ইস্কুল খুইলাছেরে মওলা ইস্কুল খুইলাছে, গাউসুল আজম মাইজভান্ডারী ইস্কুল খুইলাছে। চট্টগ্রামের মানুষ এই গানটির সাথে বেশ পরিচিত। চট্টগ্রাম ছাড়াও বিশ্বের বুকে জায়গা করে নিয়ে এই গানটি, যা আজো বেশ জনপ্রিয়তার তুঙ্গে অবস্থান করছে। এ জনপ্রিয় গানটি রমেশ শীলের লেখা। মাইজভান্ডারী গানের জনকও বলা হয় রমেশ শীলকে। তিনি সহস্রাধিক গান লিখেছেন মাইজভান্ডারকে ঘিরে। যার মধ্যে কয়েকটি গান আজো বেশ জনপ্রিয়তায় রয়েছে।
চট্টগ্রামের এই কৃতী পুরুষের জন্ম ১২৮৪ বঙ্গাব্দের ২৬ বৈশাখ ১৮৭৭ সালের ৯ মে বোয়ালখালী উপজেলার গোমদণ্ডী গ্রামের শীল পাড়ায়। পিতা চণ্ডীচরণ শীল আর মাতা রাজকুমারী শীল। তাঁর পিতা পেশায় একজন কবিরাজ ছিলেন। তাঁর ইতিহাস সম্পর্কে জানতে উপজেলা সদরের উত্তরের পথ ধরে রেল লাইনের পর বোয়ালখালী থানা পার হয়ে হাতের ডান সড়কের কিছু দূর গেলেই দেখা যায় রমেশ শীলের সমাধি সৌধ। সমাধির পরেই দুই তলা বিশিষ্ট তাঁর বাড়িতে গিয়ে পেয়ে গেলাম রমেশ শীলের ছেলের ঘরের নাতিকে। তাঁর নাম কল্পতরু শীল।
তাঁর থেকে রমেশের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৮৮৪ সালে সাত বছর বয়সে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় তাঁকে। চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র অবস্থায় তিনি তাঁর বাবাকে হারান। সেই থেকে বেদনা আর দারিদ্রতায় ঘিরে রেখেছিল তাঁকে। প্রাথমিকের গণ্ডি আর পার করতে পারেননি তিনি। ওইটুকুন বয়সে সংসারের সব ভার তার কাঁধে আসে। নিজের সে সময়ের অবস্থার কথা তিনি লিখেছেন এভাবে, “একদশ বর্ষ পূর্ণ না হইতে, বাবা গেল স্বর্গপুরে। আমিই বালক, চালক, পালক, আমার আর কেহ নাই,মায়ের অলংকার সম্বল আমার বিক্রি করে খাই। তিন সহোদরা মাতা মাতামহী ছয়জনে এক পরিবার, এই হলো শিক্ষা আমার প্রাইমারি পরীক্ষা ভাগ্যে না জুটিল আর”।
একবার ভাগ্যবদলের জন্য রেঙ্গুন গিয়ে একটি দোকানের কর্মচারি হিসেবে কাজ করেন। সেখানে তাঁর আর্থিক অবস্থা ভালো হওয়ায় নিজেই একটি দোকান দেন। কিন্তু মাতৃভূমির মায়ায় পাঁচ বছরের মধ্যে আবার দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে তিনি কবিরাজ (গ্রাম্য চিকিৎসক) হিসেবে কাজ শুরু করেন। রাতে কোথাও পালাগান হলে তিনি সেখানে চলে যেতেন। কবিগান দেখতে দেখতে, আকৃষ্ট হন আর নিজেই চর্চা শুরু করেন। প্রথমে প্রথাগত কবিগান রচনার মাধ্যমে শুরু করলেও পরে কবিগানের ধরনই পাল্টে দিয়েছিলেন তিনি।
কল্পতরু বলেন, মাইজভান্ডারী গান লেখার পাশাপাশি তিনি দক্ষ একজন কবিয়াল ছিলেন। মাইজভান্ডারের ভক্ত অনুরাগিরা তাঁকে রমেশ মাইজভান্ডারী বলেও ডাকতেন। আজ থেকে ১২৫ বছর আগে ফিরিঙ্গীবাজারের মাঝিরঘাট এলাকায় দুর্গাপূজার জমজমাট এক আয়োজনে তৎকালিন কবিয়াল মোহনবাঁশির সাথে চিত্তাহরণের পালাগানের আয়োজন করেন আয়োজকরা। হঠাৎ চিত্তাহরণ অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় তিনি উপস্থিত হতে পারেননি পালা গানে। এসময় অনুষ্ঠানে দর্শক সারিতে উপস্থিত ছিলেন রমেশ শীল। চিত্তাহরণের অনুপস্থিতিতে উপস্থিত হাজারো দর্শকের সামনে আয়োজকদের সম্মান রক্ষার্থে আয়োজকরা রমেশ শীলকে মঞ্চে তুলে দেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২১ বছর। রমেশ শীলকে দেখে প্রথমে অবজ্ঞার সুরে মোহনবাঁশি বললেন, ‘এই পুঁচকের সাথে কি পালা করা যায়। মোহনবাঁশির কথার জবাব বিনয়ের সাথে রমেশ শীল দিয়েছেন ঠিক এভাবেই, উৎসব আর ভয়, লজ্জা কম নয়। কে বা হারাতে পারে কারে, পুঁচকে ছেলে সত্যি মানি, শিশু ব্রজ ছিল জ্ঞানী, চেনাজানা হোক না আসরে। রমেশের জবাব শুনে মোহনবাঁশি কিছুটা বিস্মিত হলেন। পরে টানা আট ঘণ্টা পালা গান চলতে থাকে রমেশের সাথে মোহনবাঁশির। ২১ বছরের যুবককে হারাতে না পেরে সমোঝতা করেন উভয়ে। অল্প বয়সে রমেশের দক্ষতা দেখে মোহনবাঁশি বলেন এই ছেলে একদিন জগৎ খ্যাত কবিয়াল হবে। সেটি তাঁর প্রথম পালা গান ছিল। প্রথম গান থেকেই তাঁর নাম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। পরবর্তী সময়ে তিনি কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালে বাংলা কবিগানের ইতিহাসে প্রথম সমিতি গঠিত হয় রমেশ শীলের উদ্যোগে। ১৯৪৮ সালে কলকাতার শ্রদ্ধানন্দ পার্কে কবিগানের পর তিনি “বঙ্গের শ্রেষ্ঠ কবিয়াল” উপাধি পান।
১৯৪৪ সালে কবি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে জোরাল অবস্থান নিয়েছিলেন। যে কারণে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙ্গে দেওয়ার পরে অন্যান্য নেতা-কর্মীর সাথে রমেশ শীলকেও গ্রেফতার করা হয়। তার ‘ভোট রহস্য’ পুস্তিকাটি বাজেয়াপ্ত করে কেন্দ্রীয় সরকার। এসময় কবি দীর্ঘদিন কারাভোগ করেন। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরধিতা করায় রমেশ শীলের সাহিত্য ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়। শেষ জীবনে কবি নিদারুণ অর্থ কষ্টের সম্মুখিন হন। কবির প্রথম স্ত্রী ছিলেন অপূর্ববালা এবং দ্বিতীয় স্ত্রী অবলাবালা। দুই ঘরের সংসারে কবির চার পুত্র ও দুই কন্যা জন্মলাভ করে।
মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর সকালে রমেশ শীলের বাড়িটি গানপাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় পাকহানাদার বাহিনী। সেই সঙ্গে রমেশ শীলের ছনের ছাউনিযুক্ত সমাধিও পুড়িয়ে দেন তারা। সেদিন পাকসেনাদের দেয়া আগুনে রমেশ শীলের লেখা কবিতা ও গানের ১৮টি পাণ্ডুলিপির মধ্যে ১৭টিই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। মাটির নিচে পুঁতে রাখায় একটি পাণ্ডুলিপি রক্ষা হয়। সেই একটি পাণ্ডুলিপি আজ জগৎখ্যাত। আরো অসংখ্য গান অরক্ষিত অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
তিনি পেয়েছিলেন অগণিত মানুষের ভালোবাসা। জীবদ্দশায় পেয়েছেন প্রচুর সংবর্ধনা। ১৯৫৮ সালে ঢাকায় কারান্তরীণ থাকা অবস্থায় সহবন্দীরা তাঁকে সংবর্ধিত করেছেন। ১৯৬২ সালে বুলবুল একাডেমি ও ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রামে নাগরিক সংবর্ধনা এবং ২০০২ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন তিনি।
এছাড়া ২০২৩ সালের সরকার অনুমোদিত ৭ম শ্রেণির নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকের বইয়ের পাঠ্যসূচির শিল্প ও সংস্কৃতির পাঠ্যবইয়ের ২২ পৃষ্ঠায় স্থান হয়েছে রমেশ শীলের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রমেশ শীল সম্পর্কে জানতে পারে।
কল্পতরু শীল আরো বলেন, জার্মান থেকে ড. হার্ডান সার্টার নামের এক ডক্টরেট রমেশ শীল সম্পর্কে জানতে ২০০৯ সালে ১ মাসের জন্য বাংলাদেশে আসেন। এছাড়া রাশিয়া, লন্ডনসহ বিভিন্ন দেশের মানুষ রমেশ শীলের সমাধিতে এসেছে। রমেশ শীলকে নিয়ে অনেকে গবেষণা করে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
এই কিংবদন্তি ১৯৬৭ সালের ৬ এপ্রিল ৯০ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। রমেশ শীল মারা যাওয়ার খবর তৎকালিন সময় রেডিওতে প্রচার হলে হাজার হাজার ভক্ত অনুরাগী তাঁকে দেখতে চলে যান তাঁর বাড়িতে। তাঁর মৃত্যুকে ঘিরে রয়েছে নানা মন্তব্য। সে সময় মুসলিমদের বিজ্ঞ আলেম, হিন্দুদের পুরোহিত, খ্রীস্টানদের পাদ্রি ও বৌদ্ধদের ভিক্ষুরা এসে উপস্থিত হয়েছেন। হিন্দু হিসেবে দাহ করার নিয়ম থাকলেও সকলের সর্বসম্মতিক্রমে তাঁকে সমাধি করা হয়। কারণ তিনি তাঁর গানে লিখে গেছেন এভাবে, আমি বন্ধুর প্রেম আগুনে পুড়া, শইগো আমি মরলে পুড়াইস না তুরা। সেই থেকে তাঁর পরিবারের কেউ মারা গেলে তাঁকে দাহ করানো হয় না। তাদের সমাধি করা হয়।
তবে জনশ্রুতি আছে, তাঁর সমাধির পর তাঁকে আবার তুলে দাহ করার সিদ্ধান্ত ছিল। সমাধির পর আবার তুলতে গেলে সমাধিতে রমেশের জায়গায় গোলাপ ফুল দেখা যায়। কিন্তু কল্পতরু শীল বলেন, আমার পিতা পুলীন বিহারী শীল থেকে শুনেছি এমন কোন ঘটনা ঘটেনি। মূলত বিষয়টি পাকিস্তানের পেশোয়া নামক স্থানে কবি লায়লার সমাধিস্থলে এ ঘটনাটি ঘটেছিল। সেই ঘটনাটি রমেশ শীলকে ঘিরে বিভ্রান্ত ছড়ানো হচ্ছে। এসব বলে মানুষকে বিভ্রান্ত না করার অনুরোধ করেছেন কল্পতরু শীল। তাঁর সমাধি সৌধ পুনরায় সংস্কার করেছেন পিএইচপি গ্রুপের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সুফী মিজানুর রহমান। তবে তাঁর নামে একটি ছোট সড়ক ছাড়া উল্লেখ করার মত আর কিছুই নেই। সরকারের কাছে তাঁর নামে উপজেলা সদর অথবা গোমদন্ডী ফুলতল এলাকায় একটি তোরণ নির্মাণ বা একটি সাংস্কৃতিক একাডেমি নির্মাণের দাবী করেছেন তাঁর পরিবার।