প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ২৬ জুলাই, ২০২৩ at ৫:৪৯ পূর্বাহ্ণ

১০ মুহররম ও কারবালায় যেয়ারত

মুহররম আসলেই উম্মতে মুহাম্মদীর মনে জাগরুক হয় কারবলার হৃদয়বিদারক ঘটনা। যেহেতু ৬১ হিজরির ১০ মুহররম কারবালার বালুকাময় মরু প্রান্তরে হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)’র ছোট্ট কাফেলার উপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে।

অবশ্য ১০ মুহররম বিশ্বের ইতিহাসে নানান ঘটনাবহুল দিবস। যেমন রমজান মাসে রোজা ফরজ হওয়ার আগে ১০ মুহররম রোজা রাখা ফরজ ছিল। এ দিন আল্লাহ পাক হযরত আদম (.) ও ইদ্রিস (.) কে সৃষ্টি করেন। হযরত আদম (.) ও মা হাওয়া (.)’র দোয়া কবুল হয়। প্রথম বৃষ্টি বর্ষিত হয়। হযরত আইয়ুব (.) রোগ মুক্তি লাভ করেন, হযরত নূহ (.) মহাপ্লাবনের পর জমিনে অবতরণ করেন, হযরত ইউনুচ (.) মাছের পেট থেকে উদ্ধার হন, হযরত মুসা (.) তাঁর সাথীদের নিয়ে বাহারে কুলজুম (লোহিত ও সুয়েজ খালের মধ্যবর্তী স্থান) পার হয়ে যান। আর ফেরাউন দলবলসহ বাহারে কুলজুমে নিমজ্জিত হন। হযরত ইব্রাহীম (.) নমরুদের অগ্নিকুন্ড থেকে নিস্তার পান, হযরত ইউসুফ (.) কারাগার থেকে মুক্তি পান, হযরত ইদ্রিস (.) কে উর্ধ্বাকাশে (বেহেশতে) উঠিয়ে নেয়া হয়। হযরত ঈসা (.) কে আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয় এ দিনই আল্লাহ পাক বিশ্ব সৃষ্টি করেন। এ দিনই কিয়ামত হবে। বিশ্বের ইতিহাসে ১০ মুহরমের এ সব ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ উম্মতে মুহাম্মদীর নিকট কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনার কাছে ম্লান।

যেয়ারত: ১৯৯৭ সালে হজ্বের পর সপ্তাহখানেকের জন্য আম্মান হয়ে বাগদাদ যাওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। হজ্ব ও মদিনা মুনাওয়ারা যেয়ারতের পর জেদ্দা বিমান বন্দরে চলে আসি। এখান থেকে আকাশপথে জর্ডানের রাজধানী আম্মান আসা হয় অনেকটা শেষ রাত্রে। পরদিন আম্মানে জুমার নামাজের পর প্রায় ৯৫০ কি.মি দূরত্বে সড়কপথে বাগদাদ রওনা করি।

৮ বছরব্যাপী ইরাকইরান ভ্রাতৃঘাতী দীর্ঘ যুদ্ধ অতঃপর ইরাক কর্তৃক কুয়েত দখল ইরাককে অবরোধে ফেলে। ইরাকের আকাশপথ বন্ধ হয়ে যায়। ইরাক এয়ারওয়েজের বিমানগুলো ইরাকের বিভিন্ন বিমান বন্দরে অলস বসে থাকে। অবরোধে ইরাকের অর্থনীতি ছারকার হয়ে যায়। বিমান যাতায়াত অনুকূল না হওয়ায় আমাদের সড়কপথে যাওয়া।

এমনি অবস্থায় জুমার পর একটি বাসযোগে আমরা ১৮ জন যেয়ারতকারী বাগদারের উদ্দেশ্যে দীর্ঘপথ যাত্রা শুরু করি। রাত ১০ টায় আম্মান বর্ডারে পৌঁছি। উভয় দেশের বর্ডার কার্যক্রম শেষ করতে ৩/৪ ঘণ্টা লেগে যায়। বর্ডার থেকে বাগদাদের দূরত্ব প্রায় ৫৫০ কি.মি। আমরা দুপুর ১২ টায় বাগদাদ পৌঁছি। বড় পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) মাজার কমপ্লেক্সের নিকটে একটি আবাসিক হোটেলে ১ সপ্তাহের জন্য অবস্থান নিই।

বাগদাদে ১ সপ্তাহ অবস্থানকালে সারাদিনের জন্য কুফা, নজফ, কারবালা যেয়ারতের প্রোগ্রাম রাখা হয়। আমরা বাগদাদ থেকে সকালে রওনা দিয়ে ঘুরপথে প্রায় ১৭০ কি.মি দূরত্বে কুফা যাই। কুফা আমিরুল মোমেনীন হযরত ওমর (.)’র আমলে ইসলামের গুরুত্বপুর্ণ জংশন ছিল। খলিফা আল মনসুর কুফা থেকে বাগদাদে রাজধানী স্থানান্তর করেন। কুফায় যেয়ারত ও ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখে প্রায় ১০ কি.মি দূরত্বে আমরা নজফে আসি। এখানে হযরত আলী (.) এবং কয়েকজন নবী রাসূল ও সাহাবাগণের যেয়ারত করি। এখান থেকে আরও ৩০ কি.মি বাগদাদের পথে কারবালায় এসে পৌঁছি।

সেই সময়ের ধূধূ মরুভূমি কারবালা আজ শহর। আমাদের গাইডের বর্ণনায় জানলাম কারবালার পাশে হল মূল ফুরাতের শাখা নদী। কারবালায় ইমাম হোসাইন (রা.)’র প্রকান্ড মাজার। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে এ মাজার নির্মাণ করা হয়। আমরা বিকালবেলা এখানে এসে পৌঁছি। মাজার থেকে দূরত্বে বড় রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে আমরা গাইডের নেতৃত্বে মাজারের দিকে আসতে থাকি। মাজারের ভিতর থেকে শিয়া নরনারীর কান্নার আওয়াজ আসছিল। আমরা সুন্নি হলেও অনুভূতিতে পার্থক্য নেই।

প্রকান্ড মাজার, মধ্যখানে স্বর্ণের কারুকার্য খচিত কবর। চারপাশে ২০/৩০ ফুট প্রশস্ত বড় এরিয়া, অতঃপর মাজারের দেয়াল। মাজারটি এক গম্বুজের বিশাল আকৃতির। মনে পড়ে চারদিকে দরজা আছে। যেয়ারতের জন্য একদিকে মহিলাগণের জন্য সংরক্ষিত।

তখন ইরাকে অবরোধ চলমান। যোগাযোগ প্রতিকূলতা, তারপরও সেসময় কারবালায় এসে বাস থেকে নামতে শহরে হাজার হাজার নরনারীর আনাগোনা প্রত্যক্ষ করি। মাজারে অভ্যন্তরে আমাদের পক্ষে যেয়ারতে স্থির থাকতে কষ্ট হচ্ছিল। ইসলামের ইতিহাসে কারবালাতুল্য এমন হৃদয় বিদারক ঘটনা আরেকটি নেই। তাও আবার হযরত ইমাম হোসাইনকে কেন্দ্র করে। আহলে বায়েত তথা নবীর পরিবার বলতে চারজনকে বুঝায়। যথাহযরত মা ফাতেমা (রা.), হযরত আলী (.), হযরত ইমাম হাসান (রা.) ও হযরত ইমাম হোসাইন (.)

আমরা মাজারের অভ্যন্তরে সেসময় যেয়ারতে যতক্ষণ ছিলাম তা জীবনের এক স্মরণীয় অবস্থান। এমন কান্নার রোল হৃদয়বিদারক যেয়ারত বিশ্বে অন্য কোথাও আছে বলে মনে হয় না। আমাদের কান্না অনেকটা নীরবে হলেও শিয়ারা নিজেদেরকে স্থির রাখতে পারছিল না।

এখান থেকে আমরা সন্ধ্যার দিকে প্রায় ১ শ কি.মি দূরত্বে বাগদাদের উদ্দেশ্যে রওনা হই। ১ সপ্তাহ বাগদাদে অবস্থানকালে বাগদাদ, কাজেমাইন, সালমানপার্ক গমন করা হয়েছিল যেয়ারতের উদ্দেশ্যে। আরও গিয়েছিলাম ৩৭০ কি.মি দূরত্বে ইরাকের তৃতীয় বৃহত্তম নগরী নবী রাসূলের শহর মসূলে।

ইরাকের যেখানেই যাওয়া হয়, দেখা যায় শুধু অভাব আর অভাব। ইরাকইরান যুদ্ধের আগে ইরাকী এক দিনারে আমেরিকার সাড়ে ৩ ডলার পাওয়া যেত। আমাদের ইরাকে অবস্থান করাকালে ১৯৯৭ সালে এক ডলারে প্রায় ১৩ শ’ দিনার মত পাওয়া যাচ্ছিল। ১০, ২০ দিনারের নোট আমাদের দেশের ভাংতি পয়সার মত, দেখামেলা ভার।

সেই ১৯৭৯ সালে ইরাকের লৌহ মানব সাদ্দাম হোসেন ইরানের প্রতিকূল অবস্থার সুযোগ বুঝে যুদ্ধ শুরু করে। আজ দীর্ঘ ৪৪ বছরের ব্যবধানে আজও ইরাক মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারেনি।

সাদ্দাম হোসেন দুনিয়া থেকে চির বিদায় নিয়ে গেছেন। কিন্তু ইরাকের কোটি কোটি জনগণকে আজও রাষ্ট্রীয় অস্থিতিশীলতার কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

যেহেতু সাদ্দাম হোসেনের কঠোর শাসনে জনগণের বাক স্বাধীনতা ছিলনা। পরবর্তীতে ইরাকে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে যায়। শিয়া সুন্নি বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। ইরাকে শিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ইরাকের আইনশৃঙ্খলা শতভাগ স্বাভাবিক ফিরে না আসায় বাংলাদেশীদের জন্য ইরাকে ভ্রমণ বা যেয়ারতের উদ্দেশ্যে গমন করা নিরাপদ বলা যাবেনা।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধআঞ্চলিকতা মানে সংকীর্ণতা নয়, আঞ্চলিক ভাষাতেই আত্মপরিচয়
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে