প্রাণঘাতী হার্ট অ্যাটাক : চিকিৎসক যখন ঝুঁকিতে

ডা. প্রবীর কুমার দাশ | বুধবার , ২৯ নভেম্বর, ২০২৩ at ৬:৪১ পূর্বাহ্ণ

৮ জুন ২০২৩ তারিখে দিল্লি থেকে প্রকাশিত দৈনিক হিন্দুস্থান টাইমস এ !‘চিকিৎসকদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি’ শীর্যক এক নিবন্ধ ভারতে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। আহমেদাবাদের বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা.গৌরব গান্ধী মাত্র ৪১ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাকে হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেন। পেশাগত জীবনে তিনি অসংখ্য হৃদরোগী চিকিৎসা করেছেন, সাধারণ মানুষকে হৃদরোগ প্রতিরোধে করনীয় বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। অথচ অপরিণত বয়সে তিনিই হলেন হার্ট অ্যার্টাকে শিকার।

২৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ২৩তম ব্যাচের কৃতী ছাত্র, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিশুরোগ বিভাগের অবসর প্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. দেলোয়ার হোসেন তার সপ্তাহান্তের মৌলভীবাজারস্থ ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখার সময় হার্ট অ্যাটাকে হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেন। তিনি সাপ্তাহিক ছুটির দিন ঢাকা থেকে মৌলভীবাজারে রোগী দেখতে যেতেন। অন্যান্য সপ্তাহের মতো সেদিনও তিনি রওনা হন। যাত্রাপথে বুকে হালকা ব্যথা অনুভব করেন। ব্যথা সহনীয় বিধায় তা আমলে নেননি। দুঃখজনকভাবে তিনি চেম্বারেই হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

গত ২৫শে অক্টোবর সকালে ঢাকায় হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে চিরবিদায় নেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক, চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের প্রথিতযশা মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও খ্যাতিমান গবেষক ডা. রিদওয়ানউর রহমান। তার মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে চট্টগ্রামসহ সারা দেশের চিকিৎসক সমাজ শোকে মুহ্যমান হয়। তাঁর গ্রামের বাড়ী চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার কাঞ্চনায়। ডা. রিদওয়ানউর রহমান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ১৯তম ব্যাচের এমবিবিএস পরীক্ষায় শীর্ষস্থান দখলকারী কৃতী ছাত্র। ডা. রিদওয়ান তার মেধার স্বীকৃতি স্বরূপ এমবিবিএস পাস করে ইন্টারশীপ ট্রেনিং করেন তদানিন্তন পি.জি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়)। পরবর্তীতে স্বল্প সময়ে তিনি এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। একাডেমিক পাঠ চুকিয়ে তিনি চট্টগ্রামে পেশাগত জীবন শুরু করেন। তিনি দীর্ঘ কয়েক বছর মেডিসিন বিষয়ের অধ্যাপক হিসাবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে দায়িত্ব পালন করেন। তখন তার জ্ঞান, গড়িমা, শিক্ষক হিসাবে পাঠদানে দক্ষতা, মনোমুগ্ধকর উপস্থাপনা, রোগী চিকিৎসার কারিশমা এবং সর্বোপরি গবেষণায় পারঙ্গমতা সবাইকে মুগ্ধ করে। পরবর্তীতে তিনি দীর্ঘ সময় ঢাকায় মেডিসিনের অধ্যাপক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন এবং অবসরে যান। এই সময় তিনি ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, কোভিড, ডেঙ্গুসহ জনগুরুত্বসম্পন্ন বিভিন্ন সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে গবেষণা করেন। এ সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ ও দিক নির্দেশনা দিয়ে জাতীয় দায়িত্ব পালন করেন। সরকারী চাকুরী থেকে অবসর নিলেও তিনি সার্বক্ষণিক জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি ছিলেন মেডিসিন বিষয়ে এফসিপিএস এর শিক্ষক ও পরীক্ষক। গত ২০২১ সালে তিনি বিসিপিএস ফেলোদের প্রত্যেক্ষ ভোটে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ঢাকায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেও তিনি সপ্তাহান্তে চট্টগ্রাম এসে রোগীদের চিকিৎসা দিতেন। এখানে আয়োজিত বিভিন্ন কনফারেন্স ও চিকিৎসক সমাবেশে নিয়মিত অংশ গ্রহন করতেন এবং বিভিন্ন সামাজিক দায়িত্ব পালন করতেন। মেডিসিন বিষয় ছাড়াও চিকিৎসা বিজ্ঞানের যেকোন বিষয়ে তিনি বিজ্ঞ মতামত দেওয়ার ক্ষমতা রাখতেন। তা মন্ত্রমুগ্ধের মত স্রোতাগণ শুনতেন ও উপভোগ করতেন। গত ১৭ জুন ২০২৩ চট্টগ্রামের হোটেল রেডিসন ব্লুতে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রামের প্রথম আন্তর্জাতিক হৃদরোগ বিষয়ক কনফারেন্স ‘কার্ডিকন চট্টগ্রাম২০২৩’ এ তিনি অতিথি হিসাবে ছিলেন। এই অনুষ্ঠানে তিনি ভবিষ্যৎ দিক নির্দেশনামূলক ও দর্শনভিত্তিক এক অসাধারণ বক্তৃতা দেন যা দেশ বিদেশের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের প্রশংসা কুড়ায়। গত ২৫শে অক্টোবর ভোরে তার ঢাকার বাসায় হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হবার খবর পেয়ে ছুটে আসেন তার এমবিবিএস সহপাঠী অধ্যাপক ডা. সিরাজুল হক ও অধ্যাপক ডা. ফাতেমী। তাকে জরুরি সিপিআর দিতে দিতে নিকটস্থ ল্যাব এইড কার্ডিয়াক সেন্টারে নিয়ে গেলে তথায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

এভাবে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ডা. রিদওয়ানউর রহমানসহ চিকিৎসকদের হার্ট অ্যাটাকে হঠাৎ মৃত্যুবরণ কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়। চিকিৎসকগণ কি হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিতে? এই বিষয়টিই গত ৮ই জুন হিন্দুস্থান টাইমস পত্রিকা প্রকাশ করে। এই বিষয়ে সঠিক কোন গবেষণা না থাকলেও এটা প্রতীয়মান যে বিশেষ কিছু কারণে চিকিৎসকগণ হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিতে থাকেন।

মানসিক চাপ : চিকিৎসকদের দিন রাত হাসপাতালের বৈরী পরিবেশে অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত থাকতে হয়। রোগী চিকিৎসার সাথে সামলাতে হয় রোগীর সাথে আগতদের হৃদয়োচ্ছ্বাসকে। তা সময় সময় বিপত্তি ও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এতে চিকিৎসক আক্রান্ত হবার ঘটনাও ঘটে কখনও কখনও।

অপর্যাপ্ত বিশ্রাম : প্রতিনিয়ত রোগীর যত্ন নিতে গিয়ে তারা নিজের শরীরের যত্নের কথা বিস্মৃত হয়। পেশাগত কারণে অনেক চিকিৎসকের রাতের ঘুম বিঘ্নিত হওয়া ছাড়াও দিনের বিশ্রামও বিভিন্নভাবে বিঘ্নিত হয়। কিছু চিকিৎসক যেমন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, সার্জন, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞগণকে অনেক সময় রাত্রীবেলা নিজের বিশ্রাম বাদ দিয়ে হাসপাতালে ছুটতে হয়। তা তীব্র মানসিক চাপের সৃষ্টি করে। সপ্তাহের ছুটির দিনেও চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে কোন কোন চিকিৎসকের বিশ্রাম নেবার সুযোগ একেবারে থাকে না।

খাদ্যভ্যাস : পেশাগত ব্যস্ততায় খাদ্যভ্যাস পরিবর্তিত হয়। সময়স্বল্পতায় দুপুরে কারো কারো ঘরের খাবার গ্রহণ সম্ভব হয় না। বাধ্য হয়ে হাসপাতালে কিংবা হোটেলে তৈরী অস্বাস্থ্যকর খাবার আর চেম্বার শেষ গভীর রাতে বাসায় খাবার গ্রহণএ সবই হৃদরোগ সৃষ্টিতে অবদান রাখে।

জীবানু সংক্রমণ : ঘন ঘন রোগীর সংস্পর্শে আসাতে চিকিৎসকদের জীবানু সংক্রমণের আশংকা বাড়ে। এই সংক্রমণের কিছু কিছু হৃদরোগ সৃষ্টিতেও প্রভাব বিস্তার করে।

অলস জীবনযাত্রা ও ব্যায়ামের অভাব : অধিকাংশ চিকিৎসকই নিয়মিত ব্যায়াম করেন না। অলস জীবনযাত্রা, ব্যায়ামের ঘাটতি, গভীর রাতে নৈশভোজন, বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ মেদবাহুল্য সৃষ্টি করে এবং তা হৃদরোগের অন্যান্য ঝুঁকি যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তের উচ্চ কোলেস্টেরলের জন্য দায়ী।

হৃদরোগের ঝুঁকির আধিক্য : বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে চিকিৎসকদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে উচ্চ কোলেস্টেরল ইত্যাদি সমবয়সী অন্যান্যদের তুলনায় বেশী।

চেক আপের অভাব : চিকিৎসকগণ অনেকেই তাদের নিজেদের শারীরিক উপসর্গকে আমলে নেন না। তারা কেউ কেউ প্রথাগত বিভিন্ন ঝুঁকি যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস নিয়ে সচেতন থাকলেও আধুনিক ও বিকাশমান বিভিন্ন ঝুঁকির ব্যাপারে নির্বিকার। তার মধ্যে মানসিক চাপ, বায়ু দুষণ, ত্রুুটিপূর্ণ ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস অন্যতম। চিকিৎসকগণ হৃদরোগের বিভিন্ন ঝুঁকি, তা নিয়ন্ত্রণের উপায় ও সফল সম্পর্কে অবগত থাকা সত্ত্বেও তাদের মধ্যেই ঝুঁকিপূর্ণ উপাদানের উপস্থিতি বেশি। তাদের জ্ঞান ও তার প্রয়োগের মধ্যে রয়েছে সুস্পষ্ট ফারাক। অথচ এই বিষয়ে চিকিৎসকদের তৎপরতা ও উদ্যোগের সাথে সমাজের অন্যান্যদের সুস্বাস্থ্য সরাসরি সম্পর্কিত। এই বাস্তবতাকে উপলদ্ধি করেই ২০১৭ সালে ওয়ার্ল্ড মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন চিকিৎসা পেশায় চিকিৎসকদের অঙ্গীকারনামা বা জেনেভা কনভেনশনে সংশোধনী আনে। আর তা হলো, “রোগীদের সর্বোচ্চ সেবাদানের নিমিত্তে আমি আমার নিজের স্বাস্থ্যের উপযুক্ত যত্ন নিশ্চিত করব।” এভাবে চিকিৎসকদের নিজের স্বাস্থের প্রতি আরো যত্নশীল হওয়ার বিষয়টি সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত হয়েছে।

তাই আজ সময় এসেছে চিকিৎসকদের নিজের স্বাস্থ্যের দিকে আরো মনোযোগী হবার। আমরা আর ডা. রিদওয়ানউর রহমানের মতো কোন চিকিৎসককে অপরিণত বয়সে হারাতে চাই না। এমন সময়ে তিনি বিদায় নিলেন যখন তার দেশ ও জাতিকে আরো অনেক কিছু দেবার ছিল।

পরিশেষে, আমরা চিকিৎসকরা হার্ট অ্যাটাকের ব্যাপারে সম্যক অবহিত। সব জেনে নিজের জন্য কিছু না করে আমরা বসে থাকতে পারি না। ‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়’রবীন্দ্রনাথের এই উক্তির মতো যেন হার্ট অ্যাটাকের মতো সর্বনাশা পরিস্থিতির জন্য আমরা বসে না থাকি।

লেখক : সেক্রেটারী জেনারেল, চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন; সাবেক বিভাগীয় প্রধান, হৃদরোগ বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধনজির আহমদ চৌধুরী রোডের ৩০ নম্বর বাড়ি ধর্ম- রাজনীতি ও সাহিত্যের অনন্য তীর্থস্থান