পীরানে পীর বড় পীর হযরত শেখ আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)। পারস্যের গিলান প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। বিশুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য মতে তিনি হযরত আলী (ক.)’র বংশোদ্ভূত তথা আউলাদে রাসূল। শিশুকাল গিলানে মা–বাবার কাছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। শুধুমাত্র এলম অর্জনের অদম্য আকাক্ষায় ১৮ বছর বয়সে তিনি বাগদাদ গমন করেন। হযরত ইমাম সামশুদ্দীন যাহাবি হযরত বড় পীরের বর্ণনা করতে লিখেন, তিনি ছিলেন এমন আলেম যিনি দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত বিরল ব্যক্তি ও অনুসরণীয় শায়খুল ইসলাম। অলিগণের শিরোরত্ন, দ্বীনের বাস্তব জ্ঞান প্রদানকারী।
হযরত ইবনে রজব হাম্বলী তাবাকাতুল হানাবিলায় উল্লেখ করেন, হযরত বড় পীর ছিলেন সমকালে শ্রেষ্ঠ মুসলিম ব্যক্তি। শেখগণের নেতা, উচ্চমর্যাদার অধিকারী। তাঁর ছিল অসংখ্য কারামত ও অগাঢ় দ্বীনে এলম। এলম অর্জনে তিনি দীর্ঘ ৩২ বছর ব্যয় করেন। সেই সময় তিনি শরীয়তের নানাবিধ জ্ঞানার্জন করেন। অতঃপর শিক্ষাদান ওয়াজ–নসীহতের মহান কাজের সূচনা করেন।
হযরত পীরানে পীর বড় পীর এলম অর্জনের সময় বেশ দীর্ঘ। এ সুদীর্ঘ সময়ব্যাপী তাকে বিভিন্ন ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে। থাকা–খাওয়ায় প্রচণ্ড কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। এরপরও তিনি ন্যূনতম দমে যাননি। প্রাণান্তকর কষ্ট পরিশ্রম বড় পীরের ধৈর্য্য সহনশীলতার মজবুত বাঁধে একটু ফাটল ধরাতে পারেনি। বরং এই সব কষ্ট ও ত্যাগের কারণে তাঁর এলম অর্জনের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা আরও বেড়েছে। হয়েছে আরও আগের চেয়ে দৃঢ়।
হযরত ইবনে রজব হাম্বলী বর্ণনা করেন, হযরত বড় পীর নিজেই বর্ণনা করে গেছেন, বাগদাদে এলম অর্জনের প্রাথমিক জীবনে সবজির উচ্ছৃষ্ট ও নদীর পাশে উৎগত লেটুসপাতা ছিল আমার খাবার। একবার বাগদাদে জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির ফলে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। তখন একাধারে আমার কোন কিছুই খাওয়া হয়নি। সেই সময় আমি বাগদাদের নানা স্থানে ফেলে দেয়া উচ্ছৃষ্ট খাবার অনুসন্ধান করে দেখতাম তাতে খাবার মত কোন কিছু আছে কিনা। যেখানেই যেতাম দেখতাম আমার মত ক্ষুধার্থ অন্য কেউ দখলে নিয়েছে। কখনও ক্ষুধা মেটানোর জন্য সামান্য কিছু ফেলে দারিদ্র পীড়িত লোকেরা আমার চারপাশে ভিড় করত। ফলে আমি লজ্জায় সেগুলো রেখে চলে যেতাম।
একদিন রাস্তারধারে পড়ে থাকা খাদ্যযোগ্য পাতার সন্ধানে বাগদাদের পথে পথে ঘুরছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে রায়াহীন বাজারস্থ ইয়াছিন মসজিদে প্রবেশ করি। ক্ষুধার তাড়নায় অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ি। এক পা হাঁটারও সামর্থ্য ছিল না। নিরুপায় হয়ে মসজিদের এক স্থানে বসে পড়ি। মৃত্যু যেন আমার সাক্ষাতে এসেই পড়েছিল। এমন সময় এক যুবক মসজিদে প্রবেশ করে। তার হাতে সুস্বাদু রুটি ও বুনা গোশত। সেই ব্যক্তি আমারপাশে বসে খুব মজা করে খেতে লাগল। যতবার সে লোকমা উঠাচ্ছিল, ততবার ক্ষুধার জ্বালায় আপনা আপনি মুখ খুলে যাচ্ছিল। নিজেকে সংযত রেখে নিজেকে নিজেকে জিজ্ঞেস করি, ‘এসব কি করছ হে আবদুল কাদের’!
আমাকে আমি বলি,‘এখানে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই, আল্লাহ যদি আমার মৃত্যুর ফায়সালা করে তাই হবে।’ এমন সময় যুবক আমার দিকে তাকিয়ে বলে,‘ভাই বিসমিল্লাহ বলে শরীক হয়ে যান আমার সাথে।’ প্রথমে আমি খেতে রাজি হইনি। পরে যুবক আরও বিনয়ের সাথে অনুরোধ করে। তার বারং বার অনুরোধে খেতে বসি। তখন সে আমাকে প্রশ্ন করতে থাকেন,“আপনি কি করেন, এখানে কোথা থেকে এসেছেন? আপনার পরিচয় কী?” বললাম,“আমি বাগদাদ এসেছি এলম অর্জন করতে গিলান থেকে।” তখন উচ্ছ্বাস ভরা কণ্ঠে যুবক আমাকে বলল,“আমিও তো গিলান থেকে এসেছি। আচ্ছা আপনি কি আবদুল কাদের নামে গিলানের কাউকে চিনেন?”
বললাম,“ভাই আমিই আবদুল কাদের।” আমার কথা শুনে যুবকের এক আনন্দ–আভা ফুটে উঠল। কাঙ্ক্ষিত কোন কিছু মিলে যাওয়ায় আনন্দে সে যেন নেচে উঠল। বলল,‘ আমি যখন বাগদাদ পৌঁছাই তখন আমার খরচ পাতির সামান্য কিছু বাকী ছিল। আপনাকে আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজছিলাম; কেউ কিন্তু আপনার খবর দিতে পারছিল না। এর মধ্যে আমার খরচা পাতি ফুরিয়ে যায়। আপনার জন্য পাঠানো কিছু মুদ্রা ছাড়া আর কিছু ছিল না। তিন দিন এভাবেই কেটে যায়। এক পর্যায়ে মনে হল, এখন বোধ হয় মারা যাব। তখন নিরুপায় হয়ে আপনার জন্য পাঠানো অর্থ থেকে রুটি এবং গোশত কিনেছি। এই খাবার আপনারই; আপনি খান। এখন আমি আপনার মেজবান থেকে মেহমান হয়ে গেলাম। আশ্চর্য্যজনিত হয়ে বললাম, তা কি করে হল। যুবক বলল, আপনার মা আমার মাধ্যমে আপনাকে দেওয়ার জন্য ৮টি দিনার তথা স্বর্ণ মুদ্রা দিয়েছেন। অসম্ভব ক্ষুধায় আক্রান্ত হয়ে এই দিনার থেকে গোশত–রুটি কিনেছি। আমাকে ক্ষমা করুন ভাই! আমার জীবন বাঁচানোর জন্য কোন পথ ছিল না।
হযরত বড় পীর তাকে শান্ত করেন। তার প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বাকী খাবারটুকু তাকেই খেতে দেন। তা ছাড়া মায়ের পাঠানো স্বর্ণ মুদ্রা থেকে খরচের জন্যও কিছু মুদ্রা দেন। পরে যুবকটি সেখান থেকে চলে যান।
কাদেরিয়া তরিকার এই মহান ইমাম ছিলেন যেমনি নিরহংকারী তেমনি ছিলেন পাহাড় পর্বতসম ব্যক্তিত্বশালী। অহংকার হারাম, ব্যক্তিত্ব সুন্নাত। হযরত বড় পীর এত উন্নত ও উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হওয়া সত্বেও তিনি সীমাতিরিক্ত বিনয়ী ছিলেন। শিশু কিংবা বালিকা তার সাক্ষাতে দাঁড়িয়ে যা বলত তা তিনি শুনতেন এবং তাদের ফরমাইশ মতে কাজ করে দিতেন। অভাবী ও দারিদ্র শ্রেণীর লোকজনের নিকট তিনি বসতেন। তাদের কাপড়–চোপড় পরিষ্কার করে দিতেন।
অপরদিকে তথাকথিত বাগদাদের কোন দুনিয়াবী উচ্চ মর্যাদার ব্যক্তি কিংবা সাম্রাজ্যের কোন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের সম্মানার্থে তিনি দাঁড়াতেন না। খলিফা বা খলিফার প্রতিনিধির আগমন ঘটলে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে গৃহাব্যন্তরে চলে যেতেন। খলিফা বা খলিফার প্রতিনিধি উপবেশন করলে পর তিনি অভ্যন্তর থেকে আসতেন। যাতে খলিফা বা খলিফা প্রতিনিধিকে সম্মান দেখাতে দাঁড়াতে না হয়। দীর্ঘ ৭৩ বছরের বাগদাদ জীবনে তিনি কখনও কোন খলিফা বা খলিফার উজিরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াননি। বাগদাদ জীবনে তিনি মতান্তরে ৫ বা ৭ জন খলিফা বা খেলাফত এর প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী।
হযরত শেখ আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)’র কারামতের বিশাল ভান্ডার নিয়ে দুনিয়াতে কারও কোন দ্বিমত নেই। অধিকাংশ ঐতিহাসিকই একমত। শায়খুল ইসলাম ইজদুদ্দীন ইবনে আবদুস সালাম ও সালাফী তথা আহলে হাদীস মতাদর্শের ইমাম ইবনে তাইমিয়ার উক্তি,“শেখ (রহ.)’র কারামতের সংখ্যার গন্ডি চাড়িয়ে গেছে। তৎমধ্যে তাঁর সর্বাপেক্ষা বড় কারামত হল–মুর্দা দ্বীলকে জীবিতকরণ। আল্লাহ তাআলা তাঁর কলবের তাওয়াজ্জু ও মুখের তাহসিরে লাখো মানুষকে ঈমানী জিন্দেগী দান করেছেন। তাঁর অস্তিত্ব ছিল ইসলামের জন্য বসন্ত সমীকরণের ন্যায়। যা মৃত দ্বিলের মাঝে নবতর প্রাণ–স্পন্দন সৃষ্টি করে। শুধু তাই নয়, মুসলিম জাহানে ঈমান ও আধ্যাত্মিকতার এক নতুন জোয়ার বয়ে দিয়েছেন।
শেখ ওমন কিছানী বলেন, বাগদাদের শেখের এমন কোন মজলিস বসত না যেখানে ইহুদি বা খ্রিস্টানের কেউ না কেউ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করত। ডাকাত, খুনি ও নানাভাবে পাপে লিপ্ত লোকেরা তাওবার সৌভাগ্য লাভ করত। আর ভ্রান্ত আকিদা–বিশ্বাসের লোক তাদের ভ্রান্ত আকিদা থেকে সরে আসত।
হযরত জুব্বাই বর্ণনা করেন, আমাকে একবার হযরত শেখ বলেছিলেন: আমার মন চায় আগের যুগের মত মাঠে ময়দানে ও জঙ্গলে গিয়ে অবস্থান করি। আল্লাহর কোন মাখলুক আমাকে না দেখে আমিও না দেখি। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের কল্যাণ চান। আমার হাতে ৫ হাজারের অধিক ইহুদি ও খ্রিস্টান মুসলমান হয়েছে। ধূর্ত ও পেশাদার পাপীদের ভিতর থেকে লাখের অধিক লোক আমার হাতে তওবা করেছেন। এও আল্লাহপাকের এক বিরাট নিয়ামত।
হযরত শেখ আবদুল কাদের জিলানী ৭৩ বছর বাগদাদে অতিবাহিত করেন। এই সময়ের মধ্যে আব্বাসী খলিফা তার চোখের সামনে খিলাফতের আসনে সমীচীন হন। যখন তিনি বাগদাদে আগমন করেন তখন ছিল খলিফা মোস্তাজহির বিল্লাহ আবুল আব্বাসের যুগ (৫১২ হিজরি)। তারপর মুস্তারশিদ, রাশেদ, আল–মুকতাদী লি আমরিল্লাহ ও আল–মুস্তানজিদ বিল্লাহ যথাক্রমে খলিফার আসনে সমাসীন হন। পীরানে পীর বড় পীর হযরত শেখ আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)। তিনি তাসাউফ জগতের মহান ব্যক্তিত্ব। কাদেরিয়া তরিকার ইমাম। তাঁর কারামতের ভান্ডার বিশাল। তাঁর দীর্ঘ বাস্তব জীবন আমাদের জন্য অনুকরণীয় অনুসরণীয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।