বসন্তকালে কোকিলের সুমধুর কুহুধ্বনি শুনতে কার না ভালো লাগে, এ সময় গাছে গাছে নতুন পল্লবের আগমন ঘটে, প্রকৃতি সাজে এক অপরূপ সাজে তাই বসন্ত সবার খুব প্রিয়। আমাদের সমাজে কারও কারও জীবনে সারা বছরই বসন্তের আবহ থাকে তারা খুবই ভাগ্যবান। সুখ সরোবরে এনারা সদা সুখ স্নানে মত্ত থাকে, দুঃখ নামের কালো ছায়া এদের জীবনে কোন রেখাপাত ঘটায় না। সমাজের কিছু কিছু অসঙ্গতি, কিছু কিছু অবাস্তবতা আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাপনে যে বিরূপ প্রভাব ফেলছে সে প্রসঙ্গে আলোচনা করাই এ নিবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য। শ্রেণি বিভাজন, বৈষম্য, নৈরাজ্য, সন্ত্রাস, মাদক, খুন, গুম ইত্যাদি কারণে সমাজ জুড়ে চলছে এক ধরনের চাপা হতাশা ও ক্ষোভ যা থেকে উত্তরণের জন্য চাই সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা, সুশাসন সর্বোপরি একটি সুন্দর দিক নির্দেশনা যা দিতে পারে সমাজ শাসনে যাঁরা নিবেদিত আছেন তাঁরা এবং পরিবার। বিখ্যাত এক মনীষী বলেছেন, একজন ভালো মানুষ গড়তে পারে একটি ভালো পরিবার, তেমনি ভালো পরিবারগুলোর সমন্বয়ে গড়ে উঠতে পারে একটি সুন্দর ও আদর্শ সমাজ আর সে আদর্শ সমাজের বিশাল রূপ হচ্ছে একটি আদর্শ রাষ্ট্র বা দেশ। আমার আলোচনা আজকের কিশোর ও যুব সমাজের দৈনন্দিন জীবন যাপনের কিছু বিষয় নিয়ে। যেহেতু আমি একজন সংগঠক, দীর্ঘ বছর ধরে আমি একটি সংগঠন পরিচালনা করছি যার নব্বুই শতাংশ সদস্যই শিশু কিশোর ও যুবক। একটি সুন্দর দেশ গঠনে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কী করে গড়ে উঠতে হবে সে মন্ত্রণা দেয়া আমাদের সংগঠনের লক্ষ্য। গত অর্ধ শতাব্দী ধরে এ সংগঠন দেশকে উপহার দিয়েছে অনেক অনেক আলোকিত মানুষ। শিশু কিশোররা আবেগ তাড়িত মনোভাবের কারণে অনেক সময় ভালো মন্দের ফারাক বুঝতে পারে না তাই সহজেই তারা বিপথগামী হয়। বর্তমান প্রজন্মের শিশু, কিশোর, যুবকরা যুগের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে আধুনিক প্রযুক্তির সফল ব্যবহারে অভ্যস্ত। তারা অনেক প্রগতিবাদী বলে নিজেদের যাচাই করে। তাদের হাতে হাতে দামি মোবাইল সেট, কানে হেডফোন এসব তো মামুলী ব্যাপার। ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান সহ নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণির প্রায় সন্তানদের সকলেরই একই অবস্থা। তবে ব্যতিক্রম যে নেই সে কথা বলছি না। সৎ সঙ্গে স্বর্গে বাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ একথা শুধু প্রবাদই নয় এর রয়েছে নিগূঢ় বাস্তবতা। সৎ অসৎ চিনতে মেধার প্রয়োজন, যারা সচেতন তারা সহজে চোরা ফাঁদে পা দেয় না। অনেক ছাত্রকে দেখা যায় অবসরে সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত থাকতে। কেউ কেউ খেলার মাঠে, কেউ কেউ পাঠ্য বইয়ে ডুবে গভীর মনোযোগ সহকারে লেখাপড়ায় ব্যস্ত। শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে ষোড়শ খৃষ্টাব্দের প্রখ্যাত ইংরেজ কবি জন মিল্টনের (১৬০৮– ১৬৭৪) একটি উক্তি হলো একজন শিক্ষার্থী তার প্রতিদিনের কাজকে তিন ভাগে ভাগ করবে যেমন পড়ালেখা, খাবার গ্রহণ ও খেলাধুলা। প্রথম দুটি কাজ নিয়ে ছাত্র–ছাত্রীরা মোটামুটি ব্যস্ত থাকলেও খেলাধুলার প্রতি আগ্রহের যে ঘাটতি রয়েছে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। অধিকাংশ ছাত্র–ছাত্রী ব্যস্ত সময় কাটায় ইন্টানেটে কিংবা মোবাইলে ভিডিও গেইম খেলে। কিছু কিছু ছেলে মেয়েদের খেলার মাঠে কিংবা প্রশিক্ষকের কাছে খেলাধুলা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে দেখা যায়, অনেকের আবার বাইরের খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ খুবই কম। অনেক পরিবারের শিশুদের ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে সময় কাটাতে দেখা যায়। ফাস্টফুডের প্রতি এদের তীব্র আকর্ষণ, যার ফলে এরা মুটিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। যে সব পরিবারে ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে সে সব পরিবারের শিশুরা সারাক্ষণ ইন্টারনেট নিয়ে সময় ব্যয় করে। ইন্টারনেট ও মোবাইল আসক্তির কারণে এদের অনেকে দিন দিন মুটিয়ে যাচ্ছে। শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়ামের অভাবে অলসতা ও বিষণ্নতা রোগে ভুগছে এদের কেউ কেউ। ইন্টারনেট তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আধুনিক যুগের এক অতি প্রয়োজনীয় একটি মাধ্যম যার গুরুত্ব অপরিসীম। বহির্বিশ্বের সাথে দ্রুত যোগাযোগ সহ বিভিন্নভাবে এই প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর অপব্যবহার আমাদের শংকিত করে তুলছে এ কারণে যে ছাত্র–ছাত্রীদের কেউ কেউ পর্নোগ্রাফি সহ এর নেতিবাচক দিক গুলোর প্রতি বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে। মোবাইল ফোনেও এসব ডাউন লোড করে অনৈতিক কাজে জড়িয়ে নানা অপরাধের জন্ম দিচ্ছে। বহিরাঙ্গণ কিংবা অন্তরঙ্গন কোন খেলাধুলা এবং সৃজনশীল কোন কিছুতে এদের আগ্রহ নেই। আবার একশ্রেণির কিশোর যুবকদের দেখা যায় রাস্তার পাশে, অলি গলির মুখে কিংবা বাসা বাড়ির ছাদে দল বেঁধে দাঁড়িয়ে থেকে আড্ডা দিতে। অনেক সময় এরা ইভটিজিং এর মত নোংরা আচরণও করে থাকে। আবার অনেকে মাদকের ব্যবহারেও অভ্যস্ত। ধূমপান যেন স্বাভাবিক ব্যাপার। এক অনুসন্ধানে জানা গেছে অলি গলির দোকানের সিগারেটের ৫০ শতাংশ ক্রেতা কিশোর ও যুবকরা। আজ থেকে কিছুদিন আগেও দেখা যেতো সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে ছাত্ররা পড়ার টেবিলে বসে পাঠ্যানুশীলনে ব্যস্ত হয়ে পড়তো, কিন্ত এখন সে চিত্র পাল্টে গেছে, সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে পাড়ার কিছু কিছু ছেলেদের দেখা যায় বন্ধু বান্ধব নিয়ে দলবেঁধে পাড়া মহল্লার অলি গলিতে জড়ো হয়ে আড্ডা দিতে। এদের যদি সঠিক দিক নির্দেশনা ও সুপরামর্শ দিয়ে সুপথে আনা যায় তা হলে দেখা যাবে এদের মধ্যে এমন এমন সব প্রতিভা লুকিয়ে আছে যাদের মেধার পরিচর্যা করলে দেশ ও সমাজ অনেক বেশি উপকৃত হবে। সংবাদ পত্রে ইদানীং প্রায়ই দেখা যায় কিশোর যুবকদের অপমৃত্যু সংবাদ। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সহপাঠি কিংবা পাড়ার বন্ধুদের পিটুনিতে কিংবা ছুরিকাঘাতে এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে অহরহ। এসব ঘটনা অভিভাবক মহলকে কতটুকু বিচলিত কিংবা উৎকণ্ঠিত করে জানি না তবে একজন সমাজ সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি খুবই উদ্বিগ্ন। যে সব ঘটনা ঘটছে তা অত্যন্ত লোমহর্ষক ও মর্মান্তিক। শিশু হত্যা, শিশু ধর্ষণ, শিশু পাচার, শিশু গুম, বলাৎকার এসব যেন নিত্যকার ঘটনা। ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না দু’তিন বছরের শিশুরা পর্যন্ত। এসব ঘৃণ্য অপরাধীদের কেউ কেউ ধরা পড়লেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ায় এর প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। নৈতিকতা, বিবেক কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। মানবিক মূল্যেবোধ ধুলায় গড়াগড়ি যাচ্ছে। এ কোন সমাজে আমরা বাস করছি। এসবে অবসান কবে হবে কেউ জানে না। কোনো কোনো মহল সভা সেমিনারে আকাশ সংস্কৃতির ক্রম বিকাশকে দায়ী করে বক্তব্য রাখলেও এর সমাধানের কোনো সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে পারছেন না। সমাজে অপরাধের ব্যাপকতা যখন বেড়ে যায় তখন কোনো সরকারের পক্ষে তা এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, এর জন্য চাই জনসচেতনতা, সামাজিক সমপ্রীতি ও সৌহার্দ্য গড়ে তুলতে এবং জনে জনে মেল বন্ধন বাড়াতে পাড়া মহল্লার মুরব্বীস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে সন্তানদের ব্যাপারে কঠোর নজরদারী করা। মনে করতে হবে সকলের সন্তান আমার সন্তান। পরের মঙ্গলের চিন্তা যিনি করেন তিনি একজন উত্তম মানুষ পাশের বাড়ির ছেলে উচ্ছন্নে গেলো বলে যারা সমালোচনার আসর করেন তারা নিঃসন্দেহে কখনও ভালো মানুষ হতে পারেন না। প্রয়োজনে ঘরে ঘরে নিয়মিত কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে অভিভাবক মহল তাদের সন্তানদের মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করে অপরাধের ভবিষ্যত পরিণতি সম্পর্কে সজাগ থাকার সুপরামর্শ দিবেন এবং একটি সুনির্দিষ্ট ও সুন্দর লক্ষ্য স্থির করে সে দিকে এগিয়ে যাবার প্রেরণা দিবেন। মনে রাখতে হবে অতি আদর ও অতি শাসন নয়, সন্তানকে বোঝাতে হবে মানুষের জীবন একটাই আর সে জীবনকে রাঙাতে যত সুন্দর ও সৃজনশীল কাজ আছে তার অনুপ্রেরণা দিতে হবে। সন্তানকে বন্ধুর আসনে বসিয়ে সব কিছু তার সাথে শেয়ার করতে হবে। সন্তানের ইতিবাচক দিকগুলোর প্রশংসা করতে ভুলবেন না, পাশাপাশি তার নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরে তাকে সংশোধনের ব্যবস্থা নেবেন। যে ছেলে মেয়ে সারাক্ষণ মা বাবা কিংবা অন্যের দ্বারা সমালোচিত হয় সে নিজের উপর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। মনে রাখতে হবে সন্তানদের সুশিক্ষা দানের একমাত্র পীঠস্থান হচ্ছে পরিবার। পিতা মাতা অভিভাবক সব সময় চেষ্টা করেন তাদের সন্তানকে মানুষের মত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে, যা যা করার সব কিছু করছেন। সন্তান যদি মানুষের মত মানুষ হয় তার সুফল যেমন মাথা পিতা কিংবা অভিভাবক ভোগ করবেন তেমনি দেশ ও সমাজ হবে ধন্য। সারা বছর সকল পরিবারে ও সমাজে বসন্তের আবহাওয়া প্রচ্ছন্ন থাকবে। বিত্তের বসন্ত নয়, চাই চিত্তের বসন্ত, যে বসন্ত মানুষের হতাশা দূর করে আন্দোলিত করবে সারা দেহ মন। দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মকে যদি এ মুহূর্তে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা না যায় তা হলে গোটা সমাজ ও দেশ অমাবস্যার আঁধারে ঢেকে যাবে সন্দেহ নেই। মেধাশূন্য জাতি কখনও বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না, তাই আসুন কালক্ষেপণ না করে সন্তানদের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সবাই সজাগ এবং সতর্ক হই। এটা আমার কোনো উপদেশ নয়, অনুরোধ মাত্র। অনেক রক্তপাত এবং ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এ দেশকে সোনার মানুষের ভাণ্ডারে ভরিয়ে দিতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে এ প্রতিজ্ঞা অন্তরে ধারণ করে শেষ করছি।
লেখক: সভাপতি, নবীন মেলা।