স্মরণ : এডভোকেট ফিরোজ আহমদ চৌধুরী
কক্সবাজার জেলার পেকুয়া জমিদার পরিবারের সন্তান এডভোকেট ফিরোজ আহমদ চৌধুরী। ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। ছিলেন ১৯৫৪ খ্রি: যুক্তফ্রন্টের এম.পি.এ। আমার পিতা আমিরুল হজ্ব খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরীর স্মরণ সভায় অতিথি/আলোচক হিসেবে তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠতার সূত্রতা। যেহেতু তিনি চট্টগ্রাম মহানগরীতে খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরীর স্মরণ সভায় গুরুত্ব দিয়ে আলোচক হিসেবে উপস্থিত হন অনেক বার। তাঁর বক্তব্যে আব্বাজানের অনেক অজানা বিষয় জানবার সুযোগ হত। আব্বাজানের ইন্তেকালের সময় আমার বয়স ছিল ১২/১৩ বছর। এডভোকেট ফিরোজ আহমদ চৌধুরী খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরীর দীর্ঘ বর্ণাঢ্য জীবনের অনেক কিছু নখদর্পণে তা তাঁর বক্তব্যে ফুটে উঠত। আমি নিজে অতি মনোযোগ সহকারে তাঁর বক্তব্য শুনতাম। খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী ১৯২৯ ও ১৯৪৩ দু’বার ব্রিটিশ ভারতের সংসদ সদস্য ছিলেন, ছিলেন খান বাহাদুর ও আমিরুল হজ্ব। সে ব্রিটিশ আমলের ১৫/২০টি বিভিন্ন বিভাগ বা দপ্তরের সদস্য। আরও ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় জমিদার এসোসিয়েশনের সেক্রেটারী জেনারেল। ব্যারিস্টার জামেলী কান্তি ঘোষাল ছিলেন সভাপতি। অপরদিকে, এডভোকেট ফিরোজ আহমদ চৌধুরীও জমিদার পরিবারের সন্তান। আইনজীবি রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিত্ব বিধায় খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরীর সাথে অনেক বিষয়ে কাছে থাকার সুযোগ হয়েছিল, তা তাঁর বক্তব্যে ফুটে উঠত। সে হতে এডভোকেট ফিরোজ আহমদ চৌধুরীর সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা কাছ থেকে দেখার, জানবার সুযোগ হয়। আমার প্রতি তার আন্তরিকতা হৃদ্যতা আমাকে অভিভূত করে।
খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী জন্ম ১৮৮৬ খ্রি: এবং ইন্তেকাল: ১৯৬২ খ্রি: শুক্রবার। অপরদিকে, এডভোকেট ফিরোজ আহমদ চৌধুরীর জন্ম ১৯২২ খ্রি: তথা ৩৬ বছরের ছোট। তার যৌবনকালে খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরীর বর্ণাঢ্য জীবনের অনেক কিছুর সাক্ষী থাকতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এডভোকেট ফিরোজ আহমদ চৌধুরী কঙবাজার জেলার পেকুয়া উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লিখেন তাঁর পিতা গুরা মিয়া চৌধুরী, দাদা কাছিম আলী চৌধুরী। কাছিম আলী চৌধুরী ১৮৫০ সালে কুতুবদিয়া থেকে পেকুয়া বসতি স্থাপন করেন। তার ৩ পুত্র। ১. তমিজ উদ্দিন চৌধুরী ২. গুরা মিয়া চৌধুরী (১৮৭০-১৯৩৪) ৩. মকবুল আহমদ চৌধুরী। তমিজ উদ্দিন চৌধুরী ও মকবুল আহমদ চৌধুরীর বংশধর পেকুয়া পুরাতন বাড়িতে বসবাসরত। অপরদিকে গুরা মিয়া চৌধুরীর বংশধর পুরাতন বাড়ির ১ কি.মি পশ্চিমে নতুনভাবে বসতি স্থাপন করেন। কাছিম আলী চৌধুরীর অপর ভ্রাতা নজমুদ্দিন চৌধুরী ডেমুশিয়ায় বসতি করে। তাঁর পুত্র জিন্নাত আলী চৌধুরী।
গুরা মিয়া চৌধুরীর ৫ পুত্রের ওয়ারিশ রয়েছে। যথা- কবির আহমদ চৌধুরী (কবির মিয়া), এডভোকেট ফিরোজ আহমদ চৌধুরী, আকতার আহমদ চৌধুরী, মোক্তার আহমদ চৌধুরী, রশিদ আহমদ চৌধুরী। নতুন বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন মসজিদ, বাজার ইত্যাদি। এডভোকেট ফিরোজ আহমদ চৌধুরীর ভ্রাতারা বিভিন্নভাবে প্রতিষ্ঠিত। তৎমধ্যে বড় ভাই কবির আহমদ চৌধুরী ১৯৪৬ খ্রি: এম. এল. এ ছিলেন। জমিদার হিসেবে তিনিও খুব প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁর আরেক ভ্রাতা মোক্তার আহমদ চৌধুরী একাধিক বার পেকুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন।
গুরা মিয়া চৌধুরীর ৫ পুত্রের মধ্যে এডভোকেট ফিরোজ আহমদ চৌধুরী দ্বিতীয়। ফিরোজ আহমদ চৌধুরী ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পাস করেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে কৃতিত্বের সাথে এল, এল, বি ডিগ্রী নেন। দীর্ঘ সময় কঙবাজার জেলায় আইন পেশায় রত থাকেন। সাথে সাথে জমিদারের সন্তান হিসেবে জনহিতকর কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। তিনি কঙবাজার জেলা আদালতের প্রথম পি.পি ছিলেন। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে এম. পি.এ নির্বাচিত হন। ছিলেন উদার মন মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, ধর্ম পালনে সক্রিয়।
১৯৬০ এর দশকে কক্সবাজার লালদীঘির উত্তরপাড়ে নিজস্ব বাসভবন, সাথে আবাসিক প্যানোয়া হোটেল প্রতিষ্ঠা করেন। পেকুয়া, কক্সবাজার কেন্দ্রিক হলেও চট্টগ্রামেও তাঁর বিচরণ ছিল। তিনি জীবনে ১০/১২ টি মসজিদ, মাদ্রাসা তথা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। ৭/৮ টি ইতিহাস ভিত্তিক ধর্মীয় গ্রন্থ রচনা করেন বলে জানা যায়। ১৯৬০, ১৯৯১ সহ একাধিক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ আজও স্মরণীয়। ন্যায়ের পক্ষে কথা বলায় পাক হানাদার বাহিনী দুই পুত্রসহ তাকে গ্রেফতার করে।
তিনি জনগণের সাথে ওতপ্রোতভাবে থেকে জীবন অতিবাহিত করেন। যা একালে জমিদার পরিবারের জন্য অনুকরণীয়, শিক্ষ্যণীয়। আগেকার জমিদারেরা শাসনের পাশাপাশি মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল প্রতিষ্ঠা, মুসাফির খানা, রাস্তাঘাট, সেতু, দীঘি/পুকুর নির্মাণ তথা জনহিতকর কাজে অবদান রেখে গেছেন। বড় বড় জমিদার বাড়িতে আতিথেয়তা সাধারণ ব্যাপার ছিল। প্রতিবেলা ১০/১২ জন বা তার কম বেশি অতিথি খাবার খেতেন। কিন্তু বর্তমানকালে এ জমিদার পরিবারের সন্তানে মন মানসিকতা, চিন্তা চেতনা, ত্যাগে, উদারে, মহানুভবতায়, অতিথিপরায়ণতায় কতটুকু আছে ভাববার বিষয়।
বস্তুতঃ বাঁশখালীর দক্ষিণপ্রান্ত থেকে পেকুয়াসহ বৃহত্তর চকরিয়ায় শতের কম বেশি ছোট বড় জমিদার পরিবার রয়েছে। এখানকার অনেক পরিবার কুতুবদিয়ার সাথে জড়িত বা কুতুবদিয়া হয়ে আগত। কুতুবদিয়ার শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ রশিদ আহমদ তাঁর রচিত ‘আউলিয়ার দেশ কুতুবদিয়া’ গ্রন্থে এ বিষয়ে দীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন।
আমাদের মূল বাড়ি বাঁশখালী হলেও ১৯২০ এর দশক থেকে পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া ও রাজাখালীতে পৈতৃক জমিজমা রয়েছে। ফলে ১৯৭০ এর দশকের শুরু থেকে পারিবারিক এস্টেট রাজাখালী, উজানটিয়া দেখভাল করতে যাওয়া হয়ে আসছে। সেই সময় নদীপথে নৌকা সাম্পান নিয়ে পেকুয়া যাওয়া হত। পরবর্তীতে যোগাযোগ ব্যবস্থা ধারণাতীত উন্নতি লাভ করায় নৌকা সাম্পানের স্থলে ইঞ্জিনচালিত গাড়ির যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে উজানটিয়া থেকে বাঁশখালী বা আরাকান রোডে যাতায়াতকালে পেকুয়া কবির মিয়া বাড়ির মসজিদে যোহর বা আসরের নামাজ, সাথে এ বাড়ির কবির মিয়া, এডভোকেট ফিরোজ মিয়াসহ মুরব্বিগণের যেয়ারত করার সুযোগ হয়ে আসছে।
এডভোকেট ফিরোজ আহমদ চৌধুরী একাধিক বার হজব্রত পালন করেন। ভারতসহ ইউরোপ, আমেরিকা সফর করেন।
এ মহান ব্যক্তিত্ব এডভোকেট ফিরোজ আহমদ চৌধুরী ২০০২ খ্রিস্টাব্দে ৮১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। পেকুয়া পারিবারিক মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে শায়িত।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।