনামূলক চিন্তা ভাবনা, তাদের নিজস্ব শেখার শৈলীর বিকাশ এবং চরিত্রের বিকাশকে উৎসাহিত করে।

দেশে এখন মোট প্রাথমিক বিদ্যালয় ১ লাখ ১৪ হাজার ৬৩০টি। এর মধ্যে সরকারি ৬৫ হাজার ৫৬৭টি, যা আগের বছর ছিল ১ লাখ ১৪ হাজার ৫৩৯টি। প্রাথমিক শিক্ষা আমাদের শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি শিশুর প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার হলো শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষার মূখ্য উদ্দেশ্য হলো প্রতিটি শিশুর জ্ঞান বা চেতনা বৃদ্ধি করা, আত্মোন্নয়নের সম্ভাবনা তৈরি করা, মানসিক বিকাশ ঘটানো, স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরি করা, শ্রমের মর্যাদা সম্পর্কে ধারণা, সর্বোপরি নৈতিক মূল্যবোধ তৈরি করা। একটি শিশুর সামাজিক, মানসিক, দৈহিক, সাংস্কৃতিক, আবেগীয় বিষয় গড়ে ওঠে এই প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে। তবে এটি শুধু সরকার বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একার দায়িত্ব নয় বরং প্রতিটি বাবা মাকেও সমানভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

প্রাথমিক পর্যায়ে উত্তম শিক্ষা শিশুদের ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যথাযথভাবে প্রস্তুত করতে পারে। এ কারণে প্রাথমিক শিক্ষা একটি শিশুর জ্ঞানীয় বিকাশের ভিত্তি। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে যে শিক্ষা অর্জন করা হয় তা হলো আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম পর্যায়। এই সময় শিশুদের ব্যক্তিত্ব গঠিত হয় এবং তারা সমাজের একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করে। তাই এই শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি যদি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আদর্শ, নীতিনৈতিকতা, সততা, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, জাতির প্রতি মমত্ববোধ তৈরি করতে না পারে তাহলে কখনোই আদর্শবান জাতি গঠন করা সম্ভব নয়। মানুষ শুধু শিক্ষিত হলেই হয় না, ভালো সেবা, মানবিকতা, শিষ্টাচার, ভালো ব্যবহার না শিখলে একজন আদর্শ মানুষ হওয়া যায় না।

বিশ্ব ব্যাংকের সর্বশেষ লার্নিং টু রিয়ালাইজ এডুকেশন প্রমিজ ২০১৮ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ১০০ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাত্র ২৫ জন নিজ পাঠ্যপুস্তকের সাধারণ গণিত সমাধান করতে পারে। ৭৫ জন অংক করতে পারে না এবং বুঝেও না। ফলে শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা ও পুষ্টির বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্বব্যাংক। ইউনেস্কোর এশিয়া প্যাসিফিক রিজিওনাল ব্যুরো ফর এডুকেশন সমপ্রতি এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের অভাবেই শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত হচ্ছে না। প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। প্রশিক্ষিত শিক্ষকের হার মাত্র ৫৮ শতাংশ। বাকি ৪২ শতাংশ শিক্ষকই অপ্রশিক্ষিত।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গুণগত শিক্ষা দিতে হলে যোগ্য ও মেধাবীদের প্রাথমিক স্তরে শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষায় দুর্নীতি বন্ধ করার পাশাপাশি শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন কাঠামো প্রদান করলে শিক্ষার্থীদের পাঠদানে আগ্রহ বাড়ানো সম্ভব। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শুরু থেকে উপযুক্ত শিক্ষা প্রদান অত্যন্ত ধৈর্য, সততা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করতে হয়। বীজ রোপণের পর একটি চারাগাছের সঠিকভাবে যত্ন নিলে সেটা পরিপূর্ণ সবল গাছে পরিণত হয়ে ডালপালা ছড়িয়ে ফুলে ফলে সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। মানুষের জীবনও সেরকম। একজন শিশুকে প্রাথমিক জ্ঞান দান, তাকে সবদিক দিয়ে আদর্শ মানুষ গড়ার পেছনে শিক্ষকরাই অন্যতম বড় ভূমিকা পালন করেন। তবে শিক্ষকদের পাশাপাশি শিশুরা বাড়িতে মাবাবার কাছ থেকেই বিভিন্ন বিষয়ের প্রথম পাঠ গ্রহণ করে। অভিভাবকই হলো শিশুদের সর্বপ্রথম শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক। বর্তমানে একটি শিশুর শিক্ষা দানে শিক্ষকের পাশাপাশি মাবাবার ভূমিকা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

শিক্ষা গ্রহণে অনাগ্রহ শিশুর মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টিতে শিক্ষকদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। তাই শিক্ষার্থীদের মধ্যে আনন্দের সাথে পাঠদানের পদ্ধতি এবং নিজের মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্য শিক্ষকদের জানা একান্ত প্রয়োজন। শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত ও মানসম্মত শিক্ষা প্রদান করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা আমাদের শিশুদের শিক্ষা দেয় পড়া ও লেখার দক্ষতা, নৈতিক বিকাশ, সামাজিক এবং যোগাযোগ দক্ষতা। প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে শিশুরা কেবলমাত্র শিক্ষিত হয় না, বরং শৃঙ্খলা, সম্মানবোধ, সহমর্মিতা ও দায়িত্বশীলতার মত গুণাবলীও অর্জন করে। তাই প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা জাতির অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য।

লেখক: শিক্ষক ও গল্পকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমিথ্যে নয়
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে