আগামী হজ্ব ব্যবস্থাপনায় সুপারিশ
ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় আগামী ২০২৫ সালের জুনে অনুষ্ঠিতব্য হজ্বের টাকা জমা করে প্রাক–নিবন্ধন করতে ঘোষণা দিয়েছে। হজ্বের নিবন্ধন দুই প্রকার। ১. প্রাক–নিবন্ধন ২. চূড়ান্ত নিবন্ধন। প্রাক–নিবন্ধন ৩০ হাজার টাকা যা আগামী ২০২৫ সালের জুনের হজ্বে না গেলে পরবর্তী বছর প্রাক–নিবন্ধন কাজে আসবে। ৩ লাখ টাকা দিয়ে আগামী হজ্বের জন্য চূড়ান্ত নিবন্ধন করে রাখতে হবে। হজ্বের খরচ কত তা অস্পষ্ট। করোনা মহামারীতে ২০২০, ২০২১ সালে বিদেশ থেকে কোন হজ্বযাত্রী গমন করেননি। অতঃপর ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালের হজ্বের ব্যয় নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে বলে আলোচনা–সমালোচনা ছিল। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে হজ্ব নিয়ে দুর্নীতির ব্যাপক সমালোচনা চলমান। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কার তথা দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে হয়ত হজ্বের ক্ষেত্রে সুফল আসতে পারে।
সরকারী ব্যবস্থাপনায় হলে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে এক সিস্টেম; বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় হলে কাফেলা এজেন্সীর সহায়তায় ভিন্ন সিস্টেম। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে হজ্ব ব্যবস্থাপনার শুরু বলা যাবে। এতে ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টাকে হজ্ব ব্যবস্থাপনায় যাতে স্বচ্ছতা থাকে সে লক্ষে স্বজনপ্রীতি দুর্নীতিমুক্ত করতে শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কেন জানি আমাদের দেশে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ব্যাপকতা লাভ করেছে। হজ্ব ব্যবস্থাপনাও এর থেকে মুক্ত নয়। অতএব, দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে হজ্ব বিষয়ে আমার সুপারিশসমূহ নিম্নে উপস্থাপন করা হল–
১. সরকারী ব্যবস্থাপনার হাজীর ঘর ভাড়া করতে যাতে কমিশন বাণিজ্য না হয়।
২. সরকারী ব্যবস্থাপনায় হাজীদের দুই পবিত্র নগরীতে খাবারের ব্যবস্থাপনা নেই। দুই পবিত্র নগরীতে দেশের শত শত প্রবাসী খাবারের ক্যাটারিং সার্ভিস চালু করেছে। অতএব, তাদের সাথে সমন্বয় করে বেসরকারী ব্যবস্থাপনার মত খাবার সরবরাহ করা যায় কিনা।
৩. প্রবাসীগণের মধ্যথেকে হজ্ব সেবক এবং হজ্ব গাইড নিয়োগ দিতে যাতে স্বজনপ্রীতি না হয়।
৪. পবিত্র মক্কা হজ্ব মিশন যাতে সততা ও জবাব দিহিতায় চালিত হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা।
৫. হজ্ব কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা দেখিয়ে বিদেশ গমনাগমনের প্রবণতা অটুক না রাখা।
৬. হজ্বের সময় হজ্ব ডেলিকেটের নামে অসংখ্য লোক গমনাগমনের প্রবণতা রোধ করা। গরীব দেশের গরীবের কর এর টাকা হজ্বের নামে যেনতেন যাতে খরচ না হয়।
৭. সরকারী ব্যবস্থাপনায় হজ্বযাত্রীর আগ্রহ কম। বেসরকারী কাফেলা এজেন্সীর প্রতি আগ্রহ। যেহেতু তারা হাজীর অভিভাবক হিসেবে কাজ করে। এক্ষেত্রে সরকারী হাজীর সংখ্যা যাতে বাড়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া।
৮. কাফেলা এজেন্সীরা যাতে অনিয়ম করতে ভয় পায় সেই লক্ষে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে। যেহেতু:-
(ক.) কাফেলা এজেন্সীরা টাকা বুকিং নেওয়ার সময় যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়, দুই পবিত্র নগরীতে যাতে তার অন্যথা করতে সাহস না করে।
(খ.) কাফেলা এজেন্সীর মধ্যে অনেকের দুর্নাম রয়েছে যে, হজ্বযাত্রীর টাকা আত্মসাৎ করার কথা হজ্ব ফ্লাইটের শেষের দিকে এসে ব্যাপক প্রচার পায়। এই সব কাফেলার লাইসেন্স বাতিল করে আইনের আওতায় আনা।
(গ.) যেহেতু অধিকাংশ হাজী বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় হজ্ব করতেছে; অতএব, দুই পবিত্র নগরীতে হাজীগণ নিয়ে অনিয়ম না হয় মত ৩/৫ সদস্যের মনিটরিং সেল গঠন করা।
৯. প্রধান উপদেষ্টার সহযোগিতা নিয়ে বিমান ভাড়া যাতে সহনীয় পর্যায়ে আসে তার প্রচেষ্টা চালানো। নিয়মিত ফ্লাইটের চেয়ে হজ্ব ফ্লাইটের ভাড়া যে তারতম্য হবে তা গ্রহণযোগ্য। কিন্তু ১ লাখ ৯৪ হাজার টাকা কোন মতেই গ্রহণযোগ্য নয়। যা জনগণের মুখে মুখে এবং বিমানের প্রতি এও দুর্নাম রয়েছে যে, বিমান মানে সরকারের লোকসানের পরিবহন। লোকসান কমাতে হজ্বযাত্রীর উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে জনগণের মুখে মুখে। নভেম্বরের ৩০ তারিখ পর্যন্ত হজ্বযাত্রী নিবন্ধনের সময় দেয়া হয়েছে। কিন্তু চলতি সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরের মধ্যে হজ্বের খরচ এ ও বি দুই ক্যাটাগরী নির্ধারণ করে ব্যয় যে কমতেছে তা জানিয়ে দেয়া আবশ্যক। ২০২৩ সালের হজ্বে ৪ হাজার ৫ শত জন এবং ২০২৪ সালের হজ্বে তিন ভাগের এক ভাগ তথা প্রায় ৪৪ হাজার জনের কোটা খালি যায় বা অসম্পূর্ণ থাকে। ইহা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তির ক্ষতি হচ্ছে। যেহেতু পাকিস্তান আমলের ২৩ বছর এবং বাংলাদেশ আমলের ৫২ বছরের ইতিহাসে কোটা অনুপাতে হজ্বযাত্রীর সংখ্যা বেশি ছিল। ২০২৩ সাল থেকে উল্টো পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এই ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারকে গভীরভাবে ভাবতে হবে যাতে কোটা পূর্ণ হয়।
যথা–
(ক) করোনা মহামারীর পর থেকে সৌদি হজ্ব ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় হজ্ব ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজায়। বিগত প্রায় ১৪ শত বছরের মোয়াল্লেম প্রথাকে গৌণ করে নাম দেয়া হয় মোয়াল্লেম অফিসের স্থলে সার্ভিস সেন্টার। জেদ্দা, পবিত্র মদিনা হজ্ব টার্মিনাল, যাতায়াত বাস ব্যবস্থাপনা, মিনা–আরাফাতে তাঁবুর ব্যবস্থাপনা, খাবার সরবরাহ, এসব খাতে ঠিকাদারকে দিতে হজ্বযাত্রী অনুপাতে যেহারে টাকা নেয়া হচ্ছে তা অমানবিক। যা আমরা বাংলাদেশী হজ্বযাত্রীগণের ক্ষেত্রে আর্থিক চাপ। হজ্বযাত্রীর যাতায়াতে বাস ব্যবস্থাপনা উন্নত করা হয়েছে, বিদেশ থেকে ভাল বাস আমদানী করা হয়েছে। বাকী সর্বস্তরে আগের চেয়ে বর্তমান মান নিম্ন বলা চলে।
(খ) হজ্বের কোটায় বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। (১) ইন্দোনেশিয়া (২) ভারত (৩) পাকিস্তান। ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় অপর ৩ দেশের হজ্ব বিষয়ক মন্ত্রী বা সচিবকে নিয়ে সৌদি হজ্ব ও ওমরাহ মন্ত্রণালয়কে বুঝাতে হবে তাদের অগ্রহণযোগ্য ব্যয় কমাতে। না হয় বাংলাদেশের পক্ষে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিমান ভাড়া বাদে হজ্বের আনুষঙ্গিক খরচ কমানো কঠিন হবে।
১০. ভারতবর্ষে হজ্ব ব্যবস্থাপনার ইতিহাস বলতে পশ্চিমাঞ্চলে মুম্বাই, পূর্বাঞ্চলে চট্টগ্রাম। ভারতে হজ্বের সদর দপ্তর বন্দর নগরী মুম্বাই। পাকিস্তানের বন্দর নগরী করাচিতে। রাজধানী দিল্লি বা ইসলামাবাদে নিয়ে যাওয়া হয়নি। পূর্ব পাকিস্তান পেরিয়ে বাংলাদেশ তথা দেশের হজ্ব অফিস বন্দর নগরী চট্টগ্রামে। বন্দর নগরী চট্টগ্রামবাসীর দুর্ভাগ্য সবকিছু ঢাকা কেন্দ্রীক মানসিকতায় পাহাড়তলী চট্টগ্রাম হাজী ক্যাম্পকে পরিত্যক্ত করে হজ্ব অফিস ঢাকা নিয়ে যাওয়া হয়। যা অযৌক্তিক।
১১. শুধু রাজধানী ঢাকা কেন্দ্রিক বাদ দিয়ে খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, বরিশাল, সিলেট বড় বড় অঞ্চলগুলোর তুলনায় চট্টগ্রাম এরিয়ার হজ্বযাত্রীর সংখ্যা অনেক অনেক বেশি। রয়েছে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর।
অতএব চট্টগ্রাম বিভাগীয় হজ্ব অফিস হিসেবে পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্প পুনরায় চালু করা হোক।
১২. গত হজ্বে চট্টগ্রাম থেকে ২২ টি হজ্ব ফ্লাইট দেয়া হয়েছে। তৎমধ্যে মাত্র ২ টি ফ্লাইট দেয়া হয়েছিল চট্টগ্রাম থেকে পবিত্র মদিনা। এতে হজ্বযাত্রীদের নিয়ে বিপাকে পড়ে চট্টগ্রাম হজ্ব এজেন্সীরা। অতএব, ফ্লাইট নির্ধারণ করা নিয়েও বিমানের সাথে সমন্বয় করতে হবে।
১৩. বাংলাদেশী হজ্বযাত্রীগণের মানিসকতা হল পবিত্র মক্কায় মসজিদুল হারমের নিকটে অবস্থান করা যাতে ৫ ওয়াক্ত নামাজ তথায় পড়তে পারে। অবশ্য ঢাকাসহ উত্তরবঙ্গ–দক্ষিণবঙ্গের কিছু কিছু এজেন্সী হাজীদেরকে আজিজিয়া ও হারমের নিকটে এই দুই জায়গায় রাখেন টাকা বাঁচানোর জন্য। এই সব ক্ষেত্রে বেসরকারী হজ্ব এজেন্সীর উপর ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ না আসাই শ্রেয়।
বস্তুতঃ এখন থেকে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতে হবে আগামী বছর হজ্ব যাতে সুন্দর–সুষ্ঠুভাবে সমাধা হয়। একদিকে সৌদি আরবে দেন দরবার করতে হবে হজ্বের ব্যয় কমাতে, অপরদিকে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপে বাংলাদেশ বিমানকে চাপে রাখতে হবে হজ্ব ফ্লাইটের ভাড়া কমিয়ে আনতে।
সাথে সাথে স্বজনপ্রীতি দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থেকে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় যাতে হজ্ব ব্যবস্থাপনাকে সুন্দর সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।