প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ছাড়া গণতন্ত্র টেকসই হয় না

নাসের রহমান | বুধবার , ২৭ নভেম্বর, ২০২৪ at ৫:৫৮ পূর্বাহ্ণ

যে কোন দেশে সরকারের পক্ষ বিপক্ষ থাকে। কোন কোন দেশে বিপক্ষের লোকেরা সোচ্চার হতে পারে না। এমনকি মতামতও প্রকাশ করতে পারে না। নানা ধরনের বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হয়। গণতান্ত্রিক দেশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা। ভিন্ন মত প্রকাশেরও সুযোগ করে দেয়া। একটি দেশের মানুষ কখনো একই মতের ওপর থাকে না। তবে কিছু কিছু বিষয় আছে যেসবের ওপর ঐকমত্য গড়ে ওঠে। সেগুলোতেও সময়ের ব্যবধানে ভিন্নমত পোষণ করতে দেখা যায়। আবার কতগুলো জাতীয় ইস্যু আছে যেখানে ঐক্যমতের ভিত্তিতে এগিয়ে চলতে হয়। এসব ক্ষেত্রেও যে দ্বিমত নেই তা নয়। অধিকাংশ মানুষের মতামতের প্রতিফলন যেখানে থাকে সেগুলোতে ঐক্যমতের ভিত্তিতে এগিয়ে চলতে পারলে সফলতা আসে। ভিন্ন মতকে অগ্রাহ্য করে বা পাশ কেটে গেলেও তখন সমালোচনা বেশি দূর এগুতে পারে না। সমালোচনাকে গ্রহণ করে বা বর্জন করে কিংবা খন্ডন করার মতো মানসিকতা বা সংস্কৃতি অনেকাংশে নেই বললে চলে। গণতান্ত্রিক ধারায় বা সমাজ ব্যবস্থায় এসবের কোন বিকল্প নেই। গণতন্ত্রের সৌকর্য হচ্ছে অপরের মতকে গুরুত্ব দেয়া, উপেক্ষা করা নয়।

বেশির ভাগ দেশ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। সাধারণ মানুষেরাও গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে। মৌলিক অধিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সুরক্ষিত থাকে। মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকতে পারে না। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ছাড়া গণতন্ত্র বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারে না। গণতন্ত্রের পরিধি অনেক ব্যাপক। স্তরে স্তরে গণতন্ত্রের চর্চার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মত প্রকাশের সুযোগ এবং ভোটাধিকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভোটের মাধ্যমে মানুষ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ পায়। এমনকি তাদের মতামতেরও প্রতিফলন ঘটে। এজন্য গণতান্ত্রিক ধারায় সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে দেশের শাসন ক্ষমতার পরিবর্তন হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনার সুযোগ পায়। গণতান্ত্রিক ধারায় যারা নির্বাচিত হয় তারা সবার প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে নির্বাচিত হলেও সংখ্যালঘিষ্ঠরাও সমান সুযোগ পায়। এখানেই গণতান্ত্রিক সরকারের বিশেষত্ব।

স্থিতিশীলতা বজায় না থাকলে গণতান্ত্রিক ধারা ব্যাহত হয়। উন্নয়ন কর্মকান্ডও বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। শাসন ব্যবস্থাও হুমকির মধ্যে পড়ে যায়। এজন্য গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সব পক্ষকে নিয়ে এগিয়ে চলতে হয়। কোন পক্ষের বিরোধিতা থাকলেও সমঝোতার মাধ্যমে এগুতে হয়। ভিন্ন মতের প্রশ্ন এলে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে নিরসন করতে হয়। গণতান্ত্রিক ধারায় পারস্পরিক বোঝাপড়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি বা সংগঠন সব ক্ষেত্রে অন্যের মতকে বিবেচনায় আনতে হয়। পরিস্থিতি একবার অস্থিতিশীল হয়ে গেলে তা সহজে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না। বল বা বাধা প্রয়োগ করলে এতে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এ ক্ষোভ ভবিষ্যতের জন্য পুঞ্জিভূত হতে থাকে। এক সময়ে ক্ষোভ আক্রোশে পরিণত হয়। আক্রোশকে সহজে থামানো যায় না। যা সমাজের জন্য বা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য সহায়ক নয়। এজন্য স্থিতিশীল পরিস্থিতি বজায় রাখার জন্য উভয় পক্ষকে সজাগ থাকতে হয়। তবে এ ক্ষেত্রে শাসক পক্ষকে অধিকতর দায়িত্বশীল হতে হয়।

ক্ষমতায় যারা থাকুক না কেন তাদের একটি বিরোধী পক্ষ থাকে। এদেরকে বিরোধী দলও বলা হয়ে থাকে। বিরোধী পক্ষ যে সব কাজে বিরোধীতা করবে তা নয়। যে কোন কাজের সমালোচনা করা যায়। অনেক সময় আলোচনা সমালোচনার মধ্য দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসে। এজন্য বিরোধ পক্ষ কোন কোন সময় সহায়ক শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। ভুল ভ্রান্তি ধরে শোধরে দেয়ার দায়িত্ব অনেকটা বিরোধী পক্ষের। এতে করে যে কোন বিষয়ে একটা ঐক্যমত্য বা কনসেশাস তৈরি হয়। যা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ কনশেসাস ছাড়া কোন বড় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায় না। বাস্তবায়িত হলেও এর সুফল সবাই ভোগ করতে পারে না। এজন্য বিরোধী পক্ষকে আস্থায় নিয়ে পথ চলতে হয়। কোন কিছুতে বিরোধীদের বাদ দিয়ে নয়।

আমাদের দেশে এমন এক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে বিরোধীদের মতামতের কোনো গুরুত্ব দেয়া হয় না। কোন কোন ক্ষেত্রে আলাপ আলোচনা হলেও বিরোধী মতামতকে সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে তাদের আলোচনার কোন সুযোগ দেয়া হয় না। এজন্য গণতান্ত্রিক ধারায় শক্তিশালী বিরোধী পক্ষ থাকা প্রয়োজন। তা না হলে ক্ষমতাসীনরা সবকিছু নিজেদের মতো করে পাশ করিয়ে নিয়ে যায়। ভারসাম্য বলে আর কিছুই থাকে না। বিরোধী পক্ষও ধীরে ধীরে কোনঠাসা হয়ে পড়ে। তারা সোচ্চার হয়ে কোন কিছু ঠেকাতে পারে না। এভাবে চলতে চলতে শাসক দল গণতন্ত্রকে নিজস্ব ধারায় নিয়ে যেতে চায়। গণতন্ত্রকে কুক্ষিগত করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। গণতান্ত্রিক মানসিকতা লোপ পেতে থাকে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে গণতান্ত্রিক ধারা ব্যাহত হয়। শাসক পক্ষ গণতন্ত্র থেকে সরে গিয়ে স্বৈরতন্ত্রের দিকে ধাবিত হতে থাকে। স্বৈরতন্ত্র কখনো দেশ ও জাতির জন্য কোন মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। স্বৈরতন্ত্র দীর্ঘ সময় ধরে চললে জাতির আশা আকাঙ্খা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়।

ধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে সবাই গণতান্ত্রিক ধারায় সমান অধিকার ভোগ করে। একইভাবে দল মতের ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন শ্রেণী পেশায় মানুষের সমাধিকার পাওয়ার কথা। অর্থনৈতিক কারণে কোথাও কোথাও বৈষম্য থাকলেও মৌলিক বিষয়ে সবার অধিকার সমান থাকে। এখানে দল বলতে সাধারণত রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝায়। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের নিজস্ব ধ্যান ধারণা বা মতামত রয়েছে। বেশ কিছু লক্ষ্য নিয়ে তারা জনগণের কাছে আসে। সাধারণ মানুষের সমর্থন না পেলে কোন দল বেশি দূর এগুতে পারে না। ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে আমাদের দেশে হাতে গোনা কয়েকটি দল। যারা ঘুরে ফিরে বার বার ক্ষমতায় আসে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণ যাদের নির্বাচিত করবে তারাই ক্ষমতায় আসবে। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পাবে, এটাই স্বাভাবিক। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের রায়ের প্রতিফলন ঘটে। এ রায়কে মেনে নেয়া গণতন্ত্র। এজন্য সব রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকতে হয়। জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে কাকে গ্রহণ করবে বা বর্জন করবে। তা না হলে সবার অংশগ্রহণ ব্যাপারটা যথাযথ হবে না।

গণতান্ত্রিক ধারায় নির্বাচনের কোন বিকল্প নেই। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। যে সরকার জনগণের স্বার্থে কাজ করে। দেশ ও জনগণের স্বার্থকে সুরক্ষা করে। জনগণকে নিয়ে দেশ পরিচালনা করে। বিরোধী পক্ষকে দমন পীড়ন না করে তাদের মতামতকে বিবেচনায় নিয়ে সহঅবস্থানের পরিবেশ তৈরি করে। এমন কিছু রাজনৈতিক দল আছে যাদের জনসমর্থন নেই বললে চলে। সংসদে অনেক দলের কোন প্রতিনিধি থাকে না। সেসব দলের বক্তব্য বা মতামতকে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। সবাইকে নিয়ে চলতে গেলে এদের মতামতকে অগ্রাহ্য করলে চলবে না। দল মত নির্বিশেষে প্রত্যেকের মতামত প্রদানের সুযোগ থাকতে হবে। সবার মতামত যে গ্রহণ করতে হবে তা নয়। তবে বিবেচনা করতে হবে। তাহলে বিরোধী পক্ষসহ অন্যরাও সরকারের প্রতি আস্থাশীল হয়ে উঠবে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড়াবে। গণতন্ত্র আবার চর্চা বা অনুশীলনের বিষয়ও। গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকলে ধীরে ধীরে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করবে। কেউ গণতন্ত্র ছাড়া বিকল্প কিছু ভাবতে পারবে না। তখন গণতন্ত্র টেকসই হয়, দীর্ঘস্থায়ী হয়। গণতন্ত্রই হবে একমাত্র পথ। এ পথেই দেশ ও জাতি সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংক নির্বাহী

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশে রাবার শিল্প: একটি পর্যালোচনা -৩