‘সরকার পিইসি সমাপনী, জেএসসি এমন কি এইচএসসির মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা বাতিল করলো। অথচ কিছু প্রাইভেট স্কুল ওয়ান, টু, থ্রী’র বাচ্চাদের অনলাইনে পরীক্ষা নিচ্ছে। এসব ক্লাসে পরীক্ষা না নিলে কি এমন ক্ষতি হবে!!!
আবার অনেকে প্রশ্ন দিয়ে বাসায় পরীক্ষা নিচ্ছে। অভিভাবকরা স্কুলের পরীক্ষার খাতা জমা দিয়ে আসছে। আমার ধারণা এসব শুধুমাত্র স্কুলের বেতন-ফি নেয়ার উছিলা। এছাড়া আর কিছু না। একেবারে নাদান বাচ্চাদের পরীক্ষা নেয়ার আয়োজন দেখে মনে হচ্ছে, জীবনে পরীক্ষা ছাড়া আর কিছু নাই। এসবের পেছনে স্কুলের পাশাপাশি অতিমাত্রায় হাইপার অভিভাবকরাও দায়ী।’
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রাথমিকের শিশুদের অনলাইনে পরীক্ষার আয়োজন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এভাবেই ক্ষোভ জানালেন আতিকা রহমান নামে এক অভিভাবক। কেবল একজন নয়, ছোট ছোট বাচ্চাদের এই পরীক্ষা নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া অধিকাংশ অভিভাবকেরই। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে অসহায় এই অভিভাবকরা এসব নিয়ে প্রকাশ্যে বলতে সাহস করছেন না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ (বাওয়া), সেন্ট মেরিস স্কুল, এজি চার্চ স্কুলসহ নগরীর বহু বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রাথমিকের শিশুদের কাছ থেকে অনলাইনে পরীক্ষা নিচ্ছে। অভিভাবক ও স্কুল সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়- স্কুলগুলো অনলাইনে প্রশ্ন দেয়ার পর বাসায় বসেই পরীক্ষায় অংশ নেয় শিশুরা। কয়েকটি স্কুল পরীক্ষার পরপরই খাতাগুলো ছবি আকারে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে সংগ্রহ করে নেয়। আবার কোন কোন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে পরীক্ষার সপ্তাহখানেক পর স্কুলে গিয়ে অভিভাবকদের খাতা জমা দিয়ে আসতে হয়। তবে অনলাইনে এই পরীক্ষা যে নামে মাত্র এবং শিশু শিক্ষার্থীদের সাথে এক ধরণের তামাশার শামিল বলে মন্তব্য অনেক অভিভাবকের। তাঁরা বলছেন- পরীক্ষার আগেই স্কুলের মাসিক বেতন ও ফি পরিশোধ করতে হয়। করোনা পরিস্থিতিতেও মওকুফ তো দূরের কথা, বেতন-ফি আদায়ের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর তাগাদা বরং বেড়েছে। আর এসব বেতন-ফি আদায়ের কৌশল হিসেবেই শিশুদের অনলাইনে পরীক্ষার এই আয়োজন। কারণ, পরীক্ষায় অংশ না নিলে জরিমানাসহ নানাবিধ শাস্তির কথা আগেই জানিয়ে রাখছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
বাওয়া স্কুলে ক্লাস টু-তে পড়ুয়া এক শিশু সন্তানের অভিভাবক জানান- মূল্যায়ন পরীক্ষার নামে গত মাসে (সেপ্টেম্বরে) অনলাইনে পরীক্ষা নিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। তবে পরীক্ষার আগে সম্পূর্ণ বেতন-ফি পরিশোধ করতে হয়েছে।
সেন্ট মেরিস স্কুলে ২য় ও ৩য় শ্রেণিতে অধ্যয়নরত একাধিক শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানান- অভীক্ষা নামে এ পর্যন্ত দু দফায় অনলাইনে পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। প্রতি বিষয়ে ৫০ নম্বরের পরীক্ষা নেয়া হয়। অনলাইনে প্রশ্ন দেয়ার পর বাচ্চারা নিজেদের খেয়াল-খুশি মতো পরীক্ষা দেয়। তবে পরীক্ষার আগে বাধ্যতামূলক ভাবে বেতন-ফি পরিশোধ করতে হয়।
ক্ষোভ প্রকাশ করে একাধিক অভিভাবক বলছেন- সরকার যেখানে বড়দের বিভিন্ন পরীক্ষা বাতিল করেছে, সেখানে অনলাইনে পরীক্ষার নামে শিশুদের যন্ত্রণা দেয়ার কোন মানে হয় না। কিন্তু শুধু বেতন-ফি আদায়ের জন্যই প্রতিষ্ঠানগুলো সেটি করছে। এটি কেবল প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই নয়।
এদিকে, প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহন কিংবা পরীক্ষার প্রস্তুতির বিষয়ে কোন নির্দেশনা দেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠান এ ধরণের কাজ করলে জেলাপ্রশাসনে অভিযোগ দেয়ার সুযোগ আছে।
বাচ্চাদের অনলাইনে পরীক্ষা যে নামে মাত্র, তা স্বীকার করেছেন স্কুল সংশ্লিষ্টরাও।
জানতে চাইলে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় সম্পৃত্ত রাখার লক্ষ্যে অনলাইনে এই পরীক্ষা-ক্লাস নেয়া হচ্ছে বলে দাবি করেছেন বাওয়া স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ জয়শ্রী সেন। তিনি আজাদীকে বলেন, শিক্ষার্থীদের একটু গতিশীল রাখতেই এ কার্যক্রম। নয়তো শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা থেকে দূরে চলে যাবে। তবে বাচ্চাদের অনলাইন পরীক্ষায় আসলে কিছু হচ্ছে না বলে স্বীকার করেন তিনি।
বেতন-ফি আদায়ের বিষয়ে জয়শ্রী সেন বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক পর্যায়ের প্রায় ৭০ ভাগ শিক্ষক ননএমপিও। তাই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন-ফি না নিলে এ প্রতিষ্ঠান চলবে কেমনে। অনলাইন ক্লাস-পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন-ফি আদায় অনেকটা সহজ হয় বলেও স্বীকার করেন তিনি।
এবিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আ স ম জামসেদ খন্দকার।