আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস আজ। বাংলাদেশে প্রবীণ অধিকার সুরক্ষার বিষয়ে আজ নানা কর্মসূচি পালিত হবে এবং তাঁদের জন্য সুযোগ অবারিত করার সংকল্প গ্রহণ করা হবে। প্রবীণরা সমাজে সম্মানিত ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। সভ্যতার উন্নয়ন–অগ্রযাত্রায় তাদের অবদান অনস্বীকার্য। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উৎকর্ষ ও আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতির কারণে দেশে প্রবীণের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ বলে জানা গেছে।
পত্রিকায় প্রকাশিত নানা তথ্যে জানা গেছে, দেশে সার্বিক অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি হয়েছে। ফলে মানুষ দীর্ঘায়ু হচ্ছে। এতে ক্রমশ বাড়ছে প্রবীণ নারী ও পুরুষের সংখ্যা। ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে প্রবীণের সংখ্যা দাঁড়াবে মোট জনসংখ্যার এক–পঞ্চমাংশের বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রবীণদের জন্য আইন ও বিধিমালা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে একটি সাহসী আইন আছে যে আমরা মাতাপিতাকে অবহেলা করতে পারব না। সুতরাং আমরা সঠিক পথে আছি। যেসব সমস্যা আছে, সেগুলো সরকার পর্যায়ক্রমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধান করবে।
বিসিক–এর সাবেক মহাব্যবস্থাপক মনজু আরা বেগম তাঁর এক লেখায় বলেছেন, প্রতি বছরই প্রবীণ দিবসে নতুন নতুন প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এর কতটুকু প্রয়োগ করা হয়? প্রকৃতপক্ষে পরিবার ও সমাজে প্রবীণদের বোঝা মনে করা হয়। তাদের সম্মান, মর্যাদা কিংবা কষ্টের কথা কেউ ভাবেন বলে মনে হয় না। অথচ প্রবীণদের মেধা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আগামী দিনগুলো তাদের সঙ্গে নিয়ে চলতে পারলে পরিবার, সমাজ, সর্বোপরি দেশ অনেক বেশি উপকৃত হতে পারত। প্রতি বছরই তো দিবসটির প্রতিপাদ্য তুলে ধরা হয়। কিন্তু ওই একটি দিনেই তা সীমাবদ্ধ থাকে। প্রবীণরা পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রে কতটুকু নিরাপদ বা সুস্থ–স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন, এ খবর ক’জন রাখেন? প্রবীণরা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত হচ্ছেন। আমাদের দেশে প্রবীণের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি।
বিপুলসংখ্যক এ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য জাতিসংঘ তাগিদ দিয়েছে। বিগত বছরে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সভায় বিশ্ব অর্থনীতির পাঁচটি ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে। এ পাঁচটি ঝুঁকির একটি হচ্ছে প্রবীণ জনগোষ্ঠী। কিন্তু এ ঝুঁকি মোকাবেলার বিষয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আমরা তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখছি না। উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশে প্রবীণদের জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসুবিধা ও সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম না থাকায় এ দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যায় ভুগছে। তারা জীবনধারণের মৌলিক সুযোগ–সুবিধা থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছেন।
বিশ্বব্যাপী জন্মহার কমেছে। স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন হয়েছে। ফলে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। হেল্পএইজ ইন্টারন্যাশনালের এইজওয়াচ ইনডেক্স ইনসাইট রিপোর্ট ২০১৫ অনুসারে বিশ্বে প্রায় ৯০১ মিলিয়ন প্রবীণ মানুষ আছেন।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রবীণের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ। ২০৫০ সাল নাগাদ বয়স্ক মানুষের সংখ্যা আরও ব্যাপকভাবে বাড়বে। এ বিশালসংখ্যক প্রবীণকে মানবিক জীবনযাপনের সুযোগ দেওয়ার মতো রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক প্রস্তুতি কতটুকু– সে–বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, বিশ্বব্যাপী ৪৭ শতাংশ প্রবীণ পুরুষ ও ২৪ শতাংশ প্রবীণ নারী অনানুষ্ঠানিক শ্রমশক্তিতে অবদান রাখছেন। বাংলাদেশে এ সংখ্যা ৬৪ শতাংশ। নারীর ক্ষেত্রে এ সংখ্যা আরও বেশি। দক্ষিণ–পূর্ব আফ্রিকায় ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ দুস্থ ও অসহায় শিশুর যত্ন করছেন দাদা–দাদীরা। বাংলাদেশেও দাদা–দাদী শিশুদের যত্ন নেন। কিন্তু তাঁরা কেউ স্বীকৃতি পাচ্ছেন না। প্রবীণদের সেকেলে বলার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের ৫৩ শতাংশ প্রবীণ ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী ৬০টি দেশে ষাটোর্ধ্ব প্রবীণের সংখ্যা হবে ৩০ শতাংশ। প্রবীণসংক্রান্ত বিষয়ে কাজ করা মানে নিজের প্রবীণ জীবনকে সুরক্ষিত করা। সামগ্রিক ও সমন্বিত উদ্যোগকে ত্বরান্বিত করা। প্রবীণদের নিয়ে শুধু প্রবীণেরা নন, তরুণদেরও কাজ করতে হবে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশ প্রবীণবিষয়ক বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। প্রবীণেরা বিপদাপন্ন, দারিদ্র্যের শিকার ও একাকিত্বে জর্জরিত। সরকারি সেবা কার্যক্রমে প্রবীণদের প্রবেশগম্যতা সীমিত। প্রবীণেরা সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবারের বিভিন্ন পর্যায়ে বৈষম্যের শিকার। এর কারণ হলো মানুষের মর্যাদা, সম্মান ও ভালোবাসাপ্রাপ্তির মানদণ্ড হিসেবে আয়ের বয়সসীমাকে মনে করা। এ ক্ষেত্রে তাঁদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবলয় তৈরি করতে হবে। বয়স্কদের জন্য প্রবীণ ফাউন্ডেশন গঠন করা জরুরি। তাঁদের জন্য সরকারি বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা দরকার। প্রবীণদের জন্য সরকার যে সর্বজনীন পেনশনের কর্মসূচি চালু করেছেন, তা এককথায় অনন্য। এভাবে নিজের প্রবীণ জীবন সুরক্ষার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা উচিত।