প্রবাহ

মরুভূমি কারবালা আজ প্রসিদ্ধ নগরী

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ২৪ জুলাই, ২০২৪ at ৩:৩০ অপরাহ্ণ

কারবালা মরুপ্রান্তর ফোরাতের শাখা নদীর তীরে। যার অবস্থান কুফা থেকে প্রায় ৩০ কি.মি দূরত্বে। বাগদাদ থেকে প্রায় শত কি.মি। কারবালার নাম শুনতেই উম্মতে মুহাম্মদীর শরীর মন শিহরিত হয়। এ কারবালা মরুভূমি মরুপ্রান্তর পর্যায়ক্রমে শহরে পরিণত হতে থাকে। তার মূলে যেয়ারতকারীগণের যাওয়াআসা অবস্থান বাড়তে থাকায় কারবালায় ইমাম হোসাইন (.)’র ও শহীদগণের মাজারকে কেন্দ্র করে কারবালা আজ শহরে পরিণত। এখানে গড়ে উঠে অসংখ্য হোটেল রেস্টুরেন্ট। আমরা সুন্নিরা যেয়ারতের উদ্দেশ্যে গমন করলেও নীরবে আবেগ প্রবণ হয়ে অশ্রু বির্সজন করে ফিরে আসবে স্বাভাবিক। কিন্তু শিয়ারা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তাদের কারবালা যেয়ারতের নানা পদ্ধতি রয়েছে। তৎমধ্যে একাধারে ৪০ দিন পায়ে হেঁটে কারবালা পৌঁছা অন্যতম একটি। তারা এখানে হোটেলে অবস্থান নিয়ে ন্যূনতম কয়েকদিন থাকবে। কারবালা পৌঁছে শিয়ারা নিজেকে নিজে স্থির রাখতে পারে না। শোকে মাতমে আত্মহারা হয়ে যায়।

১৯৯৭ সালে সপ্তাহখানেকের জন্য বাগদাদে অবস্থান করা হয়েছিল। তখন সমগ্র ইরাক অবরোধের করাল গ্রাসে। ইরাকের সাথে বিশ্বের আকাশপথ বন্ধ। এমনি প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কারবালায় যেয়ারতে গিয়ে যেহারে সমাগম প্রত্যক্ষ করেছি তা অবাক কান্ড। এখানে সব সময় যেয়ারতের পাশাপাশি কান্নার রোল মাতমের শব্দ অনেক দূর পর্যন্ত শোনা যায়।

বস্তুতঃ প্রাচীন ইতিহাসে কারবালাকে বিভিন্ন নামে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমনগাদি রিয়্যা, নীনাওয়া ইত্যাদি। কারবালা শব্দের অর্থ নম্র পদচারণা। এ বালুকাময় মাটি যেহেতু নরম এবং প্রশস্ত সেজন্য এটা কারবালা নামেই পরিচিত। অপরদিকে, কারবালা একটি জঙ্গলের ঘাসের নাম। যা এ অঞ্চলে জন্মাত। কেউ কেউ ধারণা করেন কারবালা শব্দটি আব্বাসী কারবালা আর কারও মতে আসিরীয় কারবাল্লাতুন এক প্রকার শিরস্ত্রাণ হতে উদ্ভূত।

প্রাচীনকাল থেকে ফোরাত নদীর তীরবর্তী এলাকার উর্বরতার দরুন এ অঞ্চল জনবসতি হিসেবে চলে আসছিল। ফোরাত নদীর তীরবর্তী হওয়া সত্ত্বেও কারবালার ময়দান ফোরাত নদীর পানির দুষ্প্রাপ্যতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। বাগদাদের এক টুরিস্ট গাইড বলেন, যে স্থানে কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল তা ফোরাত নদী থেকে আগত উপনদী। যা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় রেতা বলে।

গভীরতা কম থাকায় ফোরাত নদীতে পানি সহজলভ্য ছিল না। ফলে প্রাচীন রাজা বাদশাহগণ খনন কাজ চালিয়ে গভীরতা বাড়াতে সচেষ্ট থাকতেন। এখানকার মাটি নরম বিধায় নদী পুনঃরায় ভরাট হয়ে যেত। ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে ৭০৩ হিজরিতে রাজা ঈলহানি ফোরাত হতে হিল্লা পর্যন্ত এ অঞ্চলে নদী খনন করতে গিয়ে যখন তিনি ইমাম হোসাইন (.)’র শাহাদাতের স্থান পরিদর্শন করতে আসেন তখন কারবালাবাসীগণকে প্রচুর খাদ্য শস্য দান করেছেন।

৩৯ হিজরিতে আমিরুল মোমেনীন হযরত আলী (.) সিফ্‌ফীন যুদ্ধকালে এদিকে আগমন করলে কারবালার নাম জানতে পেরে কাঁদতে থাকেন। সহযাত্রীরা কাঁদার কারণ জানতে চাইলে বলেন, “একদিন আমি নবী পাক (.)’র কাছে বসা ছিলাম। তিনি বললেন: জিবরাইল (.) আমাকে জানিয়েছেন যে , হোসাইন ফোরাত নদীর তীরে কারবালা নামক স্থানে শহীদ হবেন”। তিনি কারবালার এক মুষ্ঠি মাটি নিয়ে আমাকে ঘ্রাণ নিতে দিয়েছিলেন। এ কারণে আমার কান্না আসছে। এক বর্ণনা অনুযায়ী আমিরুল মোমেনীন হযরত আলী (.) কারবালার ময়দান অতিক্রমকালে এক স্থানে থামেন, নামাজ পড়েন এবং বলেন,“এখানে তাদের উটগুলো বসে পড়বে, এখানে হাওদাসমূহ (আসবাবপত্র) রাখা হবে, এখানেই তাদের রক্তপাত ঘটানো হবে, হযরত মুহাম্মদ (.)’র কিছু বীর পুরুষ এখানে শহীদ হবে এবং আকাশবাতাস কাঁদবে।”

বস্তুতঃ ৬১ হিজরির ২ মহররম হযরত ইমাম হোসাইন কারবালাতে তাঁবু স্থাপন করেন। ১০ মহররম তিনি শহীদ হন। তাঁর কবর এক নিচু ভূমিতে ছিল যার চারপাশে উঁচু টিলা ছিল। হযরত ইমাম হোসাইন (.)’র কবরের উপর আবু ইসহাক মুক্তার ইবনে আবু ওবাইদ ইমারত নির্মাণ করেন এবং একটি মসজিদও নির্মাণ করা হয়। খলিফা হারুনুর রশিদ তা ভেঙ্গে দেন, কিন্তু খলিফা আল মুনতাসির বিল্লা ২৪৭ হিজরিতে পুনরায় মাজার নির্মাণ করেন এবং এলাকাসমূহ সংস্কার করেন। ২৭৩ হিজরিতে আরাফার দিন তা পুনরায় ভেঙে ফেলা হয়। ২৮৩ হিজরিতে তাবারিস্তিনারের শাসক মুহাম্মদ ইবনে জায়েদ ইরান থেকে পাথর পাঠিয়ে সুরম্য সৌধ তথা মাজার নির্মাণ করেন। ইবনে হাওকালের বর্ণনামতে ৩৬১ হিজরিতে সেখানে একটি প্রকান্ড গম্বুজ বিশিষ্ট মাজার বিদ্যমান ছিল। বিপুল সংখ্যায় যেয়ারতকারী আসতেন। কিছুকাল পর ইবনে মুহাম্মদ আল আসাদী যিনি কয়েকটি গোত্রের সর্দার ছিলেন, তিনি এখানে এ মাজার ধ্বংস করেন। সে জন্য ৩৬৯ হিজরিতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযান করা হয় এবং তিনি শাহারাস্থ অভিমুখে পালিয়ে যান।

৩৭০ হিজরিতে আবদুদ দাগুয়া (বুওয়ায়হী) যেয়ারতের উদ্দেশ্যে এখানে আসেন এবং মাজারের উপর গম্বুজ নির্মাণ ছাড়াও সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে কারু কাজ, আলোকসজ্জা ও যেয়ারতকারীর অবস্থানের ব্যবস্থা করেন। ৪০৭ হিজরিতে মাজারের সৌন্দর্য আরও পরিবর্ধন করা হয়।

৪৭৯ হিজরিতে সুলতান মালিক শাহ এখানে যেয়ারতে আসেন। তিনিই নগর প্রাচীর নির্মাণ এবং মাজার সংস্কারের দায়িত্ব পালন করেন। ৬২০ হিজরিতে এ মাজারের সৌন্দর্য আরও বাড়ানো হয়। ৭২৬ হিজরিতে তখনকার বাদশাহ এ ছোট শহরকে আরও উন্নয়ন করেন তখন এ ছোট শহরটিকে খেজুরের বাগান দ্বারা সাজানো হয়। সংস্কার করা হয় ফোরাত নদী। নির্মাণ করা হয় একটি মাদ্‌রাসা ও মেহমানখানা। মাজারের দরজায় রক্ষী বা দারোয়ান মোতায়েন করা হয়। মাজারকে স্বর্ণ ও রৌপ্য দ্বারা আরও সৌন্দর্যমন্ডিত করা হয় এবং ঝাড় বাতি ঝুলানো হয়।

৭৪০৮২৭ হিজরি পর্যন্ত ঈলখানী শাসকরা এ মাজারের রক্ষণাবেক্ষণ করেন। এখানে মাজারে আরও সংস্কার এবং মিনার নির্মাণ করেন। পরবর্তী ২/৩ শত বছরের ব্যবধানে কারবালা একটি বিখ্যাত যেয়ারত কেন্দ্র এবং বসবাসের সুন্দর শহরে পরিণত হয়। নামকরণ করা হয় মদিনাতুল হোসাইন। পরবর্তীতে শাহ ইসমাইল হযরত ইমাম হোসাইন (.)’র মাজার যেয়ারত করেন এবং ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন।

উসমানী সুলতান সুলায়মান পুনঃরায় ইরাককে উসমানী সাম্রাজ্যভুক্ত করার পর ৯৪২ হিজরিতে এখানে আগমন করেন। যেয়ারতের পাশাপাশি নানা সংস্কারে অবদান রাখেন।

৯৯১ হিজরিতে উসমানী সুলতান তৃতীয় মুরাদের নির্দেশে বাগদাদের গভর্নর আলী পাশা এখানকার মাজার ও গম্বুজ পুনঃনির্মাণ করেন।পরবর্তীতে পারস্যের প্রথম শাহ আব্বাস এখানে নানান সংস্কার করেন। ১০৪৭ হিজরিতে উসমানী সুলতান ৪র্থ মুরাদও নানান অবদান রাখেন। ১১৩৫ হিজরিতে নাদির শাহের স্ত্রী মাজার পুনঃনির্মাণ করান। এখানকার তহবিলের জন্য সম্পদ দান করেন। ১১৫৫ হিজরিতে নাদির শাহ স্বয়ং এখানে আসেন এবং স্বর্ণ ও রৌপ্যের কারু কাজ করেন। ১৮ জিলহজ্ব ১২১৬ হিজরিতে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাব নজদীর অনুসারীরা কারবালার ওপর আক্রমণ চালায়। হত্যাযজ্ঞ ছাড়াও তারা কারবালা থেকে সব কিছু নিয়ে যায়। কিন্তু শাহ ফতেহ আলী কাজার এ বিরাট ক্ষতি উত্তমভাবে পুষিয়ে দেন। অর্থাৎ কারবালায় ঐতিহাসিকভাবে পুনঃনির্মাণ সাধিত হয় আরও সৌন্দর্যমন্ডিত করে। শুধু তাই নয় ১২৫০ হিজরিতে এ বাদশাহ হযরত ইমাম হোসাইন (.) ও হযরত আব্বাস (.) মাজারদ্বয়ের গম্বুজকে স্বর্ণমন্ডিত করেন।

১২৭৬ হিজরিতে শাহ নাসির উদ্দিন পুনঃ বিপুল অর্থ ব্যয়ে মাজারের সৌন্দর্য আরও বাড়ান। পরবর্তীতে যেয়ারতের উদ্দেশ্যে নিজে উপস্থিত হন এবং মাজারের কল্যাণে ব্যাপক সম্পদ দান করেন।

১৩৫৮ হিজরিতে বুহরা সম্প্রদায়ের প্রধান মোল্লা তাহির ঐ সময় কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে কবরের উপর অতি দামি গিলাফ দেন। ১৩৮৬ হিজরিতে এক ইরানী ব্যবসায়ী এখানে মাজার কমপ্লেক্সকে সাজাতে ব্যাপক অবদান রাখেন।

বস্তুতঃ হযরত ইমাম হোসাইন (.)’র মাজারকে কেন্দ্র করে বর্তমান কারবালা শহর। ইসলামের প্রাথমিক যুগে তথা উমাইয়া ও আব্বাসীয় আমলে আকিদা বিশ্বাস নিয়ে মাজার নির্মাণ সংস্কার এবং ধ্বংস করার ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু পরবর্তী তুর্কি সুলতান আমল এবং ইরানের রাজা বাদশাহ ব্যবসায়ীগণ এখানে নানাভাবে অবদান রাখেন।

আমাদের ভারতবর্ষের রাজা বাদশাহ ব্যবসায়ীরাও এখানে অবদান রেখেছেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। বিশেষ করে মুহাম্মদ বিন তুঘলক ঐ সময়কার প্রায় আড়াই লাখ টাকা ইরাকের পবিত্র স্থানের জন্য প্রেরণ করেন।

দক্ষিণাত্যের সুলতানগণ নানান উপহার সামগ্রী পাঠান। মুঘল আমলেও ইরান তথা পারস্যের সাথে ভারতবর্ষের নিবিড় সম্পর্ক ছিল। টিপু সুলতানও তাঁর তুর্কি প্রতিনিধির মাধ্যমে এখানে অবদান রাখেন।

অযোধ্যার নবাব কারবালা ও নজফে কিছু অবকাঠামো নির্মাণ করে যান। অযোধ্যার নবাব কারবালা ও নজফের জন্য তখনকার বাৎসরিক ১ লক্ষ টাকা অনুদান মঞ্জুর করেন।

মুহাম্মদ আলী শাহের নবাব মালিকা জাহান যেয়ারতের উদ্দেশ্যে তথায় গমন করেন এবং মরহুম স্বামীর মুকুট ও স্বর্ণমন্ডিত তরবারি হযরত আলী (.)’র মাজারের জন্য প্রেরণ করেন এবং কারবালা ও নজফবাসীর জন্য লক্ষ টাকা খরচ করেন। শুধু তাই নয়, তিনি রাজকীয় সম্পদের অংশ তথাকার জন্য ওয়াকফ করে দেন। ভারতবর্ষের একাধিক শাসক এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশের ছোট বড় শাসকগণ এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিরা কারবালা ও নজফে দান করতে থাকেন।

হযরত ইমাম হোসাইন (.) ও আহলে বায়েত এর মর্মান্তিক লোমহর্ষক ঘটনার পর শহীদ হয়ে সেখানে শায়িত আছেন। ফলে উম্মতে মুহাম্মদীর কারবালা নাম শুনলেই মন ব্যথিত হওয়া স্বাভাবিক।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধজাহাজের ইউনিক আইটেম পাওয়া যায় যেখানে