প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিখন ঘাটতি আজকে নতুন বিষয় নয়। প্রায় সময় সামাজিক যোগাযোগ ও গণমাধ্যমগুলোতে শিখন ঘাটতি নিয়ে আলোচনা সমালোচনা পরিলক্ষিত হয়। আমাদের শিক্ষা খাতের কর্তাব্যক্তিরাও মাঝে মধ্যে পরিপত্র জারি করে শিখন ঘাটতি দোহাই দিয়ে গ্রীষ্মকালীন ছুটি, রমজানের ছুটি কেটে নেন। আমি একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে ১০ বছর কর্মজীবন শেষ করলাম। শুধু ১০ বছরের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে নয় আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন সেই ৯০ এর দশক থেকে দেখে আসছি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিখন ঘাটতি। ৯০ এর দশকের শিখন ঘাটতি থেকে বর্তমানের শিখন ঘাটতি বেশি নয়। তবে সেই এনালগ সময়ের শিখন ঘাটতির বিষয়ে কারো অভিযোগ না থাকলেও বর্তমান ডিজিটাল যুগের শিখন ঘাটতি নিয়ে মাথা ব্যথা আছে অনেকের। তবে বর্তমানে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতির পিছনে অনেক কারণ রয়েছে। আজকে সেই কারণ.গুলো নিয়ে আমার এ লেখনী। ৯০ এর দশকের শিক্ষকগণ শুধু শিক্ষা দান ছাড়া অন্য কোন সরকারি কাজের সাথে জড়িত ছিলেন না। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষকগণ শিক্ষা দান ব্যতীত অনেক সরকারি কাজ করার ক্ষেত্রে বাধ্য। সেই সাথে শিক্ষা অফিসে আজ এ তথ্য কাল ঐ তথ্য জমা দিতে হয়। বেশির ভাগ স্কুলে শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক কম থাকায় তথ্যগুলো সংগ্রহ করা ও পাঠানোর দরুন ধারাবাহিকভাবে ক্লাস পরিচালনায় বিঘ্ন ঘটে। বর্তমানে শিক্ষকগণ শিক্ষাদান ছাড়াও স্কুলের প্রয়োজনে ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে যে কাজগুলো করতে হয় কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে শিশুজরিপ, বই উৎসব, পিতা–মাতার এনআইডির ফটোকপি ও বাচ্চার জন্মনিবন্ধন যাচাই পূর্বক ছাত্র–ছাত্রী ভর্তি, জন্ম নিবন্ধন ঠিক না থাকলে প্রত্যয়ন দেওয়া, ক্লাস রুটিন তৈরি, বার্ষিক পাঠ পরিকল্পনা তৈরি ও অনুমোদন, প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ উদযাপন, বার্ষিক ক্রিড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন, শিক্ষার্থীদের প্রোফাইল আপডেট, বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন সাথে স্কুল ম্যানেজিং কমিটি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দাওয়াত প্রদান, মা ও অভিভাবক সমাবেশের আয়োজন, বিভিন্ন দিবস উদযাপনের জন্য প্রস্তুতি নেতৃবৃন্দ ও কমিটির সকলকে আমন্ত্রণ ও যথাযথ মর্যাদায় উদযাপন, এসএমসির সভা আয়োজন, মিনা দিবস ও শিক্ষা মেলার অংশগ্রহণ, সাক্ষরতা দিবস পালন, পি টি এর সভা আয়োজন, কাব স্কাউট কার্যক্রম, বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ পালন উক্ত কাজগুলো ছাড়াও ক্ষুদে ডাক্তার গঠন, কৃমিনাশক ওষুধ সেবন ও সপ্তাহ পালন, নির্বাচন ট্রেনিং, ভোটগ্রহণ, ভোটার করানো সহ নানাবিধ রেজিস্ট্রার হালফিল ও সংরক্ষণ, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পরিপত্রের নির্দেশনা পালন ও তথ্য প্রদান ইত্যাদি। এসব কাজগুলো যথাযথভাবে করা এবং এ ৪০–৫০ রকমের রেজিস্ট্রার মেন্টেন করতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দানে ব্যাঘাত ঘটে। এছাড়াও বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ হওয়ায় ছয় ঋতুর নানাবিধ সৌন্দর্য ও সুযোগ সুবিধার পাশাপাশি নানা প্রকারের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সমূখীন হতে হয় প্রতিনিয়ত। যার ফলে দুর্যোগকালীন ক্লাস স্থগিত রাখা ও ক্লাস চললেও শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতি শিখন ঘাটতির আর একটি কারণ। তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উক্ত সমস্যাগুলো থাকা সত্ত্বেও শিখন ঘাটতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা যেতো যদি কর্তৃপক্ষ শিক্ষক সমতার গুরুত্ব দিতেন। শিক্ষক সমতার অভাবটা হচ্ছে শিখন ঘাটতির সবচেয়ে বড় সমস্যা। সীতাকুণ্ড বাংলাদেশের অগ্রসর উপজেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি উপজেলা। এখানে দুর্গম এলাকা নেই বললেও চলে। এ অগ্রসর উপজেলায়ও শিক্ষক সমতার অভাব চরম। বাংলাদেশের দুর্গম এলাকা যুক্ত উপজেলা, হাওড় বাওড় ও উপকূলীয় অঞ্চল সমৃদ্ধ উপজেলাগুলোর শিক্ষক সমতার অভাব আরও চরম অবনতির দিকে। চট্টগ্রাম শহরের দারপ্রান্তে অবস্থিত উপজেলা সীতাকুণ্ডের শিক্ষক হিসেবে আমি সীতাকুণ্ডের কিছু শিক্ষক সমতার অভাব তোলে ধরলাম। সীতাকুণ্ডের প্রত্যেকটা এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা যথেষ্ট ভালো থাকা সত্ত্বেও শিক্ষক সমতার অভাব যথেষ্ট পরিলক্ষিত। এখানে বেশ কিছু স্কুল রয়েছে যেখানে চার–পাঁচ শত বা তারও অধিক শিক্ষার্থীর স্কুল রয়েছে যেখানে শিক্ষক রয়েছে দুই–তিন অথবা চার জন। যেখানে থাকার কথা ১০ জনের অধিক শিক্ষক। ফলে এসব স্কুলগুলোতে একজন শিক্ষককে একসাথে দুইটি বা তার অধিক ক্লাস দেখতে হয়। যার ফলে সঠিক পাঠ দান সম্ভব হয়ে উঠে না। আর সদরের পাশে ও মেইন রোডের পাশে কিছু স্কুল রয়েছে যেমন বারৈয়ারঢালা, কলাবাড়িয়া, শেখ পাড়া, সিবপুর, ফৌজদারহাটসহ অনেক স্কুল রয়েছে যেখানে শিক্ষার্থী রয়েছে ১০০ থেকে ১৪০ জন কিন্তু শিক্ষক রয়েছে ৯ থেকে ১০ জন করে। দেখা যায় এসব স্কুলের শিক্ষকগণ সারাদিনে দুই একটা ক্লাস নিয়ে অফিসে বসে গল্প, মোবাইল চালিয়ে অলস সময় পার করেন। এ চিত্রটা সীতাকুণ্ডের প্রায় স্কুলগুলোতে। ফলে বেশি শিক্ষার্থীর স্কুলগুলোতে শিক্ষকের অভাবে ক্লাস নেওয়া সম্ভবপর হয়ে উঠে না। আবার সঠিকভাবে শিক্ষক নিয়োগ ও বদলিজনিত নিয়োগের অভাবে কিছু স্কুলে হিন্দু শিক্ষক বেশি মুসলিম শিক্ষক কম যার ফলে ইসলাম ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা পাঠদানে সমস্যা দেখা যায়। আবার কিছু স্কুল রয়েছে যেখানে সবগুলো মুসলিম শিক্ষক একজনও হিন্দু শিক্ষক নেই। নতুন নিয়োগ ও বদলীজনিত নিয়োগগুলোতে হিন্দু মুসলিম শিক্ষার্থী অনুপাতে হিন্দু ও মসলিম শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক সমতা করে বা ডেপুটেশনের মাধ্যমে সমতা প্রদানের মাধ্যমে শিখন ঘাটতি দূর করা সম্ভব বলে আমি দৃঢ় বিশ্বাস করি।
লেখক : সহকারী শিক্ষক
লতিফপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়