সময়টা নানান রকমের প্রযুক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। প্রযুক্তি আমাদের জীবনের নানান কাজে নানানভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে আর এটার সুবিধাভোগী নারী–পুরুষ শিশু–পূর্ণ বয়স্ক নির্বিশেষে সকলেই। অনলাইন একদিকে যেমন প্রচুর সুযোগ তৈরি করছে, তেমনি বেশকিছু সংকটের মুখেও ফেলছে, বিশেষ করে নারীদের। সামান্য মুঠোফোনের বার্তা থেকে শুরু করে ভিডিও চ্যাট, ডিপফেক ভিডিওর মতো নানান বিষয়ে নারীরা বিপদে পড়ছেন। অনলাইনে বিপদ অনুভব করলে নারীরা যা করবেন তা নিয়েই আজকের এই ফিচার।
জারিনের (ছদ্মনাম) মুঠোফোনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি অ্যাপ আছে। সেই অ্যাপের অ্যাকাউন্টে গত কিছুদিন ধরে অচেনা একটি নম্বর থেকে ক্রমাগত ভিডিও কল আসছে। কিন্তু কল রিসিভ করে না জারিন। এরকমই এক সময়ে অ্যাপের ইনবক্সে একটি ম্যাসেজ আসে এবং সেটি দেখে ভয় পেয়ে যায় জারিন। ভিডিও কল থেকে স্ক্রিন রেকর্ডের মাধ্যমে করা এক ভিডিওতে দেখা যায় তারই ছোট বোনকে, প্রায় বিবস্ত্র অবস্থায়! যা জারিনকে যারপরনাই আতঙ্কিত করে তোলে এবং এর পরপরই সংঘবদ্ধ অপরাধচক্রের ব্ল্যাকমেইলের মুখে পড়ে দুইবোন। এটি একটি উদাহরণ মাত্র। উদাহরণ হলেও; পাঠক, আপনি–আমি সকলেই জানি যে এরকম খবর আমরা হরহামেশাই পত্রিকায় পড়ে থাকি। একটি বেসরকারি সমীক্ষা মতে, বাংলাদেশে অনলাইনে চৌষট্টি শতাংশ নারী সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। সহিংসতার নানান মাত্রায় বিপন্ন হচ্ছে নারীর জীবন।
নানাভাবে নারীরা অনলাইন দুনিয়াতে বিপদে পড়ছেন। একশনএইড বাংলাদেশের একটি সমীক্ষায় দেখা যায় অনলাইনের বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম যেমন ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম, ইমো, হোয়াটসএপ এবং ইউটিউবে নারীরা হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন। পাশাপাশি ভিডিও কল, মোবাইল ফোন এবং এসএমএসের মাধ্যমেও হয়রানির শিকার হয়েছেন নারীরা। সমীক্ষায় আরো দেখা গেছে ঘৃণ্য এবং আপত্তিকর যৌনতাপূর্ণ মন্তব্য, ইনবক্সে যৌনতাপূর্ণ ছবি প্রদান–গ্রহণ এবং যৌন সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব এবং বৈষম্যমূলক মন্তব্যের শিকার হয়েছেন নারীরা। সমীক্ষা থেকে আরও জানা যায়; নারী বলেছেন, যৌন নিপীড়নের সময় তাঁদের ছবি তোলা বা ভিডিও রেকর্ড করা হয়েছে। পরে সেগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা হয়। কেউ কেউ বলেছেন, তাঁদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশের হুমকি দিয়ে তাঁদের ব্ল্যাকমেইল করা হয়। আবার কেউ কেউ বলেছেন, তাঁদের ছবি সম্পাদনা করে পর্নোগ্রাফি সাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। অর্থাৎ নারীকে হেনস্তা করতে চারিদিকে অসংখ্য অনলাইন জাল বিছিয়ে রেখেছে দুর্বৃত্তরা। এখন, নিত্যনতুন প্রযুক্তি বা অনলাইন অ্যাপ আমাদের সামনে আসবেই, এসব থেকে দূরে থাকার উপায় যেমন নেই তেমনি যোগাযোগের এই মাধ্যমগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখলে নারীরা আরও পিছিয়েই পড়বেন, এটুকু আমরা সকলেই জানি। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ থেকে শুরু করে নানান আর্থিক অ্যাপ আমরা ব্যবহার করি। মোবাইল ফোন নির্ভর নানান প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। তাই যেকোনো প্রযুক্তি বা অনলাইন সেবা ব্যবহারের আগে তা সম্পর্কে জানা প্রয়োজন আছে বৈকি। ব্যবহারকারী হিসেবে কোন অ্যাপ ব্যবহার করছেন, সেই অ্যাপ আসলেই বিশ্বস্ত, বৈধ বা নিবন্ধিত কোনো প্রতিষ্ঠানের অ্যাপ কিনা তা জানতে হবে। জেনে ব্যবহার করা শিখতে হবে। কিছু কিছু অ্যাপের মাধ্যমে মোবাইলের ছবি বা অন্যান্য তথ্যাদি বেহাত হওয়ার খবর পাওয়া যায়, তাই সতর্ক থাকতে হবে। কিশোর–কিশোরীদের হাতে মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি তুলে দেয়ার আগে তাদের সাইবার সিকিউরিটির নানান বিষয় সম্পর্কে জানাতে হবে। এখনকার পাঠ্যবইতে এসব বিষয়ে অনেক তথ্যাদি আছে, সে সব জেনে নিতে হবে। প্রয়োজনে স্কুলের আইসিটি শিক্ষকদের কাছ থেকে অভিভাবকেরা সাইবার সিকিউরিটির নানান বিষয় সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন। কোনো কারণে তথ্য চুরি বা ব্ল্যাকমেইলের ঘটনা ঘটলে চুপ করে সয়ে না গিয়ে আইনী সহায়তা নিতে হবে। সাইবার সিকিউরিটি আইনে এখন নারীর তথ্যাদি রক্ষায় বেশ কিছু সম্পূরক আইন আছে, এসব বিষয় জানতে হবে। কোনো কারণে ভিডিও বা ছবি সংক্রান্ত নির্যাতনের মুখে পড়লে ঘটনাটি লুকিয়ে রাখবেন না, ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টায় যাবেন না বরং সরাসরি স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। তাছাড়া নিজের সুরক্ষা যেহেতু নিজের হাতেই তাই মোবাইলে কোন অ্যাপ ব্যবহার করছেন, কোন ধরনের অ্যাপ থেকে তথ্য চুরি হয় তা জেনে ব্যবহার করুন। উন্মুক্ত স্থানের নেটওয়ার্ক সুবিধা বা ওয়াইফাই বা উন্মুক্ত চার্জার পয়েন্ট ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে। উন্মুক্ত স্থানে মোবাইল ফোন চার্জে দিয়ে ফোন সেটের আশপাশেই থাকতে হবে। পাশপাশি মোবাইল বা ল্যাপটপে অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহার করাটাও জরুরী। আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হরহামেশাই নানান ধরনের ব্যক্তিগত ছবি ও তথ্যাদি প্রকাশ করি। এসব ছবি ও তথ্যাদি প্রকাশে সতর্ক থাকুন। কিশোর–কিশোরী ও নারীদের এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। শুধু স্ট্যাটাস হিসেবে নয়, মেসেজের বার্তায় কোন ধরনের তথ্যাদি দিচ্ছেন তা খেয়াল রাখুন। যেকোনো সময় তথ্য চুরির সম্ভাবনা আছে, তাই সাবধানে থাকুন। স্ক্রিনে যা দেখছেন বা পড়ছেন তা–ই বিশ্বাস করবেন না। ইন্টারনেট দুনিয়াতে আমরা যা দেখি, তার সব সত্যি নয়। এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও ডিপফেকসহ নানান প্রযুক্তির কারণে ফাঁদে পা দেওয়ার সুযোগ থাকে। অতএব যা দেখছেন তা সহজে, দ্রুত সময়ে বিশ্বাস করবেন না। অনলাইনে সহজে প্রতারণার সুযোগ থাকে। কেউ অর্থ চাইলে, ফোন করে কোনো অ্যাপের পিন বা পাসওয়ার্ড চাইলে তা কখনই শেয়ার করবেন না। তদুপরি বিপদ পড়লে যা নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল টোলফ্রি হেল্পলাইন ১০৯ থেকে সহায়তা নিতে পারেন। এছাড়াও পুলিশের ৯৯৯ সহায়তা লাইন থেকেও যেকোনো বিপদে সহায়তা নিতে পারছেন।