প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও আমাদের হৃৎ-সুস্থতা

ডা. প্রবীর কুমার দাশ | বুধবার , ৮ মে, ২০২৪ at ৮:০১ পূর্বাহ্ণ

ভূমিকা: বন, অরণ্য এবং প্রকৃতি বিষয়ক লেখার জন্য সবিশেষ পরিচিত বাঙালি লেখক বুদ্ধদেব গুহ বলেছেন, ‘প্রকৃতি আমার একমাত্র প্রেমিকা যে আমাকে আনন্দ দিয়েছে, দুঃখ দেয়নি কোনরকম; তাইতো মাঝে মাঝে প্রকৃতির ছায়ায় এসে নিজের মনের যত রক্তাক্ত ক্ষত আছে সেগুলো সারিয়ে তুলি।’ আর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘প্রকৃতির সাথে বন্ধুত্ব মানুষকে ফাঁসের মত বেঁধে ফেলতে চেষ্টা করে না; তাকে আনন্দ দেয়, মুক্তি দেয়।’ মানুষের পরমবন্ধু প্রকৃতি আজ বিপর্যস্ত। মানুষ এবং মানবসৃষ্ট সভ্যতাই তার জন্য দায়ী। প্রাকৃতিক বিপর্যয় মানুষকে আজ আনন্দের বদলে দুঃখ দিচ্ছে; মুক্তির বদলে ফাঁসের মতো বেঁধে ফেলছে। তা মানুষের ভোগান্তি ও মৃত্যুর কারণ হচ্ছে।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে বায়ু দূষণ। বিশ্বজুড়ে চলমান বিভিন্ন কর্মকাণ্ড বায়ুমণ্ডলকে দূষিত করে তুলেছে। এতে সৃষ্ট উচ্চ মাত্রার গ্রীন হাউস গ্যাস বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়াচ্ছে। এসবের অন্যতম হচ্ছে জ্বালানী হিসাবে ভূগর্ভস্থ তেল ব্যবহার, বন নিধন, নগরায়ন, মানুষের আবাসন বিস্তৃতি, চাষযোগ্য জমি হ্রাস এবং জীবন যাত্রার বহুমাত্রিক পরিবর্তন। এতে সৃষ্টি হচ্ছে ফুসফুসের অসুখ, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ প্রাণঘাতি বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা। গবেষণায় দেখা যায় হৃদরোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী ১৫ টা ঝুঁকিপূর্ণ উপাদানের পাঁচটিই পরিবেশ বিপর্ষয়ের কারণে ঘটে। বায়ু দুষণ তার প্রধান কারণ। বায়ু দূষণজনিত মোট মৃত্যুর শতকরা ৮০ ভাগই হৃদরোগ জনিত। উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইলিউর হৃৎপিণ্ডের ছন্দপতন, হঠাৎ হৃৎক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু ইত্যাদি তার অন্যতম।

বৈশ্বিক ও বাংলাদেশের পরিস্থিতি: বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে আজ প্রকৃতি বিপর্যস্ত ও বায়ু মণ্ডল দূষিত। গত ২০২৩ সাল ছিল সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের জলবায়ু পরিবর্তনের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন সাক্ষরের ৩০তম বার্ষিকী। তার মাধ্যমে বৈশ্বিক কারণে সৃষ্ট বায়ু দূষণ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধ করে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি হ্রাস করতে সবদেশ সম্মত হয়। দুঃখের বিষয় এই উদ্যোগের সফলতা এখনও অর্জিত হয়নি। আর তার ক্ষতিকারক প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশসহ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশ সমূহের উপর। বায়ু দূষণ বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।ওয়ার্ল্ড এয়ার কোয়ালিটি রিপোর্ট ২০২৩ শীর্যক প্রতিবেদনে দেখা যায় ২০২৩ সালে বায়ুদুষণের শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। এই সময়ে বাংলাদেশের বাতাসে সুক্ষ বস্তুকণা (PM 2.5) ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৭৯.৯ মাইক্রোগ্রাম। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ মতে তার প্রত্যাশিত মাত্রা ৫ মাইক্রোগ্রাম। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে প্রকাশ, বায়ুদূষণ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এখানে বছরে ২ লক্ষ ৭২ হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়সৃষ্ট দৃষণ ছাড়াও গৃহস্থালি থেকে নির্গত দূষণ বাংলাদেশসহ অন্যান্য এশিয়া দেশ সমূহে সর্বোচ্চ। তা অনেক সময় বায়ু মণ্ডলের দূষণকে ছাড়িয়ে যায়। অপরিচ্ছন্ন পদ্ধতিতে রান্না যেমন জ্বালানি হিসাবে কাঠ, জৈব বর্জ, কৃষি বর্জ ও কেরোসিন পোড়ানো ইত্যাদি তার অন্যতম কারণ। বায়ু দূষণের পাশাপাশি প্রাকৃতিক বিপর্যয় সৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, চরমভাবাপন্ন তাপমাত্রা (উষ্ণ ও নিম্ন), হঠাৎ অবিরাম বৃষ্টি জনিত বন্যা, বনাঞ্চলে সৃষ্টি অগ্নিকান্ড ইত্যাদি বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্নস্থানে দৃশ্যমান। এসবও হৃৎসুস্থতাকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে। এতে দেশের স্বাস্থ্য সেবা বিঘ্নিত হয়। বর্তমানে এদেশে দীর্ঘ এক মাসের বেশি সময় ধরে চলমান তাপদাহ ক্রমবর্ধমান হৃদরোগ ঝুঁকিকে আরো বাড়াচ্ছে। প্রতি এক ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে হার্ট অ্যাটার্ক, হৃৎপিণ্ডের ছন্দপতন ও হার্ট ফেইলিউর জনিত ভোগান্তি ও মৃত্যু ২.% বৃদ্ধি পায়।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিপন্ন হৃৎ সুস্থতা :

হৃদরোগ: বায়ুদুষণ সরাসরি হৃৎপিণ্ডের গঠন ও কার্যক্রিয়াকে পরিবর্তিত করে। অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় তা করে পরোক্ষভাবে। দূষিত বায়ুস্থ সুক্ষ বস্তুকণা (PM 2.5), কার্বন মনোঅক্সাইড, নাইট্রিক অক্সাইড, ওজোন ইত্যাদি শ্বাসনালী মারফত রক্তে পৌছে এবং রক্তনালীতে প্রদাহ সৃষ্টি করে। এতে রক্তনালী সংকুচিত হয়; রক্তনালীর কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়। এতে রক্ত জমাট বাধার প্রবণতা বাড়ে এবং রক্তচাপ বাড়ে, হৎপিণ্ডসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের রক্ত প্রবাহ বিঘ্নিত হয়। এতে দেখা দেয় হার্ট অ্যাটাক, দীর্ঘ মেয়াদী হৃদরোগ এবং হঠাৎ মৃত্যুর ঘটনা। রক্তনালীর প্রদাহ ডায়াবেটিস সৃষ্টিতেও অবদান রাখে। সমীক্ষায় দেখা গেছে উচ্চ দূষণপূর্ণ স্থানে প্রতি ১০ মাইক্রোগ্রাম সূক্ষ্ম বস্তুকণা বৃ্‌দ্িধতে হার্ট অ্যাটাকের আশংকা শতকরা ১০৩০ ভাগ বৃদ্ধি পায়। শতকরা ৭.৪ ভাগ হার্ট অ্যাটাক যানবাহন নিঃসৃত ধোয়ার সংশ্রব বন্ধ করে ঠেকানো সম্ভব। বায়ু দূষণের ধরন, স্থায়িত্ব এবং ব্যক্তি বিশেষের পূর্ববর্তী স্বাস্থ্যগত অবস্থা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অতি সুক্ষ্ম বস্তু কণাই হৃদরোগ ভোগান্তি ও মৃত্যুর সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। এটা পরিমাণ করেই বায়ু দুষণের মাত্রা নির্ধারিত হয়। এটাই এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউ আই)

উচ্চ রক্তচাপ: বায়ু দূষণে সরাসরি রক্তচাপ বাড়ে। একই কারণে ব্যস্ত ট্রাফিকযুক্ত বড় রাস্তার কাছে বসবাসকারীদের উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবার আশংকা বাড়ে। জরিপে দেখা গেছে, এই ধরনের রাস্তার ১০০ মিটারের মধ্যে বসবাসকারীদের উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হবার আশংকা সমবয়সী ১০০০ মিটার দূরত্বে অবস্থানকারীদের তুলনায় শতকরা ৯ ভাগ বেশি।

হার্ট ফেইলিউর: বায়ু দুষণে হৃৎপেশী দুর্বল হয়ে পড়ে; হার্ট ফেইলিউর সৃষ্টি হয়। দুর্বল হৃৎপিণ্ড বায়ু দূষণের প্রতি বেশি সংবেদনশীল। এভাবে বয়স্ক ব্যক্তি এবং যাদের পূর্ব থেকে হৃদরোগ আছে তাদের হার্ট ফেইলিউরে আক্রান্ত হবার আশংকা বেশি।

হৃৎপিণ্ডের ছন্দহীনতা : বায়ু দূষণে স্নায়ুতন্ত্রের পরিবর্তন ঘটে। এতে হৃৎস্পন্দন বাড়ে, তা অনিয়মিত হয় এবং দেখা দেয় ছন্দহীনতা বা অ্যারিথমিয়া। অ্যারিথামিয়া গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছে তা হঠাৎ হৃৎক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

ডায়াবেটিস: বায়ু দুষণ রক্তনালীর প্রদাহ সৃষ্টির মাধ্যমে ডায়াবেটিস সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।

প্রতিকারের উপায়: বায়ু দূষণ প্রতিরোধে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনাই লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে যানবাহন, কল কারখানা থেকে কার্বন নিঃসরণ বন্ধে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন আবশ্যক। জীবাস্মা জ্বালানীর স্থলে পরিবেশ বান্ধব বিকল্প, ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য।

গৃহস্থালির বায়ু দূষণ রোধে রান্নাঘর পরিষ্কার রাখা, রান্না ক্ষেত্রে কাট, জৈব ও কৃষিজ জ্বালানি ব্যবহার বন্ধ করা, চিমনীর সাহায্যে বান্নঘরের ধোঁয়া উপরে নিষ্কাষণের ব্যবস্থা গ্রহণ। মোমবাতি, কেরোসিনের কুপিবাতি ও ধূপ ব্যবহার সীমিত করা; এয়ার ফ্রেশনার ব্যবহার সীমিত করা এবং ভেনটিলেশন ব্যবস্থা উন্নত করা।

উচ্চ দূষণ এলাকা যেমন ব্যস্ত ট্রাফিক যুক্ত রাস্তা এড়িয়ে চলা, বিশেষত্ব হার্ট অ্যাটাকের রোগী এবং হার্ট ফেইলিউরে আক্রান্ত রোগীদের।

আবাসস্থলের অবস্থান উচ্চ দূষণমুক্ত বড় রাস্তা থেকে দূরে রাখা।

ফুটপাতে নিরাপদ হাঁটার স্থান, আলাদা সাইকেল লাইনের ব্যবস্থা করা।

হৃদরোগ ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের জন্য মাস্ক ব্যবহার ও বায়ু বিশুদ্ধকরণ ব্যবস্থা করা।

ধূমপান বন্ধ করা। ধূমপান বিরোধী আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা। পরোক্ষ ধূমপান প্রতিরোধ করা।

খাদভ্যাস এন্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার যেমন সবুজ শাকসবজি, ফলমূল গ্রহণ।

জনসচেতনতা সৃষ্টিতে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউ আই) নিয়মিত প্রকাশ করা; নিরাপদ দূষণমাত্রা নির্ধারণ করা ও তা বজায় রাখা।

জাতীয় স্বচ্ছ বায়ু কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার পরিবেশ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ব্যাংক, বি আর টি এ এবং হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে বেস্ট BEST (Bangladesh Environmental Sustainability & Transformation) প্রকল্প গ্রহণ করেছে। তার সফল বাস্তবায়ন জরুরি।

তাপদাহ চলাকালীন বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না হাওয়া, প্রচুর পানি পান করা, গৃহ পরিবেশ শীতল ও তার বায়ু প্রবাহ ঠিক রাখা ইত্যাদি। তাপদাহে হৃদরোগী ও হৃদরোগের ঝুঁকিতে থাকাদেরই হিট স্ট্রোকের আশংকা বেশি। এক্ষেত্রে এলার্ট মেনে চলা আবশ্যক।

উপসংহার: বায়ু দূষণ, তাপদাহ সহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানব সভ্যতাসৃষ্ট। সর্বগ্রাসী নগর সভ্যতার চাপে প্রকৃতি আজ বিপর্যস্ত। তার অপরিহার্য পরিণতিতে বিপন্ন আমাদের হৃৎ সুস্থতা। এই থেকে রেহাই পেতে রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তিগত ও সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ আবশ্যক। রবীন্দ্রনাথের ‘সভ্যতার প্রতি’ কবিতায় চরণের মতোই আমাদের আজকের প্রত্যাশা হোক, ‘দাও ফিরি সে অরণ্য, লও এ নগর, লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর / হে নব সভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী, দাও সেই তপোবন পূর্ণ ছায়ারাশি, পরানে স্পর্শিতে চাই ছিঁদিয়া বন্ধন / অনন্ত জগতের হৃদয় স্পন্দন। কবিগুরুর দেড়শো বছর আগে লেখা চৈতালী কাব্য গ্রন্থের এই কবিতা এখনও প্রাসঙ্গিক। এভাবে জগতের হৃদয় স্পন্দনের সাথে জগতবাসীর হৃদয়স্পন্দন একসূত্রে গাঁথা।

লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান, হৃদরোগ বিভাগ,

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধবিশ্ব রেডক্রিসেন্ট আন্দোলন ও বাংলাদেশ