প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ১৯ মার্চ, ২০২৫ at ৪:৩৪ পূর্বাহ্ণ

পবিত্র মক্কায় বরকতময় কবরস্থান জান্নাতুল মুয়াল্লা

পবিত্র কাবার উত্তর দিকে পাহাড়ের অনেকটা তিনদিকে ঘেরা পাদদেশে জান্নাতুল মুয়াল্লা কবরস্থানের অবস্থান। এই কবরস্থানে লাশ দাফন কবে থেকে শুরু তা অস্পষ্ট। নবী পাক (.)’র আগমনের অনেক আগে থেকে এই কবরস্থানের অস্তিত্ব রয়েছে। আগেকার আমলে পবিত্র মক্কায় একাধিক কবরস্থানের কথা জানা যায়। যদি তা সত্য হয় তবে জান্নাতুল মুয়াল্লা শুধুমাত্র কুরাইশ বংশের জন্য বিবেচিত। নবী পাক (.)’র মহান দুই সন্তান এবং হযরত খাদিজাতুল কোবরা এখানে শায়িত। সেই সময় এবং পরবর্তীতে সাহাবা তাবেয়ীগণকে এখানে শায়িত করা হয়। হযরত খাদিজাতুল কোবরা (.) যেখানে শায়িত তথা হতে দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ নিচের দিকে পবিত্র কাবার দিকে কবরস্থান সম্প্রসারিত হয়ে আসছে। হযরত খাদিজাতুল কোবরা (.)’র কবরের উত্তরে উপরের দিকে তথা পাহাড়ের পাদদেশে কুরাইশ বংশের অনেক কবর বিদ্যমান। এই সব কবর কুরাইশ বংশের আগেকার আমলের লোকজনেরই হওয়ার কথা। আবু তালেব, আবদুল মুত্তালিব, আবদে মানাফ, হাশিমসহ সেই সময়কার এবং আরও আগের কুরাইশ বংশের অনেকে এখানে শায়িত।

বিশ্বের বুকে হিন্দু, বড়ুয়া ধর্মাবলম্বী বাদে খ্রিস্টান, ইহুদিসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলার রেওয়াজ নেই বললেই চলে। অর্থাৎ মাটি খুঁড়ে পুঁতে ফেলা হয়। সেই রেওয়াজ মতে কুরাইশ বংশের আগেকার লোকদেরকে এই পাহাড়ের পাদদেশে সমাহিত করা হয়ে আসছে।

নবী পাক (.)’র ১৩ বছরের নবুওয়াত জিন্দেগীসহ ২৩ বছরের নবুওয়াত জিন্দেগীতে যারা পবিত্র মক্কায় ইন্তেকাল করেছেন তাদেরকে এখানেই সমাহিত করা হয়। এতটুকু ধারণা করা যায়, পাহাড়ের পাদদেশে কুরাইশ বংশের যাদেরকে এখানে কবর দেয়া হয় তাদের অংশ বাদ রেখে দক্ষিণে তথা নিচের দিকে এসে নবী পাক (.)’র পরিবার ও সাহাবাগণকে দাফন করতে এই কবরস্থান ব্যবহার করেছেন।

উম্মে হাতুল মোমেনীন হযরত খাদিজাতুল কোবরা (.) নবী পাক (.) নবুওয়াত জিন্দেগীতে ইন্তেকাল করেন। নবী পাক (.) এখানে নিজ হাতে তাঁকে দাফনের ব্যবস্থা করেন। ঐ সময় জানাযার প্রবর্তন হয়নি।

নবী পাক (.)’র আমল পরবর্তীতে সাহাবা তাবেঈ শায়িত হয়ে এই কবরস্থান দক্ষিণ দিকে সম্প্রসারিত হয়ে আসছে। নবী পাক (.)’র নিকট এই কবরস্থান স্বীকৃত হওয়ায় পবিত্র মক্কায় মনে হয় অন্যান্য কবরস্থান বিলুপ্ত হয়ে যায়। ইহা গবেষণার বিষয়। বিগত ১৪৪০ বছরের ইতিহাসে ১৯৭০/৮০ এর দশক পর্যন্ত পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনায় এ দুই পবিত্র কবরস্থান ব্যবহারে তেমন নিয়ন্ত্রণ বিধি নিষেধে ছিল না মনে করি। পরবর্তীতে সৌদি সরকার জান্নাতুল মুয়াল্লা কবরস্থানে উত্তর দিকে উপরাংশে কুরাইশ বংশের অংশটি দেয়াল দিয়ে ঘেরাও করে দেয়। দুই পবিত্র নগরীতে দুই কবরস্থানে জেয়ারতের উদ্দেশ্যে গমনাগমনে বিধি নিষেধ আরোপ করে।

জান্নাতুল মুয়াল্লা এই কবরস্থানের কিছুটা দক্ষিণে পশ্চিমপাশে হযরত আসমা (.) (হযরত আয়েশা ছিদ্দিকা (.)’র বড় বোন) এবং তাঁর পুত্র হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর (.) ১০/১৫ ফিটের ব্যবধানে দুই ব্লকে শায়িত। জান্নাতুল মুয়াল্লা ও জান্নাতুল বাকী প্রতি কবরস্থানে হাজার সাহাবা তাবেয়ী শায়িত। জান্নাতুল মুয়াল্লা কবরস্থান দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে ব্যাপক সম্প্রসারণ করা হয়।

সৌদি নাগরিকত্ব পাওয়া এক বিজ্ঞ ব্যক্তি থেকে জানতে পারি বিগত ২০/২৫ বছর আগে পবিত্র মক্কার সৌদিগণের পক্ষ থেকে সরকারের নিকট আপত্তি/আবেদন জানানো হয়, হজ্ব ওমরাহযাত্রী ইন্তেকাল করলে যে হারে এখানে জান্নাতুল মুয়াল্লায় দাফন করা হচ্ছে, এতে তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য জান্নাতুল মুয়াল্লায় দাফন করা নিয়ে সংকট সৃষ্টি হতে পারে। সৌদি সরকার এই আবেদনকে গুরুত্ব দেয়। ফলে পবিত্র মক্কার পূর্ব দিকে কিছুটা উত্তরে সোরাইয়া নামক স্থানে হজ্ব ও ওমরাহকারীগণকে দাফনের ব্যবস্থা হয়ে আসছে, যা বর্তমানেও কার্যকর। তবে এই কবরস্থানের এরিয়াটি হুদুদে হারাম তথা হারামের সীমানার ভিতর। অপরদিকে পবিত্র মদিনায় সৌদি থেকে কোন আপত্তি না আসায় হজ্ব ওমরাহ জেয়ারতকারী পবিত্র মদিনায় ইন্তেকাল করলে জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে সাবেক নিয়মে দাফন করা হচ্ছে।

তুর্কি সুলতানেরা হেজাজকে ৪ শত বছর বা কম বেশি সময় শাসন করে গেছেন। ইস্তাম্বুল থেকে কয়েক হাজার কি.মি দূরে হেজাজ। মূলকে শামের দামেস্ক থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিকূল যোগাযোগেও ৪০ দিন সময় লাগত পবিত্র মদিনায় পৌঁছতে। কিন্তু তারা ঘন ঘন দুর্গ স্থাপন করে যথেষ্ট সংখ্যক সৈন্য রেখে হেজাজের নিরাপত্তা ধরে রাখে। মহান আহলে বাইত, উম্মে হাতুল মোমেনীনসহ নবী পাক (.)’র পরিবারবর্গের প্রতি অতীব আবেগ প্রবণ হয়ে তারা জান্নাতুল বাকী, জান্নাতুল মুয়াল্লা কবরস্থানে ছোট ছোট গম্বুজ নির্মাণ করে রাখে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর সাথে তুরস্কের পরাজয় হয়। ঐ সময় প্রতিকূলতায় হেজাজের তুর্কি গভর্নর শরীফ হোসাইন বিশ্বাস ঘাতকতা করে নিজেকে নিজে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। পরবর্তীতে আমিরুল মোমেনীন ঘোষণা করে বসে। প্রতিনিধি তথা গভর্নর এবং স্বাধীন আমির এক কথা নয়।

শরীফ হোসাইন দেশ চালাতে অনভিজ্ঞ, সেই সুযোগে ১৯২৪ সালে পিতা আবদুল আজিজের নির্দেশে যুবক ফয়সাল তায়েফ থেকে তাদের বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে বিনা বাধায় পবিত্র মক্কা দখল করে নেয়। এরপর জেদ্দা অতঃপর পবিত্র মদিনা দখল করে। ব্রিটিশের সহযোগিতায় শরীফ হোসাইন জেদ্দা হয়ে লোহিত সাগর দিয়ে ফিলিস্তিনের দিকে পালিয়ে যায়। তুর্কি মতাদর্শ আর সৌদি আবদুল ওয়াহাব নজদীর মতাদর্শ আকাশ পাতাল ব্যবধান। সৌদিরা জান্নাতুল মুয়াল্লা ও জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে গম্বুজ নির্মাণ শিরক বিদআত মনে করে ধুলিসাৎ করে দেয়।

হজ্ব ওমরাহকারীরা পবিত্র মক্কায় অবস্থানকালে জান্নাতুল মুয়াল্লা কবরস্থানে জেয়ারতে যেতে আকৃষ্ট হয়। এই পবিত্র কবরস্থানের পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে গেইট দিয়ে প্রবেশ করেন। এখানে অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হযরত খাদিজাতুল কোবরা (.)’র জেয়ারতে আসা। সৌদি কর্তৃপক্ষ ২০/২৫ বছর আগে গ্রিল সমেত বড় বড় জানালা দিয়ে দেয়াল নির্মাণ করে দেয়। ফলে জানালার বাহিরে দাঁড়িয়ে হযরত খাদিজাতুল কোবরা (.) এবং তাঁর গর্ভের দুই মহান পুত্রের জেয়ারত করা হয়। অবস্থা দেখে মনে হয় এখানে আরও সাহাবার কবর রয়েছে।

বস্তুতঃ বিশ্বের বুকে জান্নাতুল মুয়াল্লা ও জান্নাতুল বাকী আমরা মুসলমানগণের কাছে অতীব পবিত্রতম কবরস্থান। এই দুই কবরস্থান নিয়ে নবী পাক (.) বলে গেছেন বরকতময় এই কবরস্থানে সমাহিত ব্যক্তির সৌভাগ্য বুঝার জন্য এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে মৃতদের দাফনের জায়গাটি স্বয়ং আল্লাহ তাআলা নবী পাক (.) কে আদেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া হাদিসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যে ব্যক্তির জমিনে চিড় ধরবে, সেই ব্যক্তি আমি। তারপর আবু বকর (রা.), তারপর ওমর (রা.), তারপর আহলে বাইত।

আমি আহলে বাইত এর পাশে থাকব। তারা আমার সঙ্গে একত্র হবে। তারপর আমি মক্কাবাসীর জন্য অপেক্ষা করব। তারা পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনার মাঝামাঝি জায়গায় এসে আমার সঙ্গে মিলিত হবেন। (সুনানে তিরিমজি)

হজ্ব ও ওমরাহকারীরা পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনা গমন করলে এই দুই পবিত্র কবরস্থানে এক বা একাধিক বার জেয়ারতে গমন করার তাওফিক দান করুক। আমিন ।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধআসিয়ারা কি চিরকাল মরে মরেই বেঁচে যাবে?