প্রবাহ

চট্টগ্রামের অপর নামগুলোর সাথে দুবাই সংযোজন করলে কেমন হয়!

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৩০ অক্টোবর, ২০২৪ at ৮:৪৫ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম আমাদের জেলার মূল নাম হলেও প্রাচীনকাল থেকে চট্টগ্রামের আরও অনেক নাম রয়েছে। রয়েছে উপ এবং শাখা নাম। সম্প্রতিককালে দেশের বিভিন্ন স্থানে সফর এবং হজ্ব ও ওমরাহ উপলক্ষে সৌদি আরবে গমন করলে দেশের অন্যান্য জেলার লোকজনকে দেখলে চট্টগ্রামের পরিচয় দেওয়ার আগে হালকা রসিকতায় দুবাই বলা হচ্ছে। অর্থাৎ বিশ্বের বুকে দুবাই দুটি। একটি আরব রাষ্ট্রসমূহের দুবাই, আরেকটি বাংলাদেশের দুবাই। দূরে কোথাও গেলে হালকা রসিকতা করা আমার অভ্যাস বলা যায়। ফলে আমার পরিচয় জানতে চাইলে রসিকতা করে দুবাই বলা হয়। এতে জানতে চাওয়া ব্যক্তি স্বভাবতই কৌতূহলী হয়। দুবাই বলতে আরবি কথা বলবে; তখন আমি সাথে সাথে পুনঃ বলে দিই আরবের দুবাই নয় বাংলাদেশের দুবাই। এতে ১০ জনের মধ্যে ৬৭ জন নিজ থেকে বলে পেলেন চট্টগ্রাম। ১০ জনের মধ্যে বাকী ৩৪ জন ইতস্ততায় থাকলেও আমি চট্টগ্রাম বললে এই ৩/৪ জনের মধ্যে চট্টগ্রাম যে দুবাই এর সাথে তুলনা চলে তা স্বীকার করে নেন ।

২০/২৫ বছর আগে রাজশাহী এক সিল্কের দোকানে যাওয়া হয়। কেনাকাটা করতে গিয়ে সহযাত্রীর সাথে চট্টগ্রামের ভাষায় আলাপ হচ্ছিল। এতে বিক্রেতাগণ কৌতূহলী হয়ে জানতে চায় আমরা কোথাকার লোক। আমি দুবাই বলায় সাথে সাথে তারা বলেই পেলেন চট্টগ্রাম। প্রতি বছর ১ লক্ষ ২৭ হাজার নরনারী হজ্ব করেন। ১০/১৫ বছরের ব্যবধানে ওমরাহ গমনকারীর সংখ্যাও ব্যাপক।

হজ্বের খরচ অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় গত হজ্বেও হজ্বযাত্রী কমে গিয়ে ৮৫ হাজার জনে দাঁড়ায়, তাও সংখ্যায় কম নয়। বর্তমানকালে যে কেউ হজ্ব ওমরাহ করতে গেলে পবিত্র দুই নগরীতে অবস্থানকালে চতুর্দিকে বাংলাদেশীদের দেখা আনাগোনা ব্যাপকতা অনুভব হবে। হোটেল রেস্টুরেন্টে রাস্তায় দুই হারমে নামাজ পড়তে গেলে। সালাম বিনিময়ের পর প্রথম প্রশ্ন থাকে আপনি কোন জেলার? প্রশ্নকারী সচেতন হলে আমার হালকা রসিকতায় দুবাই বলা হয়। এতে অনেকে মুহূর্তে চট্টগ্রাম বলে দেয়। ২৩ সেকেন্ড ইতস্ততা করলে আরবের দুবাই নয়, বাংলাদেশের দুবাই বললে তখন ১০ জনের মধ্যে ৬/৭ জন নিজ থেকেই চট্টগ্রাম বলে থাকে। বাকী ৩/৪ জনকে ব্যাখ্যা দিলে স্বীকার করে নেয়।

দীর্ঘ অভিজ্ঞতা অনুভূতি এসব কারণে চট্টগ্রামের নামের সাথে দুবাইটা সংযোজনও অনুভূতিতে কাজ করছে। বিগত ৩০/৪০ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের প্রায় সকল বৃহত্তর জেলায় সফর করা হয়। অনেক জেলায় রাত্রিযাপনও করা হয়। আমরা যেমন আরবসহ উন্নত বিশ্বের লোকজনকে সমীহ করি তেমনি ঢাকা বাদে বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার লোক চট্টগ্রামের লোককে সমীহ করে। তার মূলে অনেক কারণ রয়েছে। তৎমধ্যে উদার, ত্যাগ, মমত্ব, মহানুভবতা, আভিজাত্য এই সব অনেক কারণে সারা দেশের জনগণ চট্টগ্রামের লোকজনকে সম্মানের চোখে দেখে। অপরদিকে চট্টগ্রামের রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। যা উভয় বাংলার কারও আছে বলে মনে হয় না। ঢাকার ইতিহাস ৪ শত বছর, কলকাতার ইতিহাস সাড়ে ৩ শত বছর, চট্টগ্রামের ইতিহাস কত হাজার বছর তা গবেষণার বিষয়। প্রাচীনকাল থেকে চট্টগ্রামের গৌরবময় ইতিহাসের অন্যতম প্রধান কারণ মহান আল্লাহপাক প্রদত্ত ভৌগোলিক অবস্থান। সাগর, পাহাড়পর্বত, কর্ণফুলী নদী, সাথে শঙ্খ, মাতামুহুরী, হালদাসহ উর্বর ভূমি ইহা একটি প্রাকৃতিক গৌরবময় অবস্থান। হাজার হাজার বছর আগে থেকে দূরযাত্রার প্রধান মাধ্যম সাগরপথ। সাগরপথে পালতোলা নৌকার যাত্রাবিরতি অত্যাবশ্যক। যেহেতু মিঠা পানি রসদ সামগ্রী পালতোলা জাহাজে ছোটখাট মেরামত থাকে। সেই লক্ষে যাত্রাবিরতির নিরাপদ অবস্থান হল আঁকাবাঁকা কর্ণফুলী নদী। এতে মোহরা কালুরঘাট এলাকায় গড়ে উঠে শীপইয়ার্ড। এই শীপইয়ার্ডে নির্মিত জাহাজসমূহ মজবুত টেকসই সর্বোপরি সস্তা বিধায় বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানী হত। তুর্কি সুলতানগণ মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় তাদের নিজস্ব শীপইয়ার্ড থাকার পরও চট্টগ্রামের এই শীপইয়ার্ড থেকে জাহাজ কিনে নিতেন। ১৪৫৩ সালে সুলতান ২য় মুহাম্মদ ইস্তাম্বুল জয়কালে ২ শতের কম বেশি শীপ বসফরাস প্রণালী থেকে পাহাড়ের ভিতর দিয়ে গোল্ডেন হর্ণে নিয়েছিলেন। ঐ যুদ্ধে চট্টগ্রামে নির্মিত শীপ এবং চট্টগ্রামের লোকজন ছিল না তা বলা যাবে না। এটি গবেষণার বিষয়। এই শীপইয়ার্ড চট্টগ্রামকে বিশ্বব্যাপী জানান দিয়েছে। যেহেতু এখানে রয়েছে কর্ণফুলী নদীর প্রশস্ততা। পূর্ব দিকে ৩০/৪০ কি.মি দূরত্বে পাহাড়পর্বতে রয়েছে অসংখ্য বিশাল বিশাল গাছ। সাগর থেকে কর্ণফুলী নদী আঁকাবাঁকা হয়ে এসেছে বিধায় উত্তাল সাগরের প্রতিকূল প্রভাব এখানে নেই। আজও ঐ এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণে ৭০/৮০ ফুট নিচে গেলেও শক্ত মাটি পাওয়া যায় না। এখনও ঐদিকে পুকুর বা অন্য কোন প্রয়োজনে মাটি খনন করলে বড় বড় গাছের শিকড় পাওয়া যাচ্ছে। পাথরঘাটা ষোলকবহর এসব নামের উৎপত্তিও গবেষণার বিষয়।

১৪ শত বছর আগে আল্লাহর রাসূল (.)’র মহান সাহাবাগণ চীনসহ পূর্ব এশিয়ার দিকে হিযরত করেন। স্থায়ী বসবাস না হলেও চট্টগ্রামে যে যাত্রাবিরতি হয়েছে তা ইতিহাস জানান দিচ্ছে। এই যাত্রাবিরতি স্থলে ভারতবর্ষের মধ্যে চেন্নাই, কলম্বো, মালদ্বীপের কথা আসছে। চট্টগ্রাম বাদে বাংলার আর কোন নাম আসছে না। তিন কারণে আরবকে সম্মান করতে হবে। ১. আল্লাহর রাসূল (.)’র ভাষা আরবি ২. কোরআনের ভাষা আরবি ৩. বেহেশতের ভাষা আরবি আরবীয়গণের গুণাগণের মধ্যে একটি হল আতিথেয়তা। হয়ত তাদের রুহানিয়তের প্রভাবে চট্টগ্রামবাসীর আতিথেয়তার সুনামকে অস্বীকার করা যাবে না।

ব্রিটিশ পাকিস্তান পেরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৩ বছর চলমান। রাজধানী ঢাকা অতি দ্রুততার সাথে ব্যাপকতা লাভ করে। যেমনি বিশালত্ব তেমনি অতি জনবসতি। ফলে ঢাকার পরিবেশ আজ কলুষিত। চট্টগ্রামের মানুষ রাজধানী ঢাকা বাদে দেশের অন্য কোথাও বিশেষ কারণ ছাড়া বসতি স্থাপন করেছে বলে মনে হয় না। চট্টগ্রামের সাথে সারা দেশের জেলা পেরিয়ে উপজেলাগুলোর সাথেও সড়ক যোগাযোগ রয়েছে। রয়েছে বাস সার্ভিস। এই সব বাস সাথে সাথে ট্রেনে চাকুরীসহ বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া চট্টগ্রামের লোক ঐসব অঞ্চলে যাওয়াআসা করছে বলে মনে হয় না। বরঞ্চ সারা দেশের লোক চট্টগ্রামে আসতেছে টাকা রোজগারের জন্য। এতে আমরাও খুশি আর্থিক সহায়তায় হাত বাড়াতে পারতেছি বলে।

সাথে সাথে প্লট কিনে দালান করে, ফ্ল্যাট কিনে স্থায়ী বসবাস করছে চট্টগ্রাম ভাল স্থান বলে। চট্টগ্রামেই স্থায়ী বসবাসের জন্য যথোপযুক্ত বলে মনে করা হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে ঢাকায় যেহারে কলুষিত পরিবেশ হয়ে গেছে এতে পাহাড়পর্বত কেন্দ্রীক চট্টগ্রামের গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে। যদিওবা পাহাড়খেকো সন্ত্রাসীদের কারণে চট্টগ্রামের পরিবেশ রক্ষা কঠিন হয়ে পড়েছে। সারা বিশ্বের মানুষ দুবাই গমন করে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে। দুবাইতে ব্যবসা বাদে তেমন কোন দর্শনীয় স্থান আছে বলে মনে হয় না। অর্থাৎ বিশ্বের বুকে ব্যবসাবাণিজ্য, টাকার লেনদেনের কেন্দ্রস্থলের মধ্যে অন্যতম একটি হল আরবের দুবাই। তিলোত্তমা দুবাই। তিলোত্তমা মানে শ্রেষ্ঠত্বের ক্ষুদ্রতম কণা বা যার শ্রেষ্ঠত্ব সর্বোচ্চ গুণাবলী স্থিরীকৃত হতে পারে। তেমনিভাবে বাংলাদেশের মধ্যেও টাকা রোজগারের জন্য অন্যতম কেন্দ্রস্থল চট্টগ্রাম। এও শুনা যায়, যারা দুর্নীতিবাজ তারাও নাকি চট্টগ্রামে পোস্টিং চায়। যেহেতু এখানে অবৈধ ইনকামের সুযোগটা বেশি।

চট্টগ্রামের সন্তান হিসেবে নিজে নিজেকে উৎফুল্লবোধ করি। সাথে সাথে আমাদের চট্টগ্রামকে সারা দেশের মানুষ সম্মান করে মূল্যায়ন করে, টাকা রোজগারের জন্য আসাযাওয়া করে। সম্ভব হলে বসতি স্থাপন করে। সেই লক্ষে আরব আমিরাতকে আরবের দুবাই, চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের দুবাই বলে হালকা রসিকতা করা হয়। চট্টগ্রামবাসীও ভাববেন আমাদের জেলার বিভিন্ন উপ নামগুলোর সাথে দুবাই যোগ করলে কেমন হবে!

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভাষা বিজ্ঞানী অধ্যাপক মনিরুজ্জামান : কিছু স্মৃতি
পরবর্তী নিবন্ধহাতিয়ার ভাসানচরে পৌঁছল আরও ৫০৬ রোহিঙ্গা