প্রবাহ

কক্সবাজারসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৮ অক্টোবর, ২০২৫ at ১১:০৯ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম, সাথে কক্সবাজারকে নিয়ে বৃহত্তর চট্টগ্রাম। কক্সবাজার জেলার ভাষাসংস্কৃতি যাতায়াত সর্বোপরি আত্মীয়তা পারিবারিক বন্ধনে কক্সবাজার চট্টগ্রামের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যদিওবা প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ১৮৫৪ সালে কক্সবাজারকে পৃথক মহকুমা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ১৯৮৪ সালে মহকুমা স্থলে কক্সবাজারকে জেলায় উন্নীত করা হয়। তারপরও কক্সবাজার চট্টগ্রামের সাথে বহুবিধ সম্পর্ক রয়েছে। ভাষা ও সংস্কৃতি বহুবিধ দিক দিয়ে চট্টগ্রাম আর কক্সবাজার অভিন্ন বলা যাবে। তবে চট্টগ্রামের সাথে কক্সবাজার যোগাযোগ যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ছিল সাগরপথে স্টিমারে। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে চট্টগ্রামের সাথে কক্সবাজারে স্টিমার সার্ভিস ছিল। তেমনিভাবে চট্টগ্রামের সাথে আরাকানের রাজধানী আকিয়াব এবং মায়ানমারের আগেকার রাজধানী ইয়াঙ্গুনের সাথে সাগরপথে স্টিমার সার্ভিস ছিল। আরাকান ও মায়ানমার নিয়ে অন্যদিন লিখব আশা রাখি।

কক্সবাজারের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে জানতে পারা যায়, মোঘল বাহিনী চট্টগ্রাম জয় করার পর কক্সবাজারের অনেকটা রামু পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে নেয়। পরবর্তীতে তা নাফ নদী পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। তার আগে কক্সবাজারসহ চট্টগ্রামের দখল নিয়ে আরাকান আর ত্রিপুরা রাজাদের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহের ইতিহাস রয়েছে।

নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর মীর জাফরের পুত্র নবাব মীর কাশেম আলী খান ১৭৬০ সালে চট্টগ্রাম মেদেনীপুর ও বর্ধমান এই তিন জেলা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে অর্পণ করে। এখানে চট্টগ্রাম বলতে সাথে কক্সবাজারও রয়েছে। কক্সবাজারসহ চট্টগ্রামকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নিকট হস্তান্তরের চুক্তির লক্ষে চট্টগ্রাম শেষ মুসলমান কর্মকর্তা নবাব মীর মুহাম্মদ রেজা খান ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসেন। ১৭৬১ সালের ৫ জানুয়ারী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর প্রতিনিধি চিফ হেরি ভেরলস্টকে কক্সবাজারসহ চট্টগ্রামের শাসনভার বুঝিয়ে দেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কক্সবাজারের রামু পর্যন্ত সীমানাকে চট্টগ্রামের দক্ষিণ সীমানা মনে করে ততটুকু পর্যন্ত দখলে রাখে। কিন্তু পরবর্তীতে ১৭৯০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নাফ নদী পর্যন্ত মোঘলদের সীমানা জানতে পেরে তাদের সীমানায় সেখান পর্যন্ত বর্ধিত করে।

১৭৭২ সালে ওয়ারেন্ট হিস্ট্রিং চট্টগ্রাম অঞ্চলসহ বাংলার দেওয়ানী সহস্তে গ্রহণ করেন। সাথে সাথে বৃহত্তর চট্টগ্রামকে ৯ টি চাকলায় বিভক্ত করা হয়। তৎমধ্যে দক্ষিণ চট্টগ্রামের চাকলা দোহাজারী ও বাঁশখালী। এতে প্রতীয়মান হয় বর্তমান কক্সবাজার জেলায় হয়ত জনবসতি তত বেশি ছিল না। চাষাবাদযোগ্য জমি খুবই স্বল্প থাকাটা স্বাভাবিক। ঐ সময় কক্সবাজারের দক্ষিণাঞ্চলে জনসংখ্যা অধিক না হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স কক্সবাজারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। যার নামকরণে আজকের কক্সবাজার। তিনি মায়ানমার আর আরাকানের সাথে চরম বিরোধের ফলে কক্সবাজারের দক্ষিণাঞ্চলে আশ্রয় নেয়া আরাকানীদেরকে বসতি স্থাপনপূর্বক চাষাবাদে আত্মনিয়োজিত হতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। তখন কক্সবাজারের দক্ষিণাঞ্চলে বাঙ্গালী বসতি খুবই নগণ্য ছিল। ফলে জমি আবাদ হয়ে ব্রিটিশ কোম্পানীর রাজস্ব লাভ করতে জনবসতি তথা জনবলের প্রয়োজন ছিল।

আরাকান ও মায়ানমার ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে আসার পর চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের সাথে আরাকান ও মায়ানমারের মধ্যে সামুদ্রিক যাতায়াতের সূত্রপাত হয়। এখানকার সাথে আকিয়াব ও ইয়াঙ্গুনের স্টিমার সার্ভিস চালু হয়। ফলে এতদাঞ্চল থেকে বহু সংখ্যক বাঙ্গালী আকিয়াব ও ইয়াঙ্গুন গিয়ে ব্যবসাবাণিজ্যসহ নানান কর্মকান্ডে টাকা রোজগারে জড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম কক্সবাজারের বাঙ্গালীরা ব্যবসা বাণিজ্যের অজুহাতে সেখানে বসতি গড়ে তুলে। পাশাপাশি সেখানকার মেয়েদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দাম্পত্য জীবন শুরু করে দেয়।

১৮৫৪ সালে ব্রিটিশ সরকার কক্সবাজারকে মহকুমায় উন্নীত করে। সেই সময় তথা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ও ব্রিটিশ শাসন আমলে এই অঞ্চলের প্রশাসনিক হেড কোয়ার্টার ছিল রামু। চট্টগ্রাম জেলার অধীনে ১৭৯৬ সালে বর্তমান কক্সবাজার সদর থানা নিয়ে রামু একটি পূর্ণাঙ্গ প্রশাসনিক থানার মর্যাদা লাভ করে। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে থানা সদর রামু থেকে কক্সবাজার স্থানান্তরিত হয়। ১৯০৮ সাল পর্যন্ত কক্সবাজার থানার অধীনে রামুতে একটি পুলিশ ফাঁড়ি ছিল। পরবর্তীতে প্রশাসনিক সুবিধার্তে রামুকে স্বতন্ত্র থানার মর্যাদা দেয়া হয়।

ব্রিটিশ সরকারের আমলে ১৮৫৩ সালে সর্বপ্রথম সিএস C.S (Cadestel survey) শুরু হয় রামু থেকে। বিশেষ করে রামু মায়ানমার সীমান্তে প্রশাসনিক হেড কোয়ার্টারও ছিল। এই জরিপ ১৮৮৮ সালে রাজশাহী গিয়ে সমাপ্ত হয়।

কক্সবাজার মহকুমায় উন্নীত হওয়ার পর প্রথম দিকে ব্রিটিশরাই মহকুমার দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তখন মহকুমা প্রশাসক পদবীকে এসডিও বলা হত। অর্থাৎ সাব ডিভিশনাল অফিসার।

১৮৫৪ সালে যখন কক্সবাজার মহকুমায় উন্নীত হয় ঐ সময় তখনকার থানা আজকের উপজেলা সংখ্যা ছিল ৪টি। যথাকক্সবাজার সদর, মহেশখালী, চকরিয়া, টেকনাফ। তখন রামু, উখিয়া ও কুতুবদিয়ায় পুুলিশ ফাঁড়ি ছিল। পরবর্তীতে এই তিন পুলিশ ফাঁড়িকে থানায় যা বর্তমান উপজেলায় উন্নীত করা হয়।

ভাষাগতসহ নানাবিধ কারণে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে বহু বিষয়ে মিল রয়েছে। তেমনিভাবে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের সাথে আরাকান ও মায়ানমারের রয়েছে বহুবিধ মিল। অপরদিকে আরবি প্রভাবে প্রভাবিত থাকায় চট্টগ্রামকক্সবাজার বাঙ্গালীদের মধ্যে ব্যবসায়িক মনোভাব ছিল অত্যধিক। ফলে ব্রিটিশ আমলে শতাব্দী যুগে চট্টগ্রামকক্সবাজারের অসংখ্য বাঙ্গালী আকিয়াব ও ইয়াঙ্গুন অঞ্চলে অধিবাসী রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান ইয়াঙ্গুন আক্রমণ করে। এতে হঠাৎ করে তথায় আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, গণহত্যা ইত্যাদি নানা দুর্ভোগের প্রভাবে চট্টগ্রামকক্সবাজার অঞ্চলের অধিকাংশ বাঙালী পরিবারে চরম দুর্ভোগ তথা বিপর্যয় নেমে আসে। বহু ধনী সম্ভ্রান্ত পরিবার দেউলিয়া হয়ে এক কাপড়ে দেশের পানে রওনা দিতে বাধ্য হন। স্থলেপথে আসতে গিয়ে বনজঙ্গলের প্রতিকূলতায় অসংখ্য বাঙ্গালী মৃত্যুবরণও করেন।

১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভাগের পর চট্টগ্রামকক্সবাজারের সাথে আকিয়াব ও ইয়াঙ্গুনের যোগাযোগ অনেকটা বিছিন্ন হয়ে যায় বলা চলে। তবে পাকিস্তান সরকার চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হিসেবে স্টিমার সার্ভিস গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করে এবং আরাকান মহাসড়কে উন্নীত করতেও উদ্যোগ গ্রহণ করে। যদি ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় আরাকান মহাসড়ক ন্যূনতম যাতায়াত চলাচল থাকত তা হলে আকিয়াব, ইয়াঙ্গুন থেকে লাখো বাঙ্গালী কক্সবাজার চট্টগ্রাম পালিয়ে আসতে এত অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হত না।

উজানটিয়া অতঃপর মাতারবাড়ী বদরখালী হয়ে চট্টগ্রামকক্সবাজার স্টিমার সার্ভিস ছিল যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম। যা দীর্ঘ ২৩ বছরব্যাপী তথা ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল। এই স্টিমার ছনুয়া, বড়ঘোপ, মগনামা, মাতারবাড়ী, বদরখালী এলাকা থেকে যাত্রী উঠানামা করত। এই সব ঘাটে পাকিস্তান আমলে আভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সংস্থা কর্তৃক নির্মিত যাত্রী কল্যাণে দ্বিতল ভবন মনে হয় কোন কোন ঘাটে আজও দৃষ্টিগোচর হবে। উজানটিয়ামাতারবাড়ী এরিয়ায় নদীপথের গভীরতা কমে যাওয়ায় স্টিমার সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়।

ব্রিটিশ সরকার ১৯৩০৩১ সালে নাজিরহাটদোহাজারী রেল সার্ভিস চালু করে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত আরাকান মহাসড়ক রাস্তা থাকলেও সরাসরি যাতায়াত ছিল না। ব্রিটিশদের পুরানো জিপগুলো মেরামত করে চাদের গাড়ি হিসেবে স্থানে স্থানে যাতায়াত হত। চট্টগ্রামকক্সবাজার পূর্ব দিকের সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, পূর্ব চকরিয়া, ঈদগাহ এইসব অঞ্চলে যাতায়াত অনেকটা প্রতিকূলতা ছিল। আমিরাবাদ, হারবাং, চিরিঙ্গা, ডুলহাজারা, ঈদঁগাহ সেই ব্রিটিশ আমল থেকে যাত্রা বিরতির জংশন ছিল। ছিল মানবিক ন্যূনতম সুযোগ সুবিধা।

আরাকান মহাসড়ক পাকিস্তান আমল থেকে পুরোপুরি চালু হওয়ায় ১৬০ কি.মি দৈর্ঘ্য চট্টগ্রামকক্সবাজার যাতায়াত সহজতর হয়ে যায়। সাথে সংযোগ হয়েছে ঢাকাচট্টগ্রাম থেকে সরাসরি ট্রেন যোগাযোগ।

কিন্তু কক্সবাজার জেলার মহেশখালী, কুতুবদিয়া পশ্চিম চকরিয়াপেকুয়া উপজেলার জনগণ আরাকান মহাসড়ক পরিহার করে কম দূরত্ব বিধায় বাঁশখালীআনোয়ারা হয়ে চট্টগ্রাম শহরে আসাযাওয়া করছে। এই সড়ক পেকুয়া চৌমুহনী থেকে সোজা দক্ষিণে লালব্রীজ পর্যন্ত গিয়ে সড়ক উন্নয়নের কাজ থেমে যায়। এখান থেকে সুজাসুজি কক্সবাজার সড়ক নির্মাণ সময়ের দাবী। আনোয়ারাবাঁশখালী পেকুয়া এই পৃথক আঞ্চলিক সড়ক উন্নয়ন হয়ে পৃথক আরেকটি মহাসড়ক রূপ লাভ করলে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ৩০৪০ কি.মি কমে আসবে।

চট্টগ্রামবাসী আর কক্সবাজারবাসীর মধ্যে সেই ব্রিটিশ পাকিস্তান আমল থেকে সামাজিকতার পাশাপাশি এই দুই অঞ্চলের মানুষের খাবার রুচিসহ নানাবিধ দিক দিয়ে রয়েছে অভিন্নতা। চট্টগ্রামের সাথে কক্সবাজারের বন্ধন অটুক থাকুক এই কামনা করি।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুফিবাদ, মাজার সংস্কৃতি ও হযরত শাহজাহান শাহ্‌ (রঃ) : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশ সফরে আয়ারল্যান্ড টেস্ট দলে ৪ নতুন মুখ