প্রবাহ

হালিশহর শায়িত হযরত হাফেজ মুনির উদ্দিন (রহ.)

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ১০:৪৭ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম মহানগরীর হালিশহরে শায়িত রয়েছেন মহান অলি, সুফি, দরবেশ, সুলতানুল আউলিয়া হযরত আলহাজ্ব শাহ হাফেজ সৈয়দ মুনির উদ্দিন নুরুল্লাহ (রহ.)। হালিশহরের বাড়ী মাজার কেন্দ্রিক এলাকা তাঁরই নামকরণে ‘মনিরনগর’ হিসেবে পরিচিত। অপরদিকে তিনি হালিশহর হাফেজ ছাহেব হুজুর হিসেবে সর্বমহলে প্রসিদ্ধ। ৬ রবিউল আউয়াল তাঁর ৭০ তম ইন্তেকাল বার্ষিকী।

তিনি আজমগড়ী হযরতের খলিফাগণের মধ্যে অন্যতম। ১৮৮১ সালের দিকে হালিশহর জন্মগ্রহণ করেন বলে জানা যায়। শিশুকাল থেকে তিনি খুবই পরহেজগার ও মেধাবী ছিলেন। হালিশহর থেকে কদম মোবারক এসে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করতেন। আগেকার আমলে পায়ে হেঁটে দূরদূরান্তে যাওয়াআসা করা অনেকটা সাধারণ ব্যাপার ছিল।

হযরত হাফেজ ছাহেব হুজুরের মহান পীর বিশ্বখ্যাত সুফি দরবেশ তাসাউফ জগতের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব হযরত আলহাজ্ব শাহ মাওলানা হাফেজ হামেদ হাসান আলভী (রহ.) (আজমগড়ী হযরত)। ভারতের উত্তর প্রদেশের আজমগড় থেকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে তরিকতের সফর করতেন, তৎমধ্যে চট্টগ্রাম অন্যতম। হযরত হাফেজ ছাহেব হুজুরের মহান পীর আজমগড়ী হযরত ১৯০১১৯৩৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৮ বছর চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাৎসরিক ন্যূনতম একবার হলেও সফর করতেন অনেক কষ্ট স্বীকার করে। সেই সময় মানুষের বাড়ীতে কাছারী ঘর, বাড়ী সংলগ্ন টয়লেট এসব কিছুর ব্যবস্থা থাকত না। আরামের ব্যবস্থা ছিল না বলেই চলে। সেই সময়ও আজমগড়ী হযরত হালিশহর হযরত হাফেজ ছাহেব হুজুরের বাড়ীতে তাশরীফ রাখতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, চট্টগ্রাম অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ, ভারতবর্ষ ভাগ হওয়া ইত্যাদি কারণে আজমগড়ী হযরতের চট্টগ্রাম অঞ্চলে সফর হয়নি।

ছাত্র জীবনে ১৯৬০ এর দশকে গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলার নিকট মুরিদ হওয়ার সৌভাগ্য হয়। সেই হতে আজমগড়ী সিলসিলা গারাংগিয়ার পাশাপাশি চুনতী ও হালিশহর বিষয় জানতে যাতায়াত করতে আগ্রহ জাগে। বাঁশখালীতেও গারাংগিয়ার পাশাপাশি হালিশহর হাফেজ ছাহেব হুজুরের সিলাসিলাও বিকশিত।

হযরত হাফেজ হুজুরের এক মুরিদ আমাকে একাধিক বার বলেছিলেন, তাকে নাকি তার পীর ছাহেব কেবলা বলেছিলেন,‘ওয়া আঁর পীর ছাব কেবলা আইব বলে, ঝামেলা সইত পাইত্তাম নঅ, আই আন্দর বারিত যাইওমগই’। অর্থাৎ আমার হযরত পীর ছাহেব কেবলা হালিশহর আমার বাড়ীতে তাশরীফ আনবেন। ঝামেলা সহ্য করতে পারব না। আমি আন্দর বাড়ীতে চলে যাব। বস্তুতঃ আজমগড়ী হযরত আজকের বাংলাদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান আগমন করলে প্রথমে পাসপোর্ট করতে হবে অতঃপর ভিসার প্রয়োজন। আজমগড়ী হযরতের এই অঞ্চল পুনঃ সফরের পরিকল্পনায় হযরত হাফেজ ছাহেবের অবগত থাকবে স্বাভাবিক। আজমগড়ী হযরত আসতে আসতে হাফেজ ছাহেব হুজুর ইন্তেকাল হয়ে কবরের আন্দর বাড়ীতে চলে যান।

হাফেজ ছাহেব হুজুরের বুজুর্গ মহান পুত্র হযরত শাহ মাওলানা কাজী সিরাজুল মোস্তফা (রহ.)। তাঁর সাথে আমার ছাত্র জীবন থেকে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। অনেক বার মোলাকাত হয়। নানান বিষয়ে আলাপ করতেন। ইন্তেকাল পরবর্তী তাঁর জানাযা পড়ার সৌভাগ্য হয়। বাঁশখালীতে তাঁর একজন মুরিদ নিজের পীর ছাহেব তথা হযরত কাজী ছাহেব হুজুরের সাথে আলাপ করেন, তাঁর বাড়ীর নিকটে আজমগড়ী সিলসিলার একটি বড় মাদ্রাসা রয়েছে। তিনি কমিটির সদস্য। মাদ্রাসায় বার্ষিক মাহফিলে মাইক ব্যবহার হয়। মুরিদ কি করতে পারেন। উত্তরে কাজী ছাহেব হুজুর বলেন,‘তুমি দূরে দূরে থাকিও।’ যদিওবা আলাপগুলো চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ছিল।

কাগতিয়া হযরত মাওলানা তোফাজ্জল আহমদ (রহ.)’র মুরিদ ছিলেন রায়হান মিয়া। তিনি বলেন, ১৯৯৩ সালে যেয়ারতের উদ্দেশ্যে ভারতে সফরে যাচ্ছেন বিধায় মোলাকাত করেন। পীর ছাহেব বলেন যেয়ারতে যাওয়ার আগে পুনঃ মোলাকাত করতে। মোলাকাতে আসলে খরচের জন্য বেশি করে টাকা দেন এবং ভারতে যেয়ারতালে জায়গায় জায়গায় তাঁর সালাম পেশ করতে বলেন। রায়হান মিয়া প্রশ্ন করেন, সালাম কিভাবে বলল, উত্তরে বলেন,‘গোলামে শাহে মুনির মুহাম্মদ তোফাজ্জল আহমদ’ এর পক্ষ থেকে সালাম এভাবে বলতে।

হাফেজ ছাহেব হুজুর ইন্তেকালের পর ১৯৫৫ সালে আজমগড়ী হযরত ভারত থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছেন ট্রেন যোগে। ট্রেন স্টেশন লোকে লোকারণ্য আজমগড়ী হযরতকে স্বাগত জানাতে। যেমনি আজমগড়ী হযরতের খলিফাগণ তেমনি খলিফাগণের মুরিদগণ। ট্রেন স্টেশন থেকে কার যোগে আজমগড়ী হযরত হালিশহর হাফেজ ছাহেব হুজুরের বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দেন। আরেকটি কারে গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলা সামনে বসেন পেছনে তাঁর অন্যতম মুরিদ পরবর্তীতে খলিফা হযরত শাহ মাওলানা আবদুল কুদ্দুস আল কাদেরী ও মাওলানা ছাবের আহমদ চৌধুরী। পেছনে একটি সিট খালি থাকায় তখনকার চট্টগ্রাম শহরে কলেজের ছাত্র হযরত একিউএম মহিউদ্দিন মুজাদ্দেদী (রহ.) পেছনে হঠাৎ করে উঠে যান। তিনি অষ্টম শ্রেণীতে ছাত্র অবস্থায় গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলার নিকট মুরিদ হন। গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলার গাড়ি হাফেজ ছাহেব হুজুরের বাড়ীতে আগে পৌঁছে যায়। তিনি আজমগড়ী হযরতের অপেক্ষায় থাকতে না থাকতে কিছুক্ষণের মধ্যে আজমগড়ী হযরতের গাড়ী পৌঁছে যায়। বাহিরে উঠানে বৈঠকের ব্যবস্থা করা হয়। চেয়ার এবং নিচে চাটাই পাটি।

আজমগড়ী হযরত চেয়ারে বসেই গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুরকে প্রশ্ন করলেন,‘মজিদসালাম কা কেয়া খবর।’ অর্থাৎ মজিদ সালামের খবর কি? হুজুর ওনুনে খত ভেজা’ অর্থাৎ হুজুর তিনি চিঠি/পোস্ট কার্ড পাঠিয়েছেন। আজমগড়ী হযরত বললেন, পড়। তখন গারাংগিয়া বড় হুজুরের নিকট প্রেরিত চিঠি/পোস্ট কার্ডে লিখিত কথা পড়ে শুনান।

মূলতঃ চট্টগ্রামে সপ্তাহখানেক সফরের প্রোগ্রাম করতেছেন বিধায় সুদূর আজমগড় থেকে আরাকানে আরাকানী হযরতকে নির্দেশ দেন তিনি যাতে তাঁর চট্টগ্রাম সফরকালীন সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে যাওয়ায় পাসপোর্ট ভিসা জটিলতায় তিনি আসতে পারতেছেন না বিধায় গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলার নিকট চিঠি পাঠিয়ে জানিয়ে দেন। ব্রিটিশ পাকিস্তান পেরিয়ে বাংলাদেশ আমলের প্রথম দিকে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল পোস্ট অফিসের মাধ্যমে চিঠি প্রেরণ।

কিছুদিনের ব্যবধানে আরাকানী হযরত চট্টগ্রাম সফরে আসলে হযরত মুজাদ্দেদী (রহ.) ইন্টারের ছাত্র বয়স কম বিধায় কৌতূহলী হয়ে জানতে চান আজমগড়ী হযরত কেন তাকে এত গুরুত্ব দিয়ে তালাশ করছেন। এতে আরাকানী হযরত উত্তরে বলেন, হযরত হাফেজ ছাহেব হুজুর ইন্তেকাল করে যাওয়ায় খলিফাগণের কল্যাণে তাকে তালাশ করেছিলেন।

বস্তুতঃ আজমগড়ী হযরত তাঁর মহান খলিফাগণকে এক শব্দে সম্বোধন করতেন। যেমনগারাংগিয়া বড় হুজুর কেবলাকেমজিদ, হযরত ছোট হুজুর কেবলাকেরশিদ, হালিশহর হাফেজ ছাহেব হুজুরকেমুনির, আরাকানী হযরতকেসালাম, শাহ মাওলানা নজির আহমদকেনজির এভাবেই সম্বোধন করতেন।

আমার হালিশহর গমন করলেই প্রথমে হাফেজ ছাহেব হুজুরের যেয়ারতের উদ্দেশ্যে ঐদিকে যাওয়া হবে স্বাভাবিক। সেদিকে তাবলীগ মঞ্জিলে তাঁর ছোট ছাহেবজাদা ছাবের ছাহেবের সাথে সাক্ষাৎ হয়ে যায়। সালাম বিনিময় হতে না হতেই তিনি প্রশ্নের চলে বলে ফেলতে ভুল হত না, অনে এতিক্কিন হতা হডে ফন।’ অর্থাৎ আপনি এত তথ্য কোথায় পান। যেহেতু তিনি সংবাদপত্রে আমার নিয়মিত পাঠক। তাঁর সাথে মোলাকাতের পরপর হাফেজ ছাহেবের যেয়ারতের উদ্দেশ্যে মাজারে প্রবেশ করি। মাজার থেকে বের হতেই তিনি আমাকে সাথে নিয়ে তাঁর বাড়ীতে যান। দালানের উপরের তলায় এরই মধ্যে খবর দেয়ায় চানাস্তা রেডি। আমার সাথে দীর্ঘক্ষণ নানা বিষয়ে আলাপ করতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।

আজমগড়ী হযরত ১৯৫৫ সালে কয়েকদিন হালিশহরে অবস্থান করেছিলেন। তখন তথায় লোকে লোকারণ্য থাকত। যা আজমগড়ী হযরতের নিকট অপছন্দনীয় ছিল। তিনি বলতেন, তরিকতের কাজ চুপি চুপি।

ঐ সময় কুতুবদিয়ার মালেক ছাহেব কয়েকজন ভক্ত নিয়ে কিছুটা দূরত্বে অবস্থান নেন। হযরত ছাবের ছাহেব বলেন, গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলার মত ব্যক্তিত্ব আমাদের বাড়ীতে অবস্থান করতেছেন যেনতেনভাবে। আমরা তার যথোপযুক্ত মূল্যায়ন করতে পারি নাই। কুতুবদিয়া মালেক ছাহেবের নিকট নিয়মিত খাবার পাঠাতে সচেষ্ট থাকতেন। তিনি আরও বলেন, আমি আজমগড়ী হযরতের সাথে সাথে থাকতাম উঠাবসা, খাওয়া যাবতীয় কিছুতে। আমার বদ্দা (হযরত কাজী ছাহেব রহ) দূরে দূরে থাকতেন। ডাকলে আসতেন আবার চলে যেতেন।

আজমগড়ী হযরত এখান থেকে বিদায় নিয়ে লঞ্চ যোগে কাপ্তাই যান। পরদিন ফিরে এসে চন্দনপুরা জমিদার এয়ার আলী খানের বাসভবনে অবস্থানকালে গারাংগিয়া হযরত ছোট হুজুর কেবলাসহ আরও কয়েকজন বুজুর্গ মুরিদকে খেলাফত দানে ভূষিত করেন। চট্টগ্রাম থেকে বিমানে ঢাকা হয়ে ভারতে চলে যান।

হযরত হাফেজ ছাহেব হুজুর ৬ রবিউল আউয়াল তথা ৩ নভেম্বর ১৯৫৪ সালে ইন্তেকাল করেন। ৭০ তম ওফাত বার্ষিকীতে পরকালে এ মহান অলীর সুউচ্চ মকাম কামনা করছি। আমিন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআখেরী চাহার শোম্বাহ’র গুরুত্ব তাৎপর্য ও আমল
পরবর্তী নিবন্ধচাক্তাই ট্রাক মালিক সমিতির সভা