প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ১০:৪১ পূর্বাহ্ণ

সৌদি আরবের ইতিহাসে দৃষ্টিপাত

২৩ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের জাতীয় দিবস। ১৯৩২ সালের এই দিনে বাদশাহ আবদুল আজিজ সৌদি আরব নামকরণ ও রাজতন্ত্র ঘোষণা দেন। ১৯০২ সাল থেকে ১৯০৭ সাল অবধি তিনি কুয়েত থেকে এসে রিয়াদ দখল করতে সচেষ্ট থাকেন। রিয়াদ হল নজদের কেন্দ্রস্থল। ঐ সময় রিয়াদ তুর্কি সালতানাতের নিয়ন্ত্রণে ছিল। রিয়াদের গর্ভণর তথা পাশা ছিলেন আল রশিদ। বাদশাহ আবদুল আজিজ মতান্তরে ৬০ জন সহযোদ্ধা নিয়ে রিয়াদ দখল করতে সক্ষম হয়। যার রয়েছে দীর্ঘ বর্ণনা।
বাদশাহ আবদুল আজিজ রিয়াদে অবস্থান সুদৃঢ় করেন। যাতে তুর্কি সুলতানের পক্ষে পুনঃ রিয়াদ দখল করা সহজতর না হয়। অবশ্য সেই সময় তুর্কি রাজতন্ত্রের প্রতিকূল অবস্থা ও রিয়াদের সাথে যোগাযোগ প্রতিকূলতা বাদশাহ আবদুল আজিজের জন্য সৌভাগ্য ছিল। রিয়াদে অবস্থান সুদৃঢ় করার পর পর্যায়ক্রমে আশপাশের অঞ্চলসমূহ নিয়ন্ত্রণে নিতে অভিযান চালায়। এভাবে হেজাজ বাদে বর্তমান সৌদি আরবের প্রায় অঞ্চল বাদশাহ আবদুল আজিজের নিয়ন্ত্রণে এসে যায়। এতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে তার ২য় পুত্র যুবক ফয়সল।
এই সময় হেজাজে তুরস্কের গর্ভনর তথা পাশা ছিলেন শরীফ হোসাইন। তার জীবন ও লেখাপড়া তুরস্কে। তুর্কি সুলতানের প্রতিকূলতার সুযোগে প্রভাব বিস্তার করে হেজাজে তুরস্কের গর্ভনর তথা পাশা হয়ে আসেন। ক’বছরের ব্যবধানে তুরস্কে রাজতন্ত্রের প্রতিকূলতা বুঝে নিজেকে নিজে হেজাজের আমির তথা বাদশাহ ঘোষণা করেন। অবশ্য এতে ব্রিটিশের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। নিজেকে আমির ঘোষণা করার সাথে সাথে জেদ্দা, পবিত্র মক্কা, পবিত্র মদিনাসহ বিভিন্ন স্থানে তুর্কি সৈন্যদের ক্যাম্প উচ্ছেদ করে তাদের তুরস্কে পাঠিয়ে দেন। শরীফ হোসাইন তুরস্কের শাসন প্রত্যাহার করায় হেজাজে আর্থিক প্রতিকূলতা ও আইন শৃংখলার চরম অবনতি ঘটে। দেশের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য বর্ণনায় এ বিষয় ফুটে উঠেছে। তৎমধ্যে রয়েছে ১৯১২ সালে বৃহত্তর চকরিয়া-মগনামার জমিদার ওয়াইজ উদ্দিন মুহুরী, ১৯১৪ সালে হাটহাজারী কাঠিরহাটের মাওলানা এয়ার মুহাম্মদ এবং ১৯২০ সালে খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ হজ্বের সফরের লিখিত বর্ণনা। শরীফ হোসাইন রিয়াদ কেন্দ্রীক বিশাল অঞ্চলের নিয়ন্ত্রক বাদশাহ আবদুল আজিজের সাথে সুসম্পর্কের মাধ্যমে সহাবস্থানে থাকলে তার জন্য কল্যাণকর হত। যেহেতু বাদশাহ আবদুল আজিজেরও পৃষ্ঠপোষক ছিল ব্রিটিশ।
শরীফ হোসাইন বাদশাহ আবদুল আজিজের সাথে সুসম্পর্ক রাখতে পারেননি অধিকন্তু অতি উচ্চাবিলাসী হয়ে নিজেকে আমিরুল মুসলেমীন ঘোষণা করে দেন। এদিকে শরীফ হোসাইনের উগ্রবাদী, উচ্চাবিলাসীতায় ব্রিটিশরা বিরক্ত। এমনি অবস্থায় ১৯২৪ সালে পিতার নির্দেশে যুবক ফয়সল তার বিশাল বাহিনী নিয়ে বিনা বাধায় পবিত্র মক্কার নিয়ন্ত্রণ নেয়। অতঃপর জেদ্দা, এরপর পবিত্র মদিনা। এদিকে ব্রিটিশের সহায়তায় শরীফ হোসাইন পরিবার, ধন সম্পদ নিয়ে জেদ্দা পালিয়ে যায়। জেদ্দা থেকে সাগর পথে আকাবা বন্দরের দিকে চলে যায়। শরীফ হোসাইনের পরবর্তী অবস্থান ইন্তেকাল ঐ অঞ্চলে। শরীফ হোসাইনকে জেরুজালেমে দাফন করা হয়।
এদিকে বাদশাহ আবদুল আজিজ যুবক পুত্র ফয়সলকে সাথে নিয়ে তার অধিকৃত বিশাল অঞ্চলে অবস্থান আরও সুদৃঢ় করতে থাকে। বিশাল অঞ্চলকে কঠোর নিয়ন্ত্রণে আনে। আইন শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত করে। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বন্ধ হয়ে যায়। অধিকৃত বিশাল অঞ্চলে সুন্দর, সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে আসে। মুরুভূমিতে অবস্থানরত বেদুঈন আরবীয়গণকে প্রতিষ্ঠিত করতে ভূমিকাপালন করেন।
১৯৩০ সাল থেকে সৌদি আরবে পর্যায়ক্রমে তেলপ্রাপ্তি শুরু হয়। সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা লাভ করতে থাকে। অবশ্য মরুভূমি প্রধান অঞ্চলে সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা আমাদের দেশের মত এত কঠিন নয়। বালি সরিয়ে দিলে রাস্তা হয়ে যায়। ব্রিটিশসহ ইউরোপ থেকে জিপ জাতীয় গাড়ি আমদানী শুরু হয়। ১৯৩০ এর দশকে রিয়াদ থেকে পবিত্র মক্কা আসতে সড়কপথে ৫-৬ দিন লাগত। পবিত্র মক্কা থেকে পবিত্র মদিনা হাজীরা যাওয়া আসা করতে গাড়িযোগে ২ দিন ২ রাত লাগত।
এমনি অবস্থায় ১৯৩২ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর বাদশাহ আবদুল আজিজ রাজতন্ত্র ঘোষণা করেন। তার সউদ গোষ্ঠীর নামকরণে অধিকৃত অঞ্চলের নাম দেন সৌদি আরব। যেহেতু কুয়েত থেকে রিয়াদ দখল করতে আসবার সময় ৬০ জন সহযোদ্ধার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি ছিল আবদুল আজিজের সউদ গোষ্ঠী।
১৯৩০ এর দশক থেকে সৌদি আরব দ্রুততার সাথে এগিয়ে যেতে থাকে। এতে হজ্বযাত্রীগণ থেকে পাওয়া ট্যাঙ ও তেলের ন্যূনতম মূল্য সহায়ক ছিল। ১৯৪০ সালের দিকে সৌদির অভ্যন্তরে আকাশপথ প্রতিষ্ঠা লাভ করতে শুরু হয়। এ সময় রিয়াদ, জেদ্দা বিমান বন্দর প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
বাদশাহ আবদুল আজিজ তার দেশ পরিচালনায় কৌশল হিসেবে প্রতিপক্ষের মেয়েকে বিয়ে করতে শুরু করেন। যেমন রিয়াদে তুর্কি গর্ভনর আল রশিদের মেয়ে ছিলেন বাদশাহ আবদুল্লাহর মা। ইয়েমেনে আবদুল আজিজের প্রতিপক্ষের মেয়ে ঘরের সন্তান ছিলেন মুকারিন। যাকে যুবরাজ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। অপরদিকে বাদশাহ আবদুল আজিজের সহযোদ্ধাগণের অন্যতম সুদাইরী গোষ্ঠীর কন্যা হাসসাকে বিয়ে করেন। সুদাইরী বংশের হাসসা বাদশাহর নবম স্ত্রী বলে জানা যায়। তেমনি হাসসা বাদশাহ আবদুল আজিজের স্ত্রীগণের মধ্যে প্রভাবশালী। এ ঘরে বাদশাহ আবদুল আজিজের ৭ পুত্র। তাদেরকে সুদাইরী সেভেন বলা হয়। তৎমধ্যে প্রথম পুত্র বাদশাহ ফাহাদ। তার অপর দুই ভাই সুলতান ও নায়েফ যুবরাজ থাকা অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। ফাহাদ ২০০৫ সালে ইন্তেকাল করেন। বাদশাহ ফাহাদের পর আবদুল্লাহ বাদশাহ হন। আবদুল্লাহর পর সুদাইরী সেভেনের কনিষ্ঠ পুত্র বাদশাহ ফাহাদের সহোদর ছোট ভাই সালমান বর্তমান বাদশাহ। তিনি যুবরাজ মুকারিম ও ভ্রাতা নায়েফের পুত্র মুহাম্মদকে উপ যুবরাজ থেকে অব্যাহতি দিয়ে নিজের পুত্র মুহাম্মদকে যুবরাজ মনোনীত করেন।
১৯৫৩ সালে বাদশাহ আবদুল আজিজ ইন্তেকাল করেন। তার দিয়ে যাওয়া লিখিত দিক নির্দেশনা মতে তার ১ম পুত্র সউদ বাদশাহ হন। তার যোগ্যতার অভাব দেশে বিদেশে সীকৃত ছিল। ফলে যুবরাজ ফয়সল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্টিত হয়। তিনি বিশ্বে মুসলমানগণের পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৩ সালে ১৭ দিনের যুদ্ধে মিশরের পক্ষে বলিষ্ট সহায়ক ছিলেন। এতে আমেরিকা সরাসরি হস্তক্ষেপ না করলে ইসরাইলের অস্তিত্ব থাকত কিনা বলা মুশকিল। আমেরিকার উদ্যোগে ক্যাম ডেভিট চুক্তির মাধ্যমে ১৯৬৭ সালের ৬ দিনের যুদ্ধে ইসরাইলের নিকট হারানো ৬০ হাজার বর্গ কি.মি বিশাল সীনাই উপদ্বীপ মিশরকে ফিরিয়ে দিতে ইসরাইল বাধ্য হয়।
বাদশাহ ফয়সলের নেতৃত্বে ১৯৭৩ সালে তেল অবরোধ হয়। পশ্চিমা বিশ্বসহ বিশ্বে তেলের অভাবে হাহাকার শুরু হয়। এই বাদশাহ ফয়সল পরবর্তীতে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে পশ্চিমা গোয়েন্দাদের চক্রান্তে ভ্রাতুষ্পুত্রের হাতে শহীদ হন ১৯৭৫ সালে । অতঃপর সৎ ভাই নরম শান্তি প্রিয় খালেদ বাদশাহ হন। তার আমলে ১৯৭৯ সালে হজ্বের ২ সপ্তাহ পর ফজরের নামাজের সাথে সাথে প্রায় ২ শত ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী পবিত্র মসজিদুল হারম অবরোধ করে। পবিত্র কাবা কেন্দ্রীক জামাত ও তাওয়াফ বন্ধ থাকে। ধর্মীয় মত পার্থক্যের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাধ্যমে ২ সপ্তাহ ব্যবধানে তা সমাপ্ত হয়। ১৯৮২ সালে বাদশাহ খালেদ ইন্তেকাল করলে সুদাইরী সেভেনের ১ম পুত্র ফাহাদ বাদশাহ হন। তার আমলটা সৌদি আরবের স্বর্ণ যুগ। বাদশাহ ফয়সলের পর তিনি মুসলিম বিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। মসজিদে নববীকে ৮/৯ গুণ বর্ধিত করে ৪০/৫০ হাজার নামাজির স্থলে ৭/৮ লক্ষ যেয়ারতকারী মসজিদে নববীতে এক সাথে নামাজ পড়ার ব্যবস্থা করেন। তেমনিভাবে মদিনা মুনাওয়ারা শহরকে নতুনভাবে সাজিয়ে যান। পবিত্র মক্কায় মসজিদুল হারম পশ্চিম দিকে বিশাল আকারের সম্প্রসারণ করেন। দু’হারমে হাত বাড়ালেই হজ্ব, ওমরাহকারী যাতে জমজমের পানি খেতে পারে তার ব্যবস্থা করে দেন। শেষ বয়সে ফাহাদ অসুস্থ হয়ে পড়লে যুবরাজ আবদুল্লাহ বাদশাহ হন। বাদশাহ ফাহাদ ২০০৫ সালে ইন্তেকাল করেন। বাদশাহ আবদুল্লাহ বাদশাহ আবদুল আজিজের করা মসজিদুল হারমের পুনঃ নির্মাণের কাজ শুরু করেন, সাথে সম্মুখভাগে তুর্কি আমলে নির্মিত হেরমের পুনঃ নির্মাণ। মসজিদুল হারমের পশ্চিম উত্তর দিকের বিশালভাবে সম্প্রসারণ করেন। বাদশাহ আবদুল্লাহ ৯০ বছর বয়সে ২০১৫ সালের ২৩ জানুয়ারী ইন্তেকাল করেন। এতে সুদাইরী সেভেনের কনিষ্ঠ পুত্র যুবরাজ সালমান বাদশাহ হন। তার আমল পারিবারিকসহ দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা কিছুর সাক্ষী। তৎমধ্যে যুবরাজ ও উপযুবরাজকে অব্যাহতি দিয়ে নিজের পুত্র মুহাম্মদকে যুবরাজ করেন। ২০১৫ সালের মার্চ থেকে ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের দমন করতে বিমানে হামলা শুরু করেন। বাদশাহ সালমানের শেষ বয়সে এসব পীড়াদায়ক বলা যাবে। সাথে সাথে প্রতিপক্ষ ইরানের কারণে ইসরাইলের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়া, তার রাজতন্ত্র রক্ষায় বড় ঝুকিপূর্ণ পদক্ষেপ বলা যেতে পারে। উপসাগরীয় দুই রাজতন্ত্রীয় দেশ বাহরাইন ও আমিরাত ইসরাইলের সাথে প্রকাশ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা আমেরিকার চাপে হলেও সৌদি আরবের সমর্থনে হয়েছে তা অস্বীকার করা যাবে না। ৮৬ বছরের বৃদ্ধ সালমান পিতা বাদশাহ আবদুল আজিজের সন্তানগণের মধ্যে শেষ বাদশাহ। পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনাসহ হেজাজ অঞ্চল সৌদি আরবের অন্তর্ভুক্ত। শরীফ হোসাইন বাদশাহ আবদুল আজিজের সাথে সুসম্পর্ক রাখলে উভয় দেশের পৃষ্ঠপোষক ব্রিটিশ বিধায় হয়ত হেজাজ দখল করা হত না। এতে ইতিহাস অন্যভাবে প্রবাহিত হত। পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনা মুসলিমদের পবিত্র ভূমি বিধায়, স্বভাবতই সৌদি আরবের প্রতি মুসলিম বিশ্বের আলাদা দুর্বলতা কাজ করবে। আমরা চাইব সৌদি আরবে সুন্দর, শৃংখলা, শান্তি বজায় থাকুক।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধজাল এনআইডি ও চারিত্রিক সনদ বিক্রি