প্রাণ বাঁচাতে ‘কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই’ ফিলিস্তিনিদের

গাজাকে অবরুদ্ধ করার নির্দেশ, বন্ধ থাকবে খাবার, বিদ্যুৎ, জ্বালানি সরবরাহ ।। ইসরায়েলে নিহত ৭ শতাধিক, গাজায় ৫৬০

| মঙ্গলবার , ১০ অক্টোবর, ২০২৩ at ৬:০৮ পূর্বাহ্ণ

হামাসের হামলার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন তার দেশ এখন ‘যুদ্ধের মধ্যে আছে’। প্রতিরক্ষামন্ত্রী দেশটির সেনাবাহিনীকে গাজা ভূখণ্ড ‘পুরোপুরি অবরুদ্ধ’ করার নির্দেশ দিয়েছেন। গত দুই দিন ধরে গাজায় তীব্র বিমান হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে একের পর এক ভবন। নিজেদের উপর সহসা নেমে আসা এই দুর্যোগে প্রাণ বাঁচাতে কোথাও এমনকি পালিয়ে যাওয়ার সুযোগটুকুও নেই গাজার সাধারণ ফিলিস্তিনিদের। খবর বিডিনিউজের। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইওভ গ্যালান্ট গতকাল সোমবার গণমাধ্যমের সামনে তিনি বলেন, কোনো বিদ্যুৎ, কোনো খাবার, কোনো জ্বালানি গাজা ভূখণ্ডে সরবরাহ করা হবে না। এছাড়া ইসরায়েল গতকাল নজিরবিহীন এক পদক্ষেপে তিন লাখ রিজার্ভ সেনা তলব করার কথা জানিয়েছে। গাজার বাসিন্দাদের সরেও যেতে বলেছে তারা। এতে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসকে ধরাশায়ী করতে গাজায় স্থল হামলার পরিকল্পনা করছে বলেই ইঙ্গিত মিলছে। ইসরায়েলের প্রধান সামরিক মুখপাত্র রিয়াল অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হ্যাগারি বলেছেন, আমরা এর আগে কখনও ২য় পৃষ্ঠার ৬ষ্ঠ কলাম

এত রিজার্ভ সেনা ডেকে আনিনি। আমরা আক্রমণে যাচ্ছি। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী গতকাল জানিয়েছে, তারা গাজার আশপাশে ইসরায়েলের যে এলাকাগুলোতে হামাস যোদ্ধারা অবস্থান নিয়ে লড়াই করছিল ফের সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।

ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ফোন কল এবং মোবাইল ফোনে অডিও বার্তা পাওয়ার কথা জানিয়েছে। এসব ফোনকল এবং বার্তায় তাদেরকে মূলত গাজার উত্তর এবং পূর্বাঞ্চলীয় এলাকাগুলো থেকে সরে যেতে বলা হচ্ছে। সেনারা সেখানে অভিযান চালাবে বলে সতর্ক করা হচ্ছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, গাজাকে বড় ধরনের মূল্য দিতে হবে, যা তাদের কয়েক প্রজন্মের বাস্তবতা বদলে দেবে।

এদিকে ব্যাপক পাল্টা হামলার শিকার হওয়ার পরও ফের ইসরায়েলে রকেট হামলা চালিয়েছে হামাস ও গাজার অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত জেরুজালেমেও বিস্ফোরণ শোনা গেছে বলে বিবিসি জানিয়েছে। গাজার উত্তর সীমান্তের কাছে ইসরায়েলে আশকেলন শহরে গাজা থেকে ছোড়া রকেট বিস্ফোরণে চারজন আহত হয়েছে। এদের মধ্যে একজন গুরুতর জখম হয়েছে। তাদের সবাইকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে ইসরায়েলের জরুরি পরিষেবা জানিয়েছে। আরও উত্তরে আশদোদ শহরে হামাসের রকেটে এক নারী গুরুতর আহত হয়েছে। ইসরায়েলকে ধ্বংস করে দেওয়ার আহ্বান জানানো ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস বলেছে, ইসরায়েলের ১৬ বছরের অবরোধে গাজাবাসীদের দুর্দশা এবং পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেনাদের প্রাণঘাতী অভিযানের বদলায় ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে তারা কোনও অন্যায় করেনি।

ইসরায়েলে হামাসের হামলায় সেনাসহ সাত শতাধিক মানুষ নিহত ও আড়াই হাজারেরও বেশি আহত হয়। আর ইসরায়েলের পাল্টা জবাবে এ পর্যন্ত ৫৬০ জন নিহত ও ২৭৫০ জন আহত হয়েছে বলে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।

২০০৫ সালে গাজা ছাড়ে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী। ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ২০০৭ সালে গাজার ক্ষমতায় আসে। তার পর থেকে প্রায় ১৭ বছর ধরে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে ছোট্ট এই ভূখণ্ডটি। মিশর এবং ইসরায়েল গাজাকে রীতিমত অবরুদ্ধ করে রেখেছে। এমনকি গাজার আকাশ ও নৌসীমার নিয়ন্ত্রণও দেশদুটির হাতে। যে কারণে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) গাজাকে ‘বিশ্বের সর্ববৃহৎ খোলা কারাগার’ বলে বর্ণনা করেছে। গাজা বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল এলাকার অন্যতম। ১৪০ বর্গমাইলের ছোট্ট এই ছিটমহলে ২০ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করে। ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের নিত্য সংঘাত চলে। কিন্তু গত শনিবার ইসরায়েল ভূখণ্ডে হামাসের আকস্মিক হামলার ধাক্কা কাটিয়ে গাজার উপর যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী। গত ৪৮ ঘণ্টায় গাজাকে তারা ঝাঁজরা করে ফেলেছে। তাদের হামলায় গাজায় অন্তত ৫৬০ ফিলিস্তিনি নিহত এবং প্রায় তিন হাজার জন আহত হয়েছেন বলে গতকাল জানায় ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

ইসরায়েলের আকাশ হামলায় ৫৫ বছরের সালিম হুসেইনদের বহুতল ভবনটি ধ্বংস হয়ে গেছে। মাত্র পাঁচ মাস আগে পরিবার নিয়ে তিনি ওই ভবনের দ্বিতীয় তলায় বাস করতে শুরু করেছিলেন। কেন তাদের ভবনটিতে হামলা চালানো হল তা তিনি জানেন না জানিয়ে সিএনএনকে বলেন, হামলা চালানোর অল্প কিছুক্ষণ আগে ইসরায়েলের বাহিনী তাদের সতর্ক করে ভবন খালি করতে দিতে বলে। আমরা এক কাপড়ে বাড়ি ছাড়ি। আমাদের আর কিছু নেই। কোথাও যাওয়ার জায়গাও নেই। গতকাল ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েল গাজার আলশাতি ও জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে হামলা চালিয়ে ‘বহু মানুষকে হত্যা করেছে’। গাজার হাসপাতালগুলোতে আহত মানুষ উপচে পড়ছে।

আইডিএফ বলছে, তাদের লক্ষ্য হামাস যোদ্ধাদের ধ্বংস করা। তাই তারা সীমান্ত সংলগ্ন আবাসিক এলাকাগুলো থেকে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের সরে যেতে বলেছে। কিন্তু অবরুদ্ধ গাজার বাসিন্দাদের আসলে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হওয়া এই ভূখণ্ড চারিদিক দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। অনেকটা ইঁদুরের কলে আটকা পড়া ইঁদুরের মত অবস্থা হয়েছে গাজার বাসিন্দাদের। ৭৫ বছরের হানি এলবাওয়াব জানান, তার পরিবারের চার সদস্য রাতভর জেগে থাকেন। তাদের বাড়ির পাশের একটি বহুতল ভবনে ইসরায়েল বিমান হামলা চালিয়েছে এবং ওই ভবনের ধ্বংসস্তূপে তার বাড়িটিও চাপা পড়েছে। ফলে পরিবার নিয়ে তিনি এখন রাস্তায় নেমে এসেছেন। হানি বলেন, আমি জানি না কী করব। গাজার মানুষরা চরম ভয় ও আতঙ্কে দিন পার করছে। যে কোনও সময় বোমা হামলার শিকার হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি এখন শুধু সন্তানদের নিয়ে থাকার মত একটা আশ্রয় চাই। শুধু একটু আশ্রয়।

ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে যে ভয়াবহ সংঘাত শুরু হয়েছে তা যেন আরও বেড়ে না যায়, সে লক্ষ্যে মিশর মধ্যস্থতার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানিয়েছেন মিশরের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা। মধ্যস্থতার চেষ্টা চালাচ্ছে কাতারও।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইসরায়েলি হামলায় গাজায় ৯১ শিশু নিহত
পরবর্তী নিবন্ধদাম নির্ধারণ ৮৭৫, দর উঠল ১৪ টাকা