সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বর্তমান সময়ে আলোচিত এক নাম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়া জীবন এক ধরনের অচলই হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের সামপ্রতিক রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বেশ আলোচিত একটি নাম। এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ইতিবাচক দিক যেমনি আছে তেমনি রয়েছে নেতিবাচক দিকও। এই সময়ে যুব সমাজের এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার নিয়ে নানা নেতিবাচক সংবাদও আমরা প্রকাশ হতে দেখি। কিন্তু সত্য যে প্রযুক্তিকে কেউ অস্বীকার করতে পারেন না। আজ থেকে দশ বা বিশবছর আগেরই জীবন ব্যবস্থার কথা চিন্তা করলে ভাবি মানুষ প্রযুক্তির অগ্রগতিতে কীভাবে নিজেকে সমর্পণ করেছে। মানুষ ও তার জীবনযাত্রা সবসময় সময়ের কাঁটা ধরেই চলে। সেজন্য সময়কে কেউ অস্বীকার করতে পারি না। সে কারণে সময়ের স্রোতে ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বর্তমানে মানুষের জীবনে ব্যাপকভাবে যে প্রভাব রেখে চলেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্তমানে বিশ্বে জনপ্রিয় যেসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম রয়েছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ফেসবুক, মেসেনজার, গুগল, ইনস্ট্রাগ্রাম, টুইটার, ভাইভার, হোয়াটসএ্যাপ, ইমু অন্যতম। তবে এগুলো ছাড়া্ও আরো অনেক জনপ্রিয় মাধ্যম রয়েছে। এর মধ্যে সবচাইতে বেশি ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হচ্ছে ফেসবুক। বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের মানুষের সঙ্গে মুহূর্তেই সম্পর্ক তৈরি করে দিচ্ছে ফেসবুক। এই ফেসবুক মানুষকে এমন এক ইন্দ্রজালে আবদ্ধ করেছে তা যেন আমাদের এক ধরনের সামাজিক বিচ্ছিন্নতাকেই দূর করেছে। দেশে ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা ব্যক্তির সাথে সংযুক্ত হওয়ার জন্য একটি দুর্দান্ত প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে ফেসবুক। সারা বিশ্বের নানা বয়সী কোটি কোটি মানুষ এই প্ল্যাটফর্মের সাথে যুক্ত। এই প্ল্যাটফর্মের সাথে বিচ্ছিন্নতা মানে যেন সারা বিশ্বের সাথেই বিচ্ছিন্নতা। যারা এর সাথে যুক্ত থাকেন তারা সকলেই বিষয়টি অনুধাবন করেন। এ মাধ্যমে নিজের মতামত প্রকাশ করার পাশাপাশি এবং অন্যের থেকে মতামত পাওয়ার যে অবারিত সুযোগ তার তুলনা মেলা সত্যিই কঠিন। প্রিয়জনের সাথে কথোপকথন বা নাগরিকদের নিঃসঙ্গতা হ্রাস করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম শক্তিশালী একটি মাধ্যম।
শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য ও তথ্যের দ্রুত প্রসারণের ক্ষেত্রে এ মাধ্যম এখন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বাস্তবতার দূরত্ব কাটিয়ে পরিচিত অপরিচিত অনেকের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা কিংবা বন্ধুত্বের আহবানও ফিরিয়ে দেয়া যায় এ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ফেসবুকের মাধ্যমে শেয়ার করা ছবি, ভিডিও, মতামত ইত্যাদির ওপর মন্তব্য করা যায় এবং পাল্টা মন্তব্যও দেয়া যায়। ব্যক্তিগত বার্তা পাঠানো যায়, যা কেবল যাকে পাঠানো হয় সে–ই পড়তে ও দেখতে পারে, অন্যরা নয়। তাছাড়া নতুন বা পরিচিত বন্ধু খোঁজার জন্য ফেসবুকে বিভিন্ন ধরনের নেটওয়ার্কও রয়েছে। নিজের পছন্দ অনুযায়ী গ্রুপও করে নেয়া যায়। ফেসবুকের সবচেয়ে মজার জিনিসটি হচ্ছে আলাপচারিতা যাকে আমরা চ্যাটিং বলি। প্রিয় বন্ধুটির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর ফেসবুকে থাকা সাপেক্ষে তার সঙ্গে আলাপও করা যায়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষা কার্যক্রমে সংযুক্ত থেকে শিক্ষার্থীরাও ভালো মানের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেতে পারে। বিজ্ঞাপন ও নানা প্রচার প্রচারণায় অবারিত সুযোগ এ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবসায়কে গতিশীল করছে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, জাতিগত নানা বাধা পেরিয়ে ভার্চুয়াল যে বন্ধুত্বের দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে সৃষ্টি তা এক কথায় অনবদ্য। এতসব সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কেন আজ এক ধরনের সামাজিক নানা বিশৃংখলা কিংবা নানা নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে তা সুশীল সমাজকে প্রতিনিয়তই ভাবাচ্ছে। বর্তমান অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যে ভূমিকা তা নানাভাবে এক ধরনের সংকট তৈরি করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে বর্তমানে সংবাদের জন্য সংবাদপত্র, বেতার ও টেলিভিশনের ওপর নির্ভরতা আগের তুলনায় অনেকগুণে কমেছে সত্য, কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তথ্য মানুষের মধ্যে সন্দেহ ও বিভ্রান্তির জন্ম দিচ্ছে। রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতার কারণে কেউ কোনো সংবাদকে ইতিবাচক হিসাবে নিচ্ছে কেউ নেতিবাচক হিসাবে নিচ্ছে। সমাজে তৈরি হচ্ছে অশান্তির একটি পরিবেশ। এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে সমাজে অনেক বড় বড় অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে তা কারো অজানা নয়। আমাদের দেশেও ছোটো বড় অনেক ঘটনা ঘটেছে। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির মাধ্যমে এ ধরনের নানা অপকর্ম সংঘটিত করা হয়েছে। সমাজে তৈরি হয়েছে এক ধরনের অস্থিরতা। সামাজিক যে বৈষম্যের কথা আমরা বলি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের সমাজে ধনী–গরিবের মাঝে এক ধরনের সামাজিক ব্যবধান তৈরি করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখনো পর্যন্ত কিন্তু গরিব জনগোষ্ঠীর কাছে সেভাবে দৈনন্দিন ব্যবহারের মাধ্যম হয়ে উঠতে পারেনি। সেজন্য এর নেতিবাচক ব্যবহারের কারণে সাধারণ গরিব জনগোষ্ঠীকে অনেক মূল্য দিতে হচ্ছে। যেগুলোর সাথে তারা আদৌ কোনো ভাবেই সম্পৃক্ত নয়। কারণ আমাদের মত দেশের প্রেক্ষাপটে দেখি সাধারণ গরিব জনসাধারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবিধা গ্রহণ করতে এখনো অক্ষম। যাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের দক্ষতা আছে তারা চাকরি, প্রভাবশালীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা এবং নিজ এলাকায় সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ বেশি পেয়ে থাকে। ফলে সামজিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে এক শ্রেণি। তরুণ প্রজন্মের কাছে এক ধরনের আসক্তির মতো, ব্যক্তিগত বিভিন্ন ফাঁসের নেতিবাচক দিক, পরিবারের চেয়ে অনেক সময় এ মিডিয়ায় বেশি মাত্রায় ঝুঁকে থাকার প্রবণতা বৃদ্ধি, অপরাধীরা অপরাধ সংগঠিত করতে এ মিডিয়ার ব্যবহার করাসহ নানা ধরনের নেতিবাচক দিকও এখন দৃশ্যমান। কিন্তু তাই বলে এর ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করার কোনো কারণ নেই। কারণ প্রযুক্তির ইতিবাচক দিককেই আমাদের সামনে টানতে হবে। সমপ্রতি দেশে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধের অনেক নেতিবাচক দিক দেখা গেছে। বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশুনা ও ব্যবসায়ীদের এক ধরনের হাহাকার আমাদের ভাবিয়েছে। সেই কয়দিনেই বুঝা গেছে কী পরিমাণ মানুষ এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নির্ভর হয়ে পড়েছে। এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অনেক মানুষের এখন ব্যবসায় বাণিজ্য বা অর্থ উপার্জনের সোপান হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এর ওপর যখন খড়গ নেমে আসে তখন তা বৃহত্তর সমাজের ক্ষতিরই কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মূল কথা হচ্ছে ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার জন্য বা অনৈতিক কাজ বন্ধ করার জন্য প্রত্যেকের অ্যাকাউন্ট সিকিউরিটি বৃদ্ধি করা, বিভ্রান্তিকর তথ্য সম্পর্কে একটা নীতিমালা প্রণয়ন, ব্যবহারকারীদের নীতি ও নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করা এবং ফেসবুকের নেতিবাচক দিক বর্জন করার কথা বলাসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের সচেতনতার জাগরণ সৃষ্টি দরকার, যাতে এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণহীন হতে পারে। অভিভাবক ও পরিবারেরও একটি দায়িত্বশীল ভূমিকা থাকা দরকার। যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে নিজেকে যদি জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে এগিয়ে নিতে না পারেন তাহলে এটি সকলের মূল্যবান সময় নষ্ট করার কারণই শুধু হবে এবং নেতিবাচক ব্যবহার সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহৃত হচ্ছে। এর ব্যবহারের জন্য চাই একটি সুশিক্ষিত জনগোষ্ঠী। পৃথিবীর তেমন কোনো দেশে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে বড় ধরনের কোনো সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে তেমন নজির নেই। সঠিক নিয়ম নীতির মাধ্যমে এই মাধ্যম পরিচালিত হওয়া আবশ্যক। এ কথা সত্য যে বর্তমান অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে সত্য তথ্যকে নির্দিষ্ট গণ্ডিতে বেঁধে রাখার সুযোগ নেই। মনে রাখতে হবে এর ব্যবহারের সাথে শিক্ষা ও নৈতিকতারও একটি সম্পর্ক রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে এগুলো নিয়ে ভাববার সময় এসেছে।