প্রবাহ

হযরত তৈয়ব শাহ (রহ.) ও চট্টগ্রামে তাঁর অনুভূতি

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৩১ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৮:৫১ পূর্বাহ্ণ

হযরত মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ (রহ.)। পাকিস্তানের চিরকুট জন্মস্থান হলেও এই দেশে তার মহান পিতা ও তাঁর মাধ্যমে বিশাল খেদমত রয়েছে। বর্তমানে তাঁর দুই ছাহেবজাদা হযরত তাহের শাহ ও হযরত ছাবের শাহ পাকিস্তান থেকে এদেশে আসাযাওয়া করতেছেন পিতার দাদার রেখে যাওয়া যাবতীয় কিছু তদারক করতে, করতে খেদমত।

১৯৭০ এর দশকে হযরত সৈয়দ তৈয়ব শাহ (রহ.)’র এর সাথে আমার ন্যূনতম যোগাযোগ সম্পর্ক ছিল। পরবর্তীতে তাঁর মহান ছাহেবজাদা হযরত তাহের শাহ এর সাথে কম বেশি সম্পর্ক বিরাজমান।

হযরত সৈয়দ তৈয়ব শাহ (রহ.)’র মহান পিতা হযরত সৈয়দ আহমদ সিরিকোটী (রহ.) এ দেশে আগমন করেন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাতাসহ তরিকা ভিত্তিক নানাভাবে খেদমত করতে। তার মুরিদগণের মধ্যে অন্যতম দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক, নূর মুহাম্মদ সওদাগর আলকাদেরী, জাকের হোসেন কন্ট্রাকটর, তবিবুল আলম আবু মিয়া, আবদুল জলিল সওদাগর, আকরম খান, উজির আলী সওদাগর, নাজির আলী, সিরাজুল হক, আমজাদ আলী, রাঙ্গুনিয়া সুফি ছাহেব, নুরুল ইসলাম সওদাগর, হাজী শেখ আফতাব উদ্দিন আহমদ, মাওলানা হাবিবুর রহমান অন্যতম।

মরহুম জাকের হোসেন কন্ট্রাকটরের প্রথম পুত্র বিয়ে করেন মরহুম নূর মুহাম্মদ সওদাগরের কন্যাকে। তার সাথে আমার মোটামুটি সম্পর্ক থাকলেও তাঁর সহোদর ছোট ভ্রাতা আলহাজ্ব নুরুল ইসলামের সাথে সম্পর্ক অত্যধিক বেড়ে যায়। তার মূলে হজ্বের পাশাপাশি একসাথে বিদেশে সফর। বিশেষ করে হজ্বের পাশাপাশি ভারত, উজবেকিস্তান, তুরস্ক, মিশর সফর অন্যতম। আগামীতে আরও অন্যান্য দেশে সফরের পরিকল্পনা চলমান। সাধারণত সফরে সহযাত্রীগণের মধ্যে নানান কথা, আলাপ আলোচনা হয়ে থাকবে স্বাভাবিক।

আলহাজ্ব নুরুল ইসলাম তার জীবনের প্রসঙ্গ টানতে গিয়ে তাঁর পিতার পীরজাদা হযরত সৈয়দ তৈয়ব শাহ (রহ.) কে নিয়ে আমাকে নানা বিষয় অবগত করাতে থাকেন। আমিও খুব আগ্রহ ভরে তার নানা স্মৃতি শুনতে থাকি।

. হযরত সৈয়দ তৈয়ব শাহ (রহ.) স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭৬ সালের দিকে পুণঃ বাংলাদেশ সফরে আসেন। তাঁর পিতা দেশের বিখ্যাত ঠিকাদার। মার্সিডিজ বেনজ কার, জিপসহ একাধিক ব্যক্তিগত গাড়ি রয়েছে। ঐ সময় দেশে ব্যক্তিগত গাড়ির মালিক হাতেগোনা। হযরত সৈয়দ তৈয়ব শাহ (রহ.) জিপে করে বিমান বন্দর থেকে আসবেন ঠিক হয়। সে লক্ষে জিপের চাদ খুলে ফেলা হয়। পিতা চাচ্ছেন বিমান বন্দর থেকে তার পুত্র আলহাজ্ব নুরুল ইসলাম গাড়ির ড্রাইভ করে নিয়ে আসুক। টকটকে যুবক ২য় পুত্র গাড়ি চালনায় সিদ্ধহস্ত। পিতা তরিকত করেন নিজের তেমন অনুভূতি নেই। ফলে পিতা হতাশ হৃদয়ে ড্রাইভার দ্বারা গাড়ি চালিয়ে বিমান বন্দরে পৌঁছেন।

হঠাৎ ইসলাম সাহেবের মন পরিবর্তন হয়ে যায়। তিনি অন্য যানবাহনে করে পতেঙ্গা বিমান বন্দরে পৌঁছে যান। পিতা খুবই খুশি হলেন। যেহেতু পিতা চাচ্ছেন তার পীরজাদাকে তার সন্তান গাড়ি চালিয়ে নিয়ে আসুক। পতেঙ্গা বিমান বন্দর থেকে ভৈলারদীঘিপাড় নূর মুহাম্মদ সওদাগর আল কাদেরীর বাড়ি ও খানকাহ পর্যন্ত অসংখ্য গেইট নির্মাণের পাশাপাশি এ সিলসিলার সকলের মাঝে অতি উৎসাহ আনন্দ উদ্দীপনা বিরাজ করবে স্বাভাবিক। জিপের সামনের সিটে ভিতর দিকে বসলেন মরহুম নূর মুহাম্মদ সওদাগর আল কাদেরী, বাহির সাইডে বসলেন হযরত তৈয়ব শাহ (রহ.)। পিছনের সিটে বসলেন তার পিতা মরহুম জাকের হোসেন কন্ট্রাকটর, হাজী জাকারিয়া, হাজী জালাল, হাজী আমিনুল ইসলাম, হাজী ইয়াকুব, হাজী সালেহ আহমদ সওদাগর।

পতেঙ্গা বিমান বন্দর থেকে গাড়ি বহরের সাথে হযরত তৈয়ব শাহ (রহ.)’র বহনকারী জিপ শহরের দিকে রওনা দিলে তার সম্মানে একাধিক গেইট অতিক্রম করার পর হযরত সৈয়দ তৈয়ব শাহ (রহ.) পাশে বসা মরহুম নূর মুহাম্মদ সওদাগর থেকে জানতে চাচ্ছেন এই রকম গেইটগুলো করতে কত টাকা খরচ পড়ে। তখন মরহুম নূর মুহাম্মদ সওদাগর উত্তরে বলতেছেন গেইটের মান অনুপাতে টাকা ব্যয়। হয়ত টাকার অংকও আন্দাজ করে বলেছেন। তখন হযরত তৈয়ব শাহ (রহ.) বলতেছেন আমার সম্মানে এই রকম গেইট নির্মাণ করে টাকা নষ্ট না করে টাকাগুলো মাদ্রাসায় দিলে কতই না উত্তম হত।

. হযরত তৈয়ব শাহ (রহ.) ভৈলারদীঘিপাড়স্থ মরহুম নূর মুহাম্মদ সওদাগরের বাড়ি ও খানকায় অবস্থান নেন। ইসলাম সাহেবের আপন ভাবির বাপের বাড়ি। কাজেই সহজ যাওয়া আসা রয়েছে। এতে তিনি তরিকতের প্রতি অতি অনুরাগী না হলেও অনেক কিছু লক্ষ্য করতেছেন। লোকজন পায়ে ধরে সালাম করতে চাইলে হযরত তৈয়ব শাহ (রহ.) খুবই অপছন্দ করতেন। বলতেন আগে পিতা মাতাকে সম্মান কর তারপর অন্য কেউ।

. তাঁর পিতা পীরজাদা হযরত তৈয়ব শাহ (রহ.) কে একটি সেরওয়ানী সেলাই করে দেন। এতে হযরত তৈয়ব শাহ (রহ.) বলেন, টাকা খরচ করে আমাকে সেরওয়ানী সেলাই করে না দিয়ে এই টাকাটা মাদ্রাসায় দিলে কতই না ভাল হত।

. হযরত তৈয়ব শাহ (রহ.) চট্টগ্রামে অবস্থানকালীন মানুষ অসংখ্য টাকা হাদিয়া দেয়। সমস্ত টাকা মরহুম নূর মুহাম্মদ সওদাগরের নিকট রক্ষিত থাকে। চট্টগ্রাম থেকে বিদায় নেওয়ার আগে মরহুম নূর মুহাম্মদ সওদাগর হযরত তৈয়ব শাহ (রহ.)’র কক্ষে এনে দেন। তিনি সমস্ত টাকা মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বন্টন করে দেন প্রাপ্ত সব টাকা ইসলাম সাহেবের সামনে।

একাধিক দেশে সফরকালে ইসলাম সাহেব আমাকে হযরত তৈয়ব শাহ (রহ.)’র প্রত্যক্ষ কারামতের বর্ণনাও দেন।

বস্তুতঃ হযরত তৈয়ব শাহ (রহ.) ১৯১৬ সালে পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মহান পিতা মায়ানমার থেকে এখানে এসে কাদেরিয়া তরিকার বিশাল খেদমত করে যান। আল্লামা হাফেজ কারী সৈয়দ আহমদ শাহ চিরকুটী (রহ.) ১৯২০১৯৩৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৬ বছর মায়ানমারের রেঙ্গুনে এবং ১৯৩৬১৯৫৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বিশেষ করে চট্টগ্রামে প্রত্যন্ত এলাকায় কাদেরিয়া তরিকার শিক্ষা ও ধর্ম প্রচার প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকাপালন করে গেছেন।

১৯৫৮ সালে পিতার সাথে হযরত তৈয়ব শাহ চট্টগ্রাম সফর করেন। আন্দরকিল্লাহস্থ কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের উপরের তলায় দৈনিক আজাদী প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক সাহেব এর বাসভবনে অবস্থান করতে থাকেন।

তাঁর মহান পিতা হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটী (রহ.) ১৯৬১ সালে ২৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ইন্তেকাল করেন।

ইন্তেকালের পরপর জুন মাসে হযরত তৈয়ব শাহ (রহ.) চট্টগ্রাম আগমন করেন ইছালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে। ১৯৬১১৯৭০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর বাংলাদেশ সফর করেন। ১৯৭৬১৯৮৬ সাল পর্যন্ত পুনরায় প্রতি বছর বাংলাদেশ সফর করেন।

হযরত তৈয়ব শাহ (রহ.) ১৯৯৩ সালের ৭ জুন সোমবার সকালে ৭৭ বছর বয়সে পাকিস্তানে ইন্তেকাল করেন।

হযরত তৈয়ব শাহ (রহ.) তরিকতের খেদমত করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। তৎমধ্যে বাংলাদেশ, ইরাক, ভারত, মায়ানমার, ইরান, আফগানিস্তান, ব্রিটেন, রাশিয়া অন্যতম।

মূলতঃ ১৯৬০ এর দশকে ছাত্রজীবনে আমার গারাংগিয়া বড় হুজুর কেবলা কুতবুল আলম সুলতানুল আউলিয়া হযরত আলহাজ্ব শাহ মাওলানা আবদুল মজিদ (রহ.)’র নিকট মুরিদ হওয়ার সৌভাগ্য হয়। তিনি ছিলেন সকল মতাদর্শের শ্রদ্ধাভাজন। ১৯৭৭ সালে আমার পীর ছাহেব কেবলা ইন্তেকাল করলে তাঁরই অনুজ সহোদর ছোট ভ্রাতা হযরত ছোট হুজুর কেবলার সান্নিধ্য লাভ করতে থাকি। নিতে থাকি উভয় হুজুর কেবলাদ্বয় থেকে ছবক তওয়াজ্জুহ।

আমার পীর ছাহেবের আকিদা হল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত সুন্নি মতাদর্শে বিশ্বাসী। তবে সকল মতাদর্শের সাথে ন্যূনতম হলেও সহবস্থানে থাকা, কাউকে মন্দ না বলা, যতটুকু সম্ভব সকলকে সম্মান দেখানো।

হযরত সৈয়দ তৈয়ব শাহ (রহ.) ও তাঁর মহান পিতা হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটী (রহ.) আমাদের দেশে দ্বীনি খেদমত করে গেছেন। প্রতিষ্ঠা করে গেছেন অনেক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানাদী। পরবর্তীতে তাঁর ছাহেবজাদাগণের এই দেশে আসাযাওয়া জারি রেখেছেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধলোহাগাড়ায় চেয়ারম্যান সমিতির নতুন কমিটি গঠন