বায়তুল মোকাদ্দাসের ঠিক কেন্দ্রস্থলে এক গম্বুজ বিশিষ্ট আটভাজে গোলাকৃতির দৃষ্টিনন্দন ইমারত রয়েছে। অবশ্য পবিত্র মক্কার দিকে বায়তুল মোকাদ্দাস এরিয়ায় পৃথকভাবে মসজিদে আকসাও আছে। জেরুজালেম মহানগরীতে রয়েছে একটি বরকতময় পর্বত। এই পর্বতের শীর্ষ স্থান ১ লাখ ৪০ হাজার ৯ শত বর্গ মিটার এলাকাজুড়ে পুরোটাই বায়তুল মোকাদ্দাস বা মসজিদে আকসা হিসেবে স্বীকৃত। এই পর্বতের ঠিক মধ্যখানে মসজিদে গম্বুজে সাখরা।
বিশ্বের বুকে মুসলমানগণের কাছে তিনটি বরকতময় পাথর ধর্মমতে স্বীকৃত।
১. হাজরে আসওয়াদ
২. মকামে ইব্রাহীম
৩. বায়তুল মোকাদ্দাসে এই সাখরা
বায়তুল মোকাদ্দাসের মধ্যখানে এ পাথরের রয়েছে নানান বরকতময় ইতিহাস। মানব জাতির পিতা হযরত আদম (আ.) এই পাথরের নিকটে নামাজ পড়েন।
মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.) এই পাথরের নিকটে এবাদতখানা নির্মাণ করেন। নবী হযরত ইয়াকুব (আ.) একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। নবী হযরত ইউশা (আ.) এর উপর গম্বুজ নির্মাণ করেন। নবী দাউদ (আ.) এই পাথর কেন্দ্রিক মেহেরাব নির্মাণ করেন। নবী হযরত সোলায়মান (আ.) পবিত্র এবাদতখানা হাইকেল (প্রসিদ্ধ এবাদত ঘর) নির্মাণ করেছিলেন।
২৭ রজব তথা ২৬ রজব দিবাগত রাত পবিত্র শবে মেরাজ। যদিও মাস ও তারিখ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ইহা উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য পবিত্র রাতগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। এই রাতেই আল্লাহর রাসূল (স.) পবিত্র মক্কার মসজিদুল হারাম থেকে পবিত্র জেরুজালেমের মসজিদে আকসা তথা বায়তুল মোকাদ্দাস হয়ে মহান আল্লাহপাকের সান্নিধ্যে গমন করেছেন। আর তা হয় সেকেন্ড এরও কম সময়ের মধ্যে।
মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন মাজীদে বলেন– তিনি পবিত্র ও মহিমাময়, তিনি স্বীয় (হযরত মুহাম্মদ (স.)) বান্দাকে রাতের বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত যার চারপাশকে আমি বরকতময় করেছি, যাতে আমি তাঁকে দেখাই আমার কুদরতের কিছু নির্দশন, নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (সূরা বনী ইসরাইল আয়াত–১)
অর্থাৎ আল্লাহর রাসূল (স.) গভীর রাতে পবিত্র মক্কা থেকে অলৌকিক বাহন বোরাকের সহায়তায় জেরুজলেমের বায়তুল মোকাদ্দাসে আসেন। এখানে সমস্ত নবী রাসূল কে নিয়ে ২ রাকাত নামাজের ইমামতি করেন। অতঃপর বরকতময় পাথর তথা সাখরার উপর উঠে তথা হতে বোরাকের সহায়তায় উর্ধ্বাকাশে মহান আল্লাহপাকের সান্নিধ্যে গমন করেছিলেন।
অর্থাৎ হযরত রাসুলুল্লাহ (স.) মেরাজে গমনের রাতে বায়তুল মোকাদ্দাসে যাত্রা বিরতি দিয়েছিলেন। উর্ধ্বাকাশে গমনকালে এ পাথরের উপর বসেন এবং এখান থেকেই আল্লাহপাকের সান্নিধ্যে রওনা হন। হাজরে আসওয়াদ ও মকামে ইব্রাহীম ছোট ছোট পাথর। কিন্তু বায়তুল মোকাদ্দাসের এ পাথর অনেকটা প্রকাণ্ড আকৃতির। এই পবিত্র পাথরটি গুহার উপর আসমান ও জমিনের মধ্যে শূন্য স্থানে ঝুলন্ত বলে মনে হবে। যে গুহার উপর পাথরটির অবস্থান সেই গুহার আয়তন ৭ঢ৫ মিটার। পাথরের নিচে গুহায় প্রবেশ করে ৩০/৪০ জন নর–নারী নামাজ পড়ার ব্যবস্থা আছে।
আল্লাহর রাসূল (স.) বাদে সমস্ত নবী রাসূলগণের কেন্দ্রস্থল বায়তুল মোকাদ্দাসকে বলা যায়। বায়তুল মোকাদ্দাসকে বুকে ধারণ করে রয়েছে জেরুজালেম নগরী, যাকে নবী রাসূলগণের শহর বলা হয়।
হযরত ইব্রাহীম (আ.) পবিত্র কাবা নির্মাণের ৪০ বছর পর মসজিদে আকসা নির্মাণ করেন। পবিত্র কাবার মত মসজিদে আকসাও পুনঃ সংস্কার হয়ে আসছিল। নবী হযরত সোলায়মান (আ.) কর্তৃক মসজিদে আকসা মজবুত করে পুনঃ নির্মাণের কথা রয়েছে।
আল্লাহর রাসূল (স.) এর পর হযরত ইব্রাহীম (আ.) মর্যাদাবান। তাঁর ২ স্ত্রী ২ পুত্র। হযরত ইসমাইল (আ.) কে তাঁর মা হযরত হাজেরা (আ.) সহ জনমানবহীন মরুপ্রান্তর পবিত্র মক্কায় পৌঁছে দেন হযরত ইব্রাহীম (আ.)।
হজ্বের মৌলিক আহকাম হযরত ইব্রাহীম (আ.), হযরত ইসমাইল (আ.), হযরত হাজেরা (আ.) কে কেন্দ্র করে। হযরত ইসমাইল (আ.) এর বংশধারায় আমাদের নবী পাক (স.) শেষ নবী হিসেবে দুনিয়াতে আগমন করেন।
অপরদিকে হযরত ইব্রাহীম (আ.)’র অপর স্ত্রী হযরত সায়েরা (আ.) এর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন হযরত ইসহাক (আ.)। হযরত ইসহাক (আ.)’র বংশধারায় বহু নবী রাসূলের আগমন ঘটে। অর্থাৎ হযরত ইসহাক (আ.)’র বংশধারায় প্রায় ৪ হাজার বছরের অধিক সময়ে নবী রাসূলে মুখরিত ছিল জেরুজালেম নগরী। এই জেরুজালেম মুলকে শাম সিরিয়ার কেন্দ্রস্থল।
জেরুজালেম আমিরুল মোমেনীন হযরত ওমর ফারুক (র.) আমলে রোম থেকে মুসলমানের নিয়ন্ত্রণে আসে। ওমাইয়া খলিফা আবদুল মালেক বিন মরওয়ান এই পাথরের সম্মানার্থে ইমারত নির্মাণ করেন। ফলে এর নামকরণ হয় মসজিদে গম্বুজে সাখরা। আট ভাজে গোলাকৃতির এই ইমারতের অভ্যন্তরে এবং পাথরের নিচে গুহা সমেত প্রায় ২ শত বা কম বেশিজনের নামাজের ব্যবস্থা রয়েছে।
ওমাইয়াদের পর আব্বাসীয়সহ বিভিন্ন সময়ে মসজিদে গম্বুজে সাখরাসহ বায়তুল মোকাদ্দাসে নানান সংস্কার কাজ হয়। সর্বশেষ তুকি সুলতানগণের নিয়ন্ত্রণে আসে জেরুজালেম। সাথে হেজাজে পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনা ত আছেই। তবে বর্তমান সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ এক নাগাড়ে তুর্কি শাসনে ছিল না। তুর্কি সুলতানগণ মতান্তরে ৪/৫ শত বছর বায়তুল মোকাদ্দাসসহ জেরুজালেম কেন্দ্রীক ফিলিস্তিন শাসন করে গেছেন।
১৯২৪ সাল থেকে পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনায় বাদশাহ আবদুল আজিজ পরিবার নানাভাবে উন্নয়নে অবদান রাখলেও বায়তুল মোকাদ্দাসে জর্ডানের বাদশাহ হাসান নানাভাবে অবদান রেখেছেন। যেহেতু বায়তুল মোকাদ্দাস ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত জর্ডানের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
বায়তুল মোকাদ্দাসে ৫ ওয়াক্তে ২ জামাত। এক জামাত মূল মসজিদে আকসায় অপর জামাত মসজিদে গম্বুজে সাখরায়। একতলা বিশিষ্ট এ বরকতময় মসজিদে আকসার দৈর্ঘ্য ৮০ মিটার প্রস্থ ৫৫ মিটার।
সাপ্তাহিক জুমা ও দুই ঈদে কয়েক লাখ ফিলিস্তিনীর সমাগম ঘটে। তখন এক আজান এক জামাত। মূল মসজিদে আকসা থেকে সম্মানিত খতিব সাহেব খুতবা ও নামাজ পরিচালনা করেন। মসজিদে গম্বুজে সাখরা মহিলাগণের জন্য সংরক্ষিত থাকে। বায়তুল মোকাদ্দাস শুধু মসজিদ কেন্দ্রীক নয়। বলতে গেলে এ বরকতময় পর্বতের পুরোটাই বায়তুল মোকাদ্দাস হিসেবে স্বীকৃত। এখানে নামাজীদের আসতে সম্ভবত তিন দিকে রাস্তা রয়েছে। জুমা ও দুই ঈদে বায়তুল মোকাদ্দাস এরিয়া ছাড়িয়ে কেবলার দিক বাদে অপর ৩ দিকে নর–নারীর উপস্থিতিতে লোকারণ্য হয়ে যায়।
১ লাখ ৪০ হাজার ৯ শত বর্গ কি.মি বিশাল এরিয়ায় খালি স্থানে বড় বড় চারকোণা বিশিষ্ট পাথর বসানো। জানি না এ পাথরগুলো কত হাজার বছরের। এ পাথরের মাঝে মাঝে যৈতুন ও তীন গাছ রয়েছে। যা এলাকার সৌন্দর্য্যকে বাড়িয়ে তুলছে।
বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে ৯০ কি.মি পূর্বে জর্ডানের রাজধানী আম্মান। জেরুজালেম থেকে ৩০ কি.মি দূরত্বে হেবরন। যেখানে মসজিদে ইব্রাহীম এবং হযরত ইব্রাহীম (আ.) শায়িত। জেরুজালেম থেকে ৩৬৬ কি.মি দূরত্বে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক। জেরুজালেম থেকে ৭০ কি.মি দূরত্বে ভূমধ্যসাগর, ১২৫ কি.মি দূরত্বে গাজা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট