১ অক্টোবর বিশ্ব প্রবীণ দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি যথাযথ মর্যাদার সাথে পালিত হয়। দিবসটি আসলে সবার টনক নড়ে, বলে উঠে প্রবীণ দিবসে র্যালিতে যেতে হবে, সেমিনার, উপস্থিত হতে হবে। আর সারাটা বৎসর কেউ খোঁজ নেয় না, কোথায় কেমন আছে মোট জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ এই প্রবীণরা। পরিসংখ্যানে বলে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বর্তমান সংখ্যা ২ কোটির উপর। বাংলাদেশে ৬০ বছর ও তদূর্ধ্ব ব্যক্তিদের সিনিয়র সিটিজেন বা জ্যেষ্ঠ নাগরিক হিসাবে গণ্য করা হয়। অথচ খুব পরিতাপের বিষয় এই বিরাট জনগোষ্ঠীর জন্য। সরকারি বা বেসরকারিভাবে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রকার ব্যবস্থাপনা নেই। অনেক ক্ষেত্রেই তারা ভাসমান, অবহেলিত ও কোন কোন ক্ষেত্রে নির্যাতিত। মানব জীবনের শেষ ভাগ বার্ধক্য যেটা চ্যালেঞ্জিং বটে। অনেক পরিবারে তারা বিভিন্নভাবে অবহেলিত।
বিদেশের দিকে তাকালে এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশের দিকে তাকালে দেখি সিনিয়র সিটিজেনদের অনেক প্রকারের সুযোগ–সুবিধা, ব্যবস্থাপনা সরকারিভাবে করা আছে। বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ২ জুন ২০২৫ তারিখে ২০২৫–২৬ অর্থ বছরের ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছে। সেই বাজেটে প্রবীণ গোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা, অধিকার ও জীবনমান উন্নয়নের জন্য কোন বরাদ্দ বা পরিকল্পনা রাখেনি। অনেকেই জ্ঞাত আছেন ৬০ লক্ষ প্রবীণ মাসে ৬০০ টাকা করে বয়স্ক ভাতা পান। কিন্তু এই ভাতা কিভাবে প্রদান করা হয় অনেকেই জানেন না। এই দুর্মূল্যের দিনে এই পরিমাণ টাকা হাস্যকর ছাড়া কিছুই নয়। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় পুরুষদের চেয়ে প্রবীণ নারীরা দুঃখ, কষ্ট ও বিড়ম্বনার শিকার হয় সবচেয়ে বেশি। তারা অসহায়। বৃদ্ধ বয়সে তারা বিভিন্ন ধরনের রোগ ব্যাধিতে ভোগে। এদের খোঁজ খবর পরিবারেও বেশি রাখে না। এখন বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা ও ওষুধের তিনগুণ চড়া দাম, চিকিৎসা করাটাও দুঃসাধ্য। চিকিৎসা করলেও সেটা শেষ পর্যন্ত চলমান রাখা যায় না। তাই অসমাপ্ত চিকিৎসায় দেখা দেয় সংক্রমণ এবং বিভিন্ন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় রোগী মারা যায়। এর ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে। বর্তমান ২০২৫–২৬ অর্থ বছরে প্রবীণদের ভাতা বাড়িয়ে ৬৫০ টাকা করা হলো যেটা অমানবিক বটে। সুতরাং সরকারিভাবেও প্রবীণরা দারুণভাবে অবহেলিত ও বঞ্চিত।
অথচ একটু চিন্তা করলে বা এদের কথা যারা ভাবেন বুঝবেন এই প্রবীণরা তাদের বিগত জীবনে বড় বড় অফিস–আদালতে মিল কারখানায় বিদেশী চাকরিতে বড় বড় প্রজেক্টে। দেশের সার্বিক উন্নয়নে সুনামের সহিত কত কাজ করেছেন। তারাইতো নবীনদের পথপ্রদর্শক, নির্দেশক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন। অথচ একমাত্র বয়সের কারণে আজ তারা অবহেলিত। তাদের হাতেই গড়ে উঠেছে হাজার–লক্ষ প্রতিষ্ঠান। তাদের প্রতি অবজ্ঞা, অমর্যাদা মৃত্যুর সমতুল্য। মনে ধারণ করা উচিত বেঁচে থাকলে সবায়কে এ বয়সে পার করতে হবে। প্রতিটা সরকার প্রবীণদের ব্যাপারে কোন প্রকার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি বলেই ব্যর্থ। তাদের সমস্যাগুলো দেখভাল করার জন্য পৃথক প্রবীণ মন্ত্রণালয় গঠন করতে পারেনি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের তথ্যানুসারে ২০৩০ সালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ হবেন প্রবীণ ২০৫০ সালে সেটা দাঁড়াবে প্রায় ৪ কোটি ৫০ লক্ষ। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে। কিন্তু সরকার প্রবীণ জনগোষ্ঠীর কথা একবারও ভাবেনি। ২০১৩ সালে ‘প্রবীণ–নীতিমালা’ প্রণয়ন করেছিল। প্রণয়ণের এক যুগ পেরিয়ে গেলেও বাস্তবায়ন হয়নি। লক্ষ্য করবেন দেশে মেধাপাচারের হিড়িক পড়ে গেছে। মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত কলেজ পড়ুয়া সন্তানেরা বিদেশে লেখাপড়া ও চাকরির করার জন্য পাড়ি জমাচ্ছে। কথা হলো, যে পিতামাতার একটা বা দুটা সন্তান আছে তারা খুব বিপদে আছে। বৃদ্ধ পিতামাতা একেবারে একা হয়ে গেল। তাদের দেখাশুনার কেহ নেই। ছেলে কখন আসবে তাও ঠিক নেই। অসুস্থ মা–বাবা, ডাক্তার ডাকার লোক নেই। এক গ্লাস পানিও নিজে নিয়ে খেতে হয়। এমনও ঘটনা আছে ঘরের ভেতর কবে মরে আছে কেহ জানে না, পঁচা–গন্ধ বাহির হওয়াতে পুলিশে খবর দেওয়া হলো। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে প্রায় দেখি, ছেলে শহরে চাকরি করে, বউ নিয়ে বাসায় থাকে। সেখানে যদি মা বাবা থাকেন কিছুদিনের মধ্যে তাদের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু হয়। নির্যাতনকারী ছেলের বউ একসময় তাদেরকে ঘর থেকে বের করে দেয়। শহরে ছেলেকে দেখার জন্য প্রবীণ পিতামাতা গ্রাম থেকে আসলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। দেখা গেছে শিক্ষিত পয়সাওয়ালা ঘরের কিছু ছেলে বউয়ের প্ররোচণায় পিতা–মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়। ছেলে যখন তার বৃদ্ধ পিতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাচ্ছে সাথে দিচ্ছে দুইটা কম্বল, পাশে থাকা তার ছেলে বাবাকে বলছে একটা কম্বল রেখে দাও। বাবা জিজ্ঞেস করলো কেন? তখন বৃদ্ধের নাতি বল্লো ঐটা তোমার জন্য। তোমাকেও আমি বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবো। প্রায়শই দেখা যায় অনেক প্রবীণ ব্যক্তি জীবন জীবিকার জন্য কাজ করে। বহু পরিবারে দেখা যায় বৃদ্ধ মা খুব ভোরে উঠে নামাজ–কালাম পড়ে। বাড়ির আসবাবপত্র দেখে, রান্না ঘরে যায়।
অথচ তারা পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদা পায় না। আমাদের দেশে সরকারিভাবে বৃদ্ধাশ্রম তেমন নেই। বেসরকারিভাবে যেগুলি আছে সেই গুলি অপর্যাপ্ত। বৃহৎ আকারে একটা প্রতিষ্ঠান আছে সারা দেশে যার ৯২ টা শাখা রয়েছে। সম্মানের সাথে প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে বলতে চায় আাপনাদের সঞ্চয় শেষ অবদি হাতছাড়া করবেন না। শেষ সম্বল সম্পত্তি লিখে দিবেন না। তবেই এই বয়সেও আত্মমর্যাদা নিয়ে পরিবারে, সমাজে বাস করতে পারবেন। প্রবীণদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্বন্ধে জনগণকে জানানো ও মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা রয়েছে। পেনশন তুলতে গেলে, হাসপাতালে, হাটবাজারে, মজলিশে, দাওয়াতে, সমাবেশে, উৎসবে বিভিন্ন স্থানে চলাচল সড়ক পাড়াপাড়ে। যানবাহনে অফিস আদালতে সর্বত্রই প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সহনশীল আচরণের জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি। তাদের জন্য পৃথক পরিচয় পত্র সরকারিভাবে দেওয়া হোক। আহ্বান থাকবে প্রবীণদের জন্য অতি দ্রুত মন্ত্রণালয় গঠন করা হোক। তবে মনে রাখতে হবে প্রবীণদের সুযোগ সুবিধা প্রদান, কারো করুণা বা দয়া নয়, এটা তাদের মৌলিক অধিকার।
লেখক: প্রাক্তন চিফ অ্যানাসথেসিও লজিস্ট,
বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।