ভারতে পশ্চিমবঙ্গের বান্ডেলে শায়িত রয়েছেন মহান আউলাদে রাসূল হযরত শাহ সৈয়দ আবদুল বারী (রহ.) আল হাসানী ওয়াল হোসাইনী। ৬ রমজান তাঁর ওফাত বার্ষিকী। অর্থাৎ ১৯০০ সালে ৬ রমজান এই মহান আউলাদে রাসূল মাত্র ৪০ বছর বয়সে পশ্চিমবঙ্গের বান্ডেলে ইন্তেকাল করলে তথায় তাঁকে শায়িত করা হয়।
বান্ডেল হযরত শাহ সৈয়দ আবদুল বারী (রহ.)’র পীরজাদা পরবর্তীতে মুরিদ ও খলিফা আজমগড়ী হযরতের মাধ্যমে চট্টগ্রাম অঞ্চলে কঠোর শরীয়তের উপর তরিকত ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়। যা এতদঞ্চলে আজমগড়ী সিলসিলা হিসেবে প্রসিদ্ধ। চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১০/১২ স্থানে আজমগড়ী সিলসিলার জংশন রয়েছে। তৎমধ্যে গারাংগিয়া, চুনতী, হালিশহর অন্যতম।
হযরত সৈয়দ শাহ (রহ.)’র ছিলেন অতীব আর্থিক প্রতিকূলতায়। তিনি থাকতেন অনাহারে, অর্ধাহারে। ঘরটি ছিল জরাজীর্ণ। চিশতিয়া তরিকার মহান শেখ ভারতে উত্তর প্রদেশের আজমগড়বাসী হযরত মিয়া করিম বখ্শ (রহ.) ছিলেন তাঁর পীর। তাঁর সুযোগ্য একমাত্র পুত্র হযরত শাহ মাওলানা হাফেজ হামেদ হাসান আলভী (রহ.) কে তাঁর মুরিদ সৈয়দ আবদুল বারী (রহ.)’র নিকট মুরিদ করিয়ে নেন। অপরদিকে, হযরত শাহ সৈয়দ আবদুল বারী (রহ.)’র মুজাদ্দেদীয়া তরিকার পীর হচ্ছেন হযরত সুফি গোলাম সালমানী আব্বাসী ফুরফুরা (রহ.)।
আমাদের দেশে একটি প্রবাদ আছে, যে হয় সে নয় বছরে হয়ে যায়। অর্থাৎ শিশুকালে হয়ে যায়। তেমনিভাবে হযরত শাহ সৈয়দ আবদুল বারী (রহ.)’র জীবনটা শিশুকাল থেকে কারামতে ভরপুর। যৌবনে পদার্পণ করতে না করতেই ৭ তরিকার মহান ইমামগণ তাঁকে খেলাফত দানে ভূষিত করেন।
যথা– কাদেরিয়া তরিকার ইমাম হযরত বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)। চিশতিয়া তরিকার ইমাম হযরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি আজমিরী (রহ.)। নকশবন্দিয়া তরিকার ইমাম হযরত বাহাউদ্দিন নকশবন্দ (রহ.)। মুজাদ্দেদীয়া তরিকার ইমাম মুজাদ্দেদে আল ফেসানী হযরত শেখ আহমদ ফারুকী (রহ.)। করনিয়া তরিকার ইমাম হযরত ওয়ায়েস করনী (রহ.)। সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকার ইমাম হযরত শিহাব উদ্দিন সোহরাওয়ার্দীয়া (রহ.)। শাযিলিয়া তরিকার ইমাম হযরত আবুল হাসান শাযিলী (রহ.)।
বান্ডেলে শায়িত হযরত সৈয়দ শাহ হুজুর মাত্র ৪০ বছর জীবনে ১৮ জন মুরিদ ছিলেন বলে জানা যায়। তৎমধ্যে ১৫ জনের তালিকা পাওয়া যাচ্ছে। ১৯০০ সালে ইন্তেকালের পূর্বে মাত্র ২ জনকে খেলাফত দানে ভূষিত করেন। তৎমধ্যে শাহ মাওলানা হাফেজ হামেদ হাসান আলভী (রহ.) (আজমগড়ী হযরত) ও একই গ্রামের হযরত শাহ মাওলানা আবদুস সমদ (রহ.)। উভয়ের বাসস্থান মাত্র ৫/৭ শত মিটার ব্যবধানের মধ্যে। সৈয়দ শাহ হুজুর ইন্তেকালের পূর্বে বলে গেছেন তাঁর সিলসিলা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক বিকশিত হবে। বাস্তবেও তাঁর মহান খলিফা আজমগড়ী হযরতের মাধ্যমে চট্টগ্রাম অঞ্চলসহ বিশ্বব্যাপী এই সিলসিলা ব্যাপক বিকশিত হয়। সৈয়দ শাহ হুজুরের খলিফা আজমগড়ী হযরত এর উপর নির্দেশ ছিল বৎসরে ন্যূনতম ৩ মাস তরিকতের সফর করা। জীবনে সক্ষম থাকা পর্যন্ত তিনি এই কার্যক্রম পালন করে গেছেন। তৎমধ্যে চট্টগ্রাম অঞ্চল অন্যতম।
আজমগড়ী হযরত চট্টগ্রাম অঞ্চলে ব্যাপক তরিকতের সফর করেন ১৯০০ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ৪০ বছর। এতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে আজমগড়ী হযরতের মাধ্যমে বান্ডেলে শায়িত হযরত সৈয়দ শাহ হুজুরের সিলসিলা ব্যাপকতা লাভ করে।
আজমগড়ী হযরত চট্টগ্রাম শহরে হালিশহর হযরত হাফেজ মুনির উদ্দিন (রহ.)’র বাড়িতে, চন্দনপুরা জমিদার এয়ার আলী খানের বাড়িতে, দক্ষিণ চট্টগ্রামের চুনতী ইউসুফ মঞ্জিলে (হযরত শাহ ছাহেবের দাদার বাড়িতে) অবস্থান নিতেন।
ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রাম বন্দর ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ জংশন। এখান থেকে কলকাতা, কক্সবাজার, আরাকানের রাজধানী আকিয়াব এবং মায়ানমারের রাজধানী ইয়াঙ্গুন (রেঙ্গুন) নিয়মিত জাহাজ সার্ভিস ছিল।
ছনুয়া মনুমিয়াজী পরিবারের মুহাম্মদ উল্লাহ মিয়া ছিলেন আজমগড়ী হযরতের সরাসরি মুরিদ। তিনি তাঁর মহান পীরকে চট্টগ্রাম শহর থেকে স্টিমারে করে ছনুয়া তাদের জমিদার বাড়িতে নিয়ে যেতেন। কুতুবদিয়া হযরত আবদুল মালেক শাহ (রহ.) সহ এই অঞ্চলে অসংখ্য জমিদার, আলেম, সাধারণ মানুষ তাঁর সান্নিধ্যে এসে সৌভাগ্য লাভ করেন।
বান্ডেল হযরত সৈয়দ শাহ হুজুর ছিলেন আজমগড়ী হযরতের পিতা হযরত মিয়া করিম বখশ (রহ.)’র মুরিদ। মিয়া করিম বখশ (রহ.) ছিলেন ভারতীয় রেলের জরিপ বিভাগের কর্মকর্তা। আজমগড়ের কোহন্ডায় বিশাল ভূ–সম্পত্তির মালিক। এলাকার জামে মসজিদটি বাড়ি থেকে কিছুটা দূরত্বে হওয়ায় তিনি বাড়ির সামনে ছোট এবাদতখানা প্রতিষ্ঠা করেন। মিয়া করিম বখশ (রহ.)’র জমিদার স্টাইলের দ্বিতল বিশিষ্ট দালান এবং বাড়ির নিকটে নিজস্ব পারিবারিক করবস্থান। তাঁর পীর হযরত নেজাবত আলী (রহ.) আজমগড়ে মুরিদ তথা মিয়া করিম বখশ (রহ.)’র বাড়িতে তরিকতের সফরে আসলে এখানেই ইন্তেকাল করেন। এতে নিজের পীর হযরত নেজাবত আলী (রহ.) কে এখানে জানাযার পর দাফন করা হয়।
আজমগড়ী হযরত বান্ডেল হযরত সৈয়দ শাহ (রহ.)’র প্রতি অতীব নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। বান্ডেলে খানকাহ মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। আজমগড়ী হযরত কর্র্তৃক ১৯৪০ সালে বান্ডেলে রেজিস্ট্রিকৃত খানকাহ ১৩ সদস্য বিশিষ্ট ওয়াকফ কমিটিতে জমিদার মুহাম্মদ উল্লাহ মিয়া মুতওল্লি ছিলেন।
হযরত সৈয়দ শাহ (রহ.) জীবদ্দশায় একাধিকবার আজমগড়ের কোহন্ডা নিজের পীরের বাড়িতে গমন করেন। ঐ সময় ভারতবর্ষে দূরযাত্রার প্রধান মাধ্যম ছিল ট্রেন। ফলে সৈয়দ শাহ হুজুর স্বভাবতই বান্ডেল থেকে ট্রেনে শাহগঞ্জ ট্রেন স্টেশনে পৌঁছতেন। শাহগঞ্জ ট্রেন জংশন থেকে ১০/১২ কি.মি দূরত্বে আজমগড়ী হযরতের পৈতৃক বাড়ি। আজমগড়ী হযরত মৌলিকভাবে হযরত সৈয়দ শাহ (রহ.)’র পীরজাদা। পরবর্তীতে মুরিদ। আজমগড়ী হযরত সৈয়দ শাহ হুজুরের অপর খলিফা মাওলানা আবদুস সমদ (রহ.) সহ পালকি (সেকালে কাঁধে বহনযোগ্য) নিয়ে শাহগঞ্জ ট্রেন স্টেশনে আসতেন। হযরত সৈয়দ শাহ (রহ.) কে পালকিতে উঠায়ে সামনের দিকে কাঁধে নিতেন আজমগড়ী হযরত পেছন দিকে কাঁধে নিতেন হযরত আবদুস সমদ (রহ.)। ১০/১২ কি.মি পথ সৈয়দ শাহ হুজুর সহ পালকি কাঁধে নিয়ে আজমগড়ী হযরতের পৈতৃক দ্বিতল জমিদার বাড়িতে পৌঁছতেন।
হযরত সৈয়দ শাহ (রহ.)’র আজমগড় পীর ছাহেবের বাড়িতে গমন করলে পীরজাদা পরবর্তী মুরিদ ও খলিফা আজমগড়ী হযরতের প্রতি নির্দেশ থাকত, এলাকার কেউ যদি জানতে চায় উনি কে, তাকে যাতে বলা হয় ইনি আমাদের বাড়িতে মেহমান এসেছেন। তিনি যে তরিকতের শেখ, পীর তা যাতে গোপন রাখা হয়।
আজমগড়ী হযরত ১৯০০ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর ব্যাপী চট্টগ্রাম অঞ্চলে তরিকতের সফর করতে থাকায় তাঁর ৪৪ জন খলিফার মধ্যে ১৬ জন খলিফা চট্টগ্রাম অঞ্চলেই রয়েছেন। এই ১৬ জন খলিফার কেউ জীবিত থাকার কথা নয়। কিন্তু তাদের পরবর্তী খলিফাগণের মধ্যে আজমগড়ী হযরতের মাধ্যমে বান্ডেল সৈয়দ শাহ হুজুরের সিলসিলা আজও ব্যাপকভাবে রয়েছে। এই সিলসিলায় কোন শরীয়ত বিরোধী কাজ নেই, এখানে নারীদের বিচরণের সুযোগ নেই। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ বাদ দেয়া যাবে না। এখানে ন্যূনতম শিরক বিদআত নেই।
আজমগড়ী হযরতের মাধ্যমে হযরত সৈয়দ শাহ (রহ.)’র সিলসিলা এত বেশি আকর্ষণীয় যে, পশ্চিমবঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ বান্ডেলে হযরত সৈয়দ শাহ (রহ.) যেয়ারতে আসতে থাকেন। তেমনিভাবে বাংলাদেশ থেকেও। বাংলাদেশের মধ্যে চট্টগ্রাম অঞ্চল অন্যতম। এমন কোন দিন যাবে না, চট্টগ্রামের লোক বান্ডেলে গমন করছে না। এমনও ব্যক্তি রয়েছেন যারা বান্ডেলে ২/৩ দিন বা ৪/৫ দিন থেকে যাবেন। রাজনীতি পট পরিবর্তনের পর ভারতীয় ভিসা বন্ধ থাকায় চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের লোকজন বান্ডেলে যাতায়াত বন্ধ বলা যাবে।
বান্ডেলে হযরত সৈয়দ শাহ হুজুর ১৯০০ সালের ৬ রমজান ইন্তেকাল করেন। তাঁরই পীরজাদা পরবর্তীতে খলিফা যার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী তরিকত বিকশিত। আজমগড়ী হযরত ইন্তেকাল করেন ১৯৫৯ সালে। বান্ডেলে হযরত সৈয়দ আবদুল বারী (রহ.) আল হাসানী ওয়াল হোসাইনী সাথে তাঁর পীরজাদা ও খলিফা আজমগড়ী হযরতের ওফাত বার্ষিকীতে কৃতজ্ঞতা চিত্তে স্মরণ করছি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।