প্রবাহ

হযরত মঈন উদ্দিন চিশতির লাহোর দাতাগঞ্জে বখ্‌শ (রহ.)’র মাজারে যাত্রাবিরতি

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ১৭ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৬:৪৫ পূর্বাহ্ণ

গঞ্জে বখ্‌শে ফয়েজে আলম মজহারে নূরে খোদা! নাকে সারা পীরে কামেল কামেলারা রাহনুমা!” অর্থাৎ দানের ভাণ্ডার, জগতের জ্যোতি, আল্লাহর নূরের বহিঃপ্রকাশ; (তরিকতে) অনভিজ্ঞদের জন্য পীরে কামেল, অভিজ্ঞদের জন্য পথ প্রদর্শক।

উক্ত পংক্তি গরীবে নওয়াজ হযরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি (রহ.) লাহোরে হযরত দাতাগঞ্জে বখ্‌শ (রহ.)’র মাজার থেকে বিদায়কালীন সময়ে পাঠ করেন।

৬ রজব সুলতানুল হিন্দ গরীবে নওয়াজ আজমীরি (রহ.)’র ওফাত বার্ষিকী। তাঁকে ভারতবর্ষের সুলতান বলা হয়; অর্থাৎ সুলতানুল হিন্দ। মহান সাহাবাগণ থেকে শুরু করে অনেকে ভারতবর্ষে আগমন করে থাকলেও সুলতানুল হিন্দ হযরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতির মাধ্যমে মহান আল্লাহ পাক ভারতবর্ষে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করায়েছেন বলে স্বীকৃত। তিনি পবিত্র মক্কা থেকে যেয়ারতের উদ্দেশ্যে পবিত্র মদিনা গমন করেন। পবিত্র মদিনায় রওজাপাকে যেয়ারতকালীন নবী পাক (.) কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষে আসতেছিলেন। গরীবে নওয়াজ কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকীকে সাথে নিয়ে ১১৮৯ সালে পবিত্র মক্কায় পৌঁছেন এবং হজ্ব করেন। অতঃপর পবিত্র মদিনায় চলে আসেন। যেয়ারতে, এবাদতে সময় অতিবাহিত করতে থাকেন।

খায়ারুল আকতার গ্রন্থ থেকে উল্লেখ্য, নবী পাক (.) তাকে মঈন উদ্দিন অর্থাৎ দ্বীনের সাহায্যকারী হিসেবে সুসংবাদ দেন। মূলত তাঁর মূল নাম ‘হাসান’ হলেও তা হারিয়ে গিয়ে মঈন উদ্দিন নামটি বিশ্বব্যাপী প্রকাশ পেয়ে যায়। নবী পাক (.) তাঁকে হিন্দুস্থানের ওলায়ত দান করেছেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। এক মতে, নবী পাক (.)’র নির্দেশনায় হিন্দুস্থানের সাথে আজমীরের নামও উল্লেখ রয়েছে বলে জানা যায়। হযরত গরীবে নওয়াজ এই ধরনের সুসংবাদ প্রাপ্ত হয়ে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা আরও বেড়ে যায়। তিনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন। আজমীরের অবস্থান তার জানা ছিল না। তা কোথায়, পবিত্র মদিনা থেকে কতদূরে সবকিছু অজানা। হযরত গরীবে নওয়াজ পবিত্র মদিনা হতে বাগদাদে আসেন। কিছুদিন অবস্থান করেন। অতঃপর তিনি চিশতি, শিকান, জুহনা, কিরমান, আস্তারাবাদ হয়ে বোখারা পৌঁছেন।

বোখারা থেকে তাব্রীজ, ইস্পাহান, হারাত, সবজাওয়ান পৌঁছেন। এই শহরের শাসনকর্তা ছিলেন ইয়াদগারে মুহাম্মদ। অতঃপর আসেন বলখে। বলখ এর আগে বা পরে সমরকন্দ হয়ে লাহোর পৌঁছেন।

লাহোরে শায়িত রয়েছেন হযরত দাতাগঞ্জে বখ্‌শ (রহ.)। মাজার মসজিদসহ লাহোর মহানগরীর বুকে তাঁর বিশাল মাজার কমপ্লেক্স। এই মহান সাধকের মূল নাম হযরত সৈয়দ আবুল হাসান আলী (রহ.)। হিজরি ৪ শত সনে (১০০৯ সালে) গজনীর নিকটতম স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্ব পুরুষের পরিচয় হল হযরত সৈয়দ আবুল হাসান আলী ইবনে সৈয়দ আজগর ইবনে সৈয়দ জায়েদ শহীদ ইবনে হযরত ইমাম হাসান (.)

ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, হযরত দাতাগঞ্জে বখ্‌শ (রহ.) তাঁর যুগের প্রধান কুতুব দরবারে ইলাহীর সমস্ত দ্বার সম্মন্ধে তথ্য জ্ঞানী ছিলেন। তিনি যুগের একচ্ছত্র ইমাম তাসাউফ এর মৌলিক বিষয় তৎসম্পর্কীয় এলমে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। জগৎ বিখ্যাত ‘কাশফুল মাহ্‌জূব’ নামক তাসাউফের কিতাবটি হযরত দাতাগঞ্জে বখ্‌শ (রহ.)’র অতি উচ্চাঙ্গের রচনা। তাঁর রচিত কিতাবসমূহ থেকে অসাধারণ এলমি ও দ্বীনি যোগ্যতার পরিচয় পাওয়া যায়। শরীয়তের এলেম হাসিল করার পর তিনি এলমে তরিকত হাসিল করার জন্য আজারবাইজান, খুজেস্তান, বাগদাদ, শাম, দামেস্ক, তুস, তুর্কিস্থান ইত্যাদি অনেক ইসলামী রাজ্য সফর করেন। প্রত্যেক দেশের শ্রেষ্ঠ ওলামা ও আউলিয়ায়ে কেরামের নিকট থেকে ফয়েজ লাভ করেছিলেন।

তিনি প্রাচীন জনপদে ঘুরেফিরে শরীয়ত ও তরিকতের এলম হাসিল করে লাহোরে এসে বসবাস শুরু করেন। তখন ছিলেন সুলতান মাহমুদ গজনবীর পুত্র নাসির উদ্দিন মাসউদ এর (১০৩০১০৪০) সময়। এই নাসির উদ্দিনের পুত্র জহিরুদ্দৌলা তার মাজার নির্মাণ করেন।

হযরত খাজা নেজাম উদ্দিন (রহ.) বর্ণনা করেন, হযরত দাতাগঞ্জে বখ্‌শ (রহ.) পীরের নির্দেশে লাহোরে আগমন করেন। লাহোরে তিনি সর্বদা কিতাব রচনা ও সংকলনের কাজে মসগুল থাকতেন। সাথে সাথে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন ইসলাম প্রচারের কাজে। ফলশ্রুতিতে তারঁই মাধ্যমে হাজার হাজার অমুসলিম ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। বড় পীর পীরানে পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) দাতাগঞ্জে বখ্‌শ সম্পর্কে স্বীয় মুরিদদের বলেন বলে উল্লেখ দেখা যায় যে, তিনি (দাতাগঞ্জে বখ্‌শ) আমার সময়ে জীবিত থাকতেন তাহলে আমি তাঁর মুরিদ হতাম।

হযরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি (রহ.) ও হযরত খাজা ফরিদ উদ্দিন গঞ্জে শখর প্রথম শ্রেষ্ঠ আউলিয়ায়ে কেরাম তাঁর মাজার সংলগ্ন চিল্লা করেছিলেন। লাভ করেছিলেন রুহানী ফয়েজ। এখনও দাতার মাজার সংলগ্ন চিল্লার হোজরা বিদ্যমান।

হযরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি (রহ.) মতান্তরে ৪০ দিন পর্যন্ত তাঁর মাজারে অবস্থান করেন। এই সময় তিনি নামাজের পর মোরাকাবার পাশাপাশি মাজার প্রাঙ্গণে সুললিত কণ্ঠে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বিদায়কালে দাতাগঞ্জে বখ্‌শ (রহ.) গরীবে নওয়াজকে সুলতানুল হিন্দ উপাধি দান করেন। কিন্তু আধ্যাত্মিক সাক্ষাত পাচ্ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত ভগ্ন হৃদয়ের পর সাক্ষাত লাভ করেন। সাথে সাথে এও বুঝতে পারেন যে, হযরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি (রহ.)’র মত একজন মহান আওলাদে রাসূল আল্লাহর অলি তাঁর মাজারে অবস্থান করতে থাকায় সাক্ষাত না দিয়ে অবস্থান দীর্ঘায়িত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। শেষ পর্যন্ত বিদায়কালীন সাক্ষাত দেন। হযরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি (রহ.) বিদায়কালে হযরত সৈয়দ আবুল হাসান আলী ওরফে দাতাগঞ্জে বখ্‌শ এর উদ্দেশ্যে নিজের বয়াতটি (পংক্তি) পাঠ করেন

গঞ্জে বখ্‌শে ফয়েজে আলম মজহারে নূরে খোদা!

নাকে সারা পীরে কামেল কামেলারা রাহনুমা!”

এই ঘটনার পর থেকে তিনি দাতাগঞ্জে বখ্‌শ নামে আখ্যায়িত হয়ে যান। পুরাতন লাহোরে বিশাল এরিয়া নিয়ে তাঁর মাজার কমপ্লেক্স। কমপ্লেক্সের মাঝখানে আট ভাঁজে গোলাকৃতির মাজার। পশ্চিমপাশে খোলা চত্বরসহ বিশাল জামে মসজিদ। মাজারের পূর্বপাশে পানির ফোয়ারাসহ বাগান। মাজারের দক্ষিণপশ্চিমে মাত্র ২/৩ মিটার দূরত্বে হযরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি (রহ.)’র চিল্লার স্থান।

১৯৯৯ সালে হজ্বের পর দেশে ফিরার পথে সপ্তাহখানেকের জন্য পাকিস্তানে সফর করা হয়েছিল। তখন করাচি থেকে লাহোর, ইসলামাবাদ, রাওয়ালপিন্ডি যাওয়া হয়। লাহোরে হযরত দাতাগঞ্জে বখ্‌শ (রহ.)’র যেয়ারতকালীন দৃশ্যের উক্ত বর্ণনা।

হযরত গরীবে নওয়াজ লাহোর থেকে রওনা দিয়ে সামানা নামক স্থানে উপস্থিত হন বলে উল্লেখ দেখা যায়। যা হয়ত দিল্লি লাহোরের মধ্যখানে কোন স্থান হবে। অতঃপর দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা হন। দিল্লি থেকে পর্যায়ক্রমে আজমীর।

হযরত গরীবে নওয়াজ ৫৩০ হিজরি ১১৩৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৬ রজব ৬২৭ হিজরি ২১ মে ১২২৯ সালে সোমবার ইন্তেকাল হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছে।

আজমীরে গরীবে নওয়াজ এর যেয়ারতে সব সময় হাজার হাজার লোকের সমাগম থাকে। যেয়ারতকারীর চাহিদায় কলকাতা শিয়ালদহ থেকে দৈনিক ট্রেন সার্ভিস রয়েছে আজমীর যেতে। দিল্লি থেকে রয়েছে অতি উন্নতমানের ট্রেন যাতায়াত। দিল্লি থেকে ভোরে যায় বিকেলে আসে শতাব্দী এক্সপ্রেস। অপরদিকে আজমীর থেকে ভোরে দিল্লি এসে আবার ফিরে যায় বন্দে ভারত। আকাশপথেও আজমীরে যাতায়াত শুরু হয়েছে। আমারও দিল্লির দিকে গমন করলে যেয়ারতের উদ্দেশ্যে আজমীর যেতে ভুল হওয়ার নয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধচতুর্থ শিল্প বিপ্লব-কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-শ্রমজীবী মানুষের ওপর তার অভিঘাত
পরবর্তী নিবন্ধবান্দরবানে আড়াই কোটি টাকার আফিমসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক