গাজায় বর্বর ইসরাইলীরা হামাসকে দমাতে গিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে বিমান হামলা চালিয়ে নিরীহ ফিলিস্তিনীদেরকে হত্যা করা শুরু করে। ধ্বংস করতে শুরু করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, মসজিদ সাথে ফিলিস্তিনীদের ঘর–বাড়ি ত আছেই। ১৯ জানুয়ারী রবিবার যুদ্ধ বিরতি কার্যকর হয়। তা হয়ত বা সাময়িক। জানি না, হামাসের এই কৌশলটা ফিলিস্তিনীদের জন্য ভুল পদক্ষেপ ছিল কিনা!
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস যোদ্ধারা জবর দখলী ইসরাইলে ঢুকে কয়েক শত ইসরাইলীকে বন্দী করে নিয়ে আসে। তাদের হয়ত মানসিকতা কাজ করছিল ইসরাইলীদেরকে তাদের সুরক্ষিত সুড়ঙ্গের ভিতর আটকে রাখলে ইসরাইলে হাজার হাজার বন্দী ফিলিস্তিনীকে মুক্ত করা যাবে বন্দী বিনিময়ের মাধ্যমে। কিন্তু ইসরাইল হামাসের সেই চিন্তাধারাকে উলটপালট করে দিল। শুরু করে দিল ফিলিস্তিনীদের ধ্বংস করার কৌশল। ইসরাইলের বেপরোয়া সাহসের পেছনে অন্যতম সহায়ক শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছিল বলেই ত ইসরাইলীরা দীর্ঘ ১ বছর ৩ মাস ব্যাপী গাজায় রাত–দিন বিমান হামলা চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
১ম বিশ্বযুদ্ধ ও ২য় বিশ্বযুদ্ধ বাদে সাম্প্রতিককালে বিশ্বের বুকে এ রকম ৪৭ হাজার নর–নারী–শিশুকে হত্যা করা ভাববার বিষয়। হামাস যোদ্ধারাই ইসরাইলীদের বন্দি করে এনেছিল। ইসরাইলীদের উচিত ছিল হামাসকে ধ্বংস করা। তা সহজ নয় বিধায় তারা মানবতা বিরোধী অপরাধ শুরু করে। অর্থাৎ সাধারণ ফিলিস্তিনীদেরকে মারার কৌশল শুরু করে। সাময়িক যুদ্ধ বিরতি হল। হামাস যুদ্ধ বন্দিদেরকে পর্যায়ক্রমে মুক্তি দিবে। ইসরাইলও হাজার হাজার ফিলিস্তিনী বন্দিদের থেকে আংশিক মুক্তি দিবে।
ইসরাইলীরা গাজায় নিরীহ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করতে থাকায় লেবানন, ইয়েমেনও অনেকটা সক্রিয় হয় ফিলিস্তিনের পক্ষে। লেবাননেও ইসরাইলী হামলায় কয়েক হাজার মানুষকে জীবন দিতে হয়। ক্ষতি হয় অনেক অবকাঠামোর। ইয়েমেনের হুতি যোদ্ধারা নানাভাবে তাদের যোগ্যতা অনুসারে ইসরাইলকে আঘাত করতে থাকে। এতে ইসরাইলের সাথে সংশ্লিষ্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালায় ইয়েমেনে।
মাত্র ৪৫ বর্গ কিলোমিটার এর বিশ্বের প্রাচীন জনপদ এ গাজা। বর্তমানে প্রায় ৯ লাখ বা কম বেশি আরব এখানে বসবাস করে। ইহা মুলকে শামের একটি ক্ষুদ্র অংশ। মুলকে শাম বলতে বিশ্বের প্রাচীন সমৃদ্ধ অঞ্চল, যেখানে ফিলিস্তিন (জবরদখলী ইসরাইল), লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান, ইরাক ও ইরানের পশ্চিমাংশ, তুরস্কের পূর্ব দক্ষিণাংশ নিয়ে মুলকে শাম। গাজাসহ বর্তমান জবরদখলী পুরো ইসরাইলই মূলকে শামের অন্তর্ভুক্ত। গাজা উপত্যকা ফিলিস্তিনের একটি শহর বলা যাবে। প্রায় ৫ হাজার বছর বা তারও অনেক আগে থেকে গাজায় জনবসতি। এখানে আরব ফিলিস্তিনী মুসলমানেরা খুব গিজগিজ করে বসবাস করেন। এই গাজার অভ্যন্তরে হামাস নামে সংগঠন সুসংগঠিত হয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলে। মূলতঃ গাজা এক প্রকার ফিলিস্তিনের স্বাধীন অঞ্চল বললে বাড়িয়ে বলা হবে না।
গাজার পশ্চিম দিকে পুরোটাই ভূমধ্যসাগর, উত্তর ও পূর্বে ইসরাইল, দক্ষিণে মিশর। মিশর সীমান্তকে রাফাহ ক্রসিং বলা হয়। গাজা থেকে রাফাহ ক্রসিং দিয়ে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বলা যাবে। গাজার পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর হলেও জবরদখলী ইসরাইল সাগরকে এমনভাবে অবরোধ করে রেখেছে যাতে গাজা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে।
প্রাচীনকাল থেকে গাজা বৃহত্তর মুলকে শামের অন্তর্ভুক্ত তথা ফিলিস্তিনের অর্ন্তভুক্ত। ১৯৪৮ সালে জবরদখলী ইসরাইলী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় সিনাই উপদ্বীপের সাথে গাজাও মিশরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৬৭ সালের ৬ দিনের যুদ্ধের সময় সিনাই উপদ্বীপের সাথে গাজাও ইসরাইলীরা দখল করে নেয়। ১৯৭৩ সালে মিশর–ইসরাইল ১৭ দিনের ভয়াবহ যুদ্ধে ইসরাইলের চরম প্রতিকূলতাহেতু আমেরিকার আশ্বাসের মাধ্যমে হস্তক্ষেপে যুদ্ধ বিরতি হয়। অতঃপর ১৯৭৯ সালে ক্যাম ডেভিড চুক্তির মাধ্যমে ১৯৮২ সালে ইসরাইল সিনাই উপদ্বীপ মিশরকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু গাজা ইসরাইল অধিকৃত প্রত্যাহার হয়ে ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণে থেকে যায়। মিশরের সিনাই উপদ্বীপের সাথে গাজার প্রায় ১৪ কি.মি (৮.৭ মাইল) রাফাহ ক্রসিং ইসরাইলের হস্তক্ষেপের কোন সুযোগ নেই। তারপরও ইসরাইল মিশরসহ আন্তর্জাতিকভাবে রাফাহ ক্রসিং দিয়ে গাজায় প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করছে। যা সম্পূর্ণ অবৈধ হস্তক্ষেপ বলা যাবে।
মিশর গাজার মজলুম আরব মুসলমানগণের কল্যাণে শক্ত অবস্থানে থাকলে এই গাজাবাসীর কতই না উত্তম হত। কিন্তু মিশরের বর্তমান সামরিক শাসক মনে হয় গাজার স্বার্থে ফিলিস্তিনের স্বার্থে ইসরাইলের সাথে কৌশল অবলম্বন করছে। হয়ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের প্রভাবের ভয়ে এই সামরিক সরকার ইসরাইলের সাথে কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। ইসরাইলের অভ্যন্তরে মাহমুদ আব্বাসের সরকার রামাল্লা কিছুটা হলেও ন্যূনতম স্বায়ত্তশাসিত সরকার বলা যাবে। কিন্তু গাজা থেকে হামাস ইসরাইলকে শান্তিতে থাকতে দিত না অনেকটা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালু রাখত। প্রায় ১৫ মাসের এই যুদ্ধকালীন সময়ে হামাসের নেতা ইসমাইল হানিয়া, লেবাননের হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে গুপ্ত ঘাতকের হাতে প্রাণ দিতে হয়।
এক পরিসংখ্যানে ১৫ মাসের এই যুদ্ধে ৪৬ হাজার ৯ শত ১৩ জন ফিলিস্তিনী নর–নারী–শিশু নিহত হয়। আহত প্রায় ১ লাখ ১০ হাজারের উপরে। গাজার ৬০–৭০% অবকাঠামো ধ্বংস করা হয়। এতে গাজাবাসীর ঘরবাড়ি ছাড়তে হল। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মসজিদ, হাসপাতালের সংখ্যাও কম নয়। গাজাকে যুদ্ধবিধস্ত ধ্বংসস্তুপ বললে বাড়িয়ে বলা হবে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে গণতান্ত্রিক দেশ, মানবতাবাদী দেশ হিসেবে জাহির করতে থাকে। তারা ইচ্ছা করলে ফিলিস্তিন ইসরাইলকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে আনতে পারে। কিন্তু জবরদখলী ইসরাইল ফিলিস্তিনীদের পাখির মত মারা, মানুষের বাড়ি–ঘর, হাসপাতাল, মসজিদ ধ্বংস করতে বন্ধু ইসরাইলকে সমর্থন দেয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘৃণ্য পররাষ্ট্র নীতি নয় কি! হামাসই যখন ইসরাইলীদেরকে বন্দী করে নিয়ে এসেছে ইসরাইল হামাসকে মারুক, আমেরিকা সমর্থন দিক। কিন্তু ইসরাইল হামাসের সাথে এটে উঠতে না পেরে সাধারণ ফিলিস্তিনীকে হত্যা করতে থাকবে আমেরিকা সমর্থন দিয়ে যাবে তা হতে পারে না। সবচাইতে অবাক করা ব্যাপার ইরান, তুরস্ক, ইয়েমেন, লেবানন বাদে আর কোন মুসলিম রাষ্ট্র ১৫ মাসের ইসরাইলের এই বর্বর আগ্রাসনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেনি, ছিল নীরব দর্শকের ভূমিকায়। হয়ত আমেরিকার হুমকি গদি হারানোর ভয়ে।
জন্মভূমি, মাতৃভূমি ফিলিস্তিনের জন্য বর্বর ইসরাইলের জেলে বন্দী আছেন আবদুল্লাহ বারঘৌতি, মারওয়ান বারঘৌতি, হাসান সালামা, ইব্রাহীম হামেদ, জাকারিয়া জুবাইদি, হুসাইম আব্বাসী, মুহাম্মদ ওয়াদেহ, ওয়াইল কাশিমসহ অনেকে।
দীর্ঘ ১৫ মাসের মানবতা বিরোধী অপরাধ করে প্রায় ৪৭ হাজার হত্যা করার পর বন্দী বিনিময় চুক্তিতে ইসরাইল এ চুক্তির আওতায় রাখবে না উপরোক্ত মহান দেশ প্রেমিক মুজাহিদগণকে। অর্থাৎ ইসরাইলী কারাগারে নির্মম নির্যাতনের মধ্যেই হয়ত তাদের মৃত্যু অবধারিত আছে। ইসরাইলী কারাগারে বন্দী থাকা ফিলিস্তিনী তাদের স্ত্রী সন্তান–সন্ততি, স্বামী, পিতা ইসরাইলী কারাগারে নির্মম নির্যাতনের অনুভূতি দূর থেকে হৃদয়ে ধারণ করে জীবন অতিবাহিত করবে।
১৫ মাস পর যুদ্ধ বিরতিতে এসে হয়ত দু’য়েক হাজার ফিলিস্তিনী বন্দী মুক্তি পাচ্ছে, কিন্তু প্রায় ৪৭ হাজার নারী–পুরুষ–শিশু শহীদ হওয়া, প্রায় সোয়া লাখ আহত, গাজা অনেকটা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়াতে হামাসকে ভাবতে হবে, তাদের কৌশল ভুল প্রমাণিত হল কিনা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, গবেষক।