চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দিনদিন বেড়েই চলছে। কিছুদিন নিম্মমুখী থাকার পর অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে শনাক্তের হার ফের বাড়তে শুরু করে। গত বেশ কিছুদিন টানা শতাধিক সংখ্যায় করোনা সংক্রমিত শনাক্ত হয়েছে চট্টগ্রামে। মাঝে দেড়শ বা এর কিছু কম-বেশি সংখ্যায় শনাক্ত হয়েছে কোন কোন দিন। সর্বশেষ রোববার (২২ নভেম্বর) শনাক্তের সংখ্যা প্রায় আড়াইশর কোটায় পৌছেঁছে। এদিন একদিনে চট্টগ্রামে করোনা সংক্রমিত শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৪২ জনে। ১ হাজার ২৭০টি পরীক্ষাকৃত নমুনায় ১৯.০৫ শতাংশের করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে এদিন। এর মাধ্যমে চার মাস পর শনাক্তের হার ফের ১৯ শতাংশ ছাড়াল চট্টগ্রামে। সংখ্যার হিসেবেও গত চার মাসে এটি সর্বোচ্চ। গত ২৩ জুলাই ৮৪২টি নমুনায় ১৫৭ জনের করোনা শনাক্ত হয়। শনাক্তের হার ছিল ১৮.৬৪ শতাংশ। এরপর থেকেই শনাক্তের হার ছিল নিম্মমুখী। তবে ২৩ জুলাইয়ের আগে শনাক্তের হার ছিল ২০ শতাংশের উর্ধ্বে। শনাক্তের সংখ্যাও ছিল তুলনামূলক বেশি। ৮ জুলাই ১ হাজার ৪৭১টি নমুনা পরীক্ষায় ২৯৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়। শনাক্তের হার ছিল ২০.০৫ শতাংশ। এক হাজার ৩১৮টি নমুনায় ২৯২ জনের করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয় ৬ জুলাই। হিসেবে ওইদিন শনাক্তের হার ছিল ২২.১৫ শতাংশ। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকে সংক্রমনের হার কমে আসে। যা অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে ফের বাড়তে শুরু করে।
সংক্রমন বাড়লেও পরিস্থিতি মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। তবে সাধারণ মানুষের মাঝে স্বাস্থ্যবিধি মানা ও মাস্ক পড়া নিশ্চিত করা না গেলে করোনা পরিস্থিতি ফের বেসামাল হতে পারে বলে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য বলছে- সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মহানগরের হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত শয্যা প্রস্তুত রয়েছে প্রায় ১২০০টি। আইসিইউ ৮০টি এবং প্রায় তিনশ হাই ফ্লু ক্যানোলা প্রস্তুত রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় থাকা হাসপাতালগুলোতে (চমেক, জেনারেল, বিআইটিআইডি, হলি ক্রিসেন্ট ও রেলওয়ে হাসপাতাল) প্রায় ৫৫০টি এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ৬৫০টি শয্যা প্রস্তুত রয়েছে। এসব শয্যায় বর্তমানে চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন করোনা রোগীরা। সরকারি হাসপাতালগুলোতে ৩০টি এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রায় ৫০টিসহ সবমিলিয়ে প্রায় ৮০টি আইসিইউ করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারণ করা আছে। এছাড়া শ্বাসকষ্টের রোগীদের উচ্চ মাত্রায় অঙিজেন সরবরাহে সবমিলিয়ে প্রায় তিনশ হাই ফ্লু ক্যানোলা রয়েছে মহানগরীর হাসপাতালগুলোতে। এর মধ্যে চমেক হাসপাতালে ৬৬টি, জেনারেল হাসপাতালে ৩০টি, বিআইটিআইডিতে ১০টি, মা ও শিশু হাসপাতালে ৮০টি এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে আরো ৮৮টি হাই ফ্লু ক্যানোলা প্রস্তুত রয়েছে বলে সিভিল সার্জন কার্যালয় জানিয়েছে।
সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে- মহানগরীর সরকারি হাসপাতালগুলোর ৫৫০টি শয্যায় গতকাল ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১২৫ জন। যদিও সপ্তাহ খানেক আগে ১১৩ জন রোগী ভর্তি ছিলেন এসব শয্যায়। অন্যদিকে, বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ৬৫০ শয্যায় গতকাল ভর্তি ছিলেন ১২০ জন রোগী। এক সপ্তাহ আগে বেসরকারি হাসপাতালের এসব শয্যায় ১১৪ জন রোগী ভর্তি ছিলেন।
এদিকে, বেসরকারি বেশ কয়টি হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত সবকয়টি শয্যা রোগীতে ভরপুর বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা। হাসপাতালেগুলোতে একটি শয্যাও খালি নেই। শয্যা খালি না থাকায় করোনা ব্লকে নতুন রোগী ভর্তি নেয়া সম্ভব হচ্ছেনা বলে জানিয়েছেন বেসরকারি মেট্রোপলিটন হাসপাতালের জিএম মো. সেলিম, পার্কভিউ হাসপাতালের জিএম মো. জিয়াউর রহমান ও ন্যাশনাল হাসপাতালের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আমজাদ হোসেন। করোনা ব্লকের পাশাপাশি আইসিইউতেও কোন শয্যা খালি নেই। তাছাড়া সাধারণ (নন-করোনা) রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
অন্যদিকে, সংক্রমন ও রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলেও মানুষের মাঝে এ নিয়ে যেন ভ্রুক্ষেপ নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা তো দূরের কথা, মুখে মাস্কটাই রাখছেন না অধিকাংশ মানুষ। যেখানে শুধু মাস্ক পড়া নিশ্চিত করলেই সংক্রমনের ঝুঁকি ৮০ ভাগ কমানো সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। করোনা নিয়ে মানুষের ডর-ভয় অনেকটা কেটে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতি বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা। তাঁরা বলছেন- প্রথম দিকে বেসরকারি হাসপাতালগুলো রোগী ভর্তি না নেয়ায় রোগীদের এক প্রকার অসহায় পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। এখন কিন্তু সব বেসরকারি হাসপাতালই করোনা রোগীদের কম-বেশি চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে। সংক্রমনের প্রথম দিকে ডাক্তার-নার্সসহ সংশ্লিষ্ট সকলের মাঝে এক ধরণের আতঙ্ক ছিল। যা এখন অনেকটাই কেটে গেছে। এছাড়া করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা নিয়ে আগে ডাক্তাররা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। এখন সে দ্বিধাটাও কেটে গেছে। বলা যায়-করোনা রোগীদের চিকিৎসায় ডাক্তাররা এখন অনেক বেশি আত্ববিশ্বাসী। সব মিলিয়ে করোনা নিয়ে প্রথম দিকে মানুষের মনে যে ভয়-ডর ছিল, এখন তা অনেকটা অনুপস্থিত। যার কারণে স্বাস্থ্যবিধি মানা কিংবা মুখে মাস্ক পড়ার ক্ষেত্রে সাধারণের অনেকটা ডোন্ট কেয়ার ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
সংক্রমন বাড়ার পাশাপাশি গত কিছুদিন ধরে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যাও কিছুটা বাড়ছে জানিয়ে সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, সংক্রমন যত বাড়বে রোগীর সংখ্যাও তত বাড়বে। সংক্রমন ঠেকাতে মানুষের মাস্ক পড়া ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষের মাঝে স্বাস্থ্যবিধি মানা ও মাস্ক পড়া নিশ্চিত করা না গেলে সংক্রমন বাড়তেই থাকবে। আর এভাবে বাড়তে থাকলে পরিস্থিতি আগের মতো বেসামাল হয়ে যেতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি। সিভিল সার্জন বলেন, আমাদের এক হাজারের বেশি শয্যা প্রস্তুত রয়েছে। শ খানেক আইসিইউ রয়েছে। কিন্তু হঠাৎ হাজারে হাজারে সংক্রমিত হলে এবং জটিল রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এতে করে আগের মতোই পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে যেতে পারে।
এমন পরিস্থিতি আনতে না চাইলে স্বাস্থ্যবিধি মানা ও সকলের মুখে সঠিক নিয়মে মাস্ক পড়া নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। সোমবার সিটি কর্পোরেশনের এক বৈঠকে জনসমাগম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেশকিছু প্রস্তাবনা দিয়েছেন জানিয়ে সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, তবে বিনোদন কেন্দ্র, কমিউনিটি সেন্টারসহ সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে জনসমাগম নিয়ন্ত্রণে সরকারিভাবে উচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত আসতে হবে।