বাংলাদেশ কঠিন করোনাকালেও অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে। প্রবৃদ্ধির গতি ধরে রেখে মাথাপিছু গড় আয়ে ভারতকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে। বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ নোবেলজয়ী ভারতীয় নাগরিক অমর্ত্য সেন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার সূচককে স্বাগত জানিয়েছেন। বিশ্বব্যাংকসহ সব আন্তর্জাতিক আর্থিক ও মনিটরিং সংস্থা বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রার গতিকে প্রশংসা করেছে তাদের পর্যবেক্ষণ রিপোর্টে। যেখানে করোনার ভয়াল থাবায় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ পৃথিবীর সব বড় অর্থনীতির দেশ মন্দা কবলিত। সেখানে বাংলাদেশের এই অর্জন অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখে। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্ব, প্রবাসী রেমিট্যান্সের ধারা এবং দুর্যোগ মোকাবেলার সময়োচিত মানবিক উদ্যোগের ফসল এটা। এদিকে কম বেতনের কারণে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের চাকরি ছাড়ার খবর ছড়িয়ে পড়েছে বৃটেন ও ইউরোপের নানা মিডিয়ায়। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে একটি পত্রিকায় কলাম লিখে ২ লাখ ৭৫ হাজার এবং বক্তৃতা করে বছরে আরো দেড়লাখ ইউরো আয় করতেন বরিস। প্রধানমন্ত্রী পদে তিনি বছরে আয় করেন মাত্র দেড় লাখ ইউরোর কিছু বেশি। এই অর্থে তাঁর দুই সংসার ও অন্যান্য খরচ নির্বাহ সম্ভব হচ্ছেনা। তাই অসন্তুষ্ট বরিস কথায় কথায় নিজের পদছাড়ার বিষয়টি কাছের বন্ধুদের জানিয়ে দেন। ডিসেম্বরের পর তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবেন বলেও কিছু মিডিয়া খবর প্রকাশ করেছে।
খবরটা সত্য মিথ্যা যাই হোক, এটা আমাদের দেশের রাজনীতিকদের জন্য একটা বার্তা অবশ্যই। রাজনীতি যে সুবচনবিলাস আর যথেচ্ছ ঘি, মাখন খাওয়ার শ্রেষ্ঠ পথ নয়। মূল কাজ ও দায়, জনসেবার মাধ্যমে কৃচ্ছ্রতা পালনের ব্রত, তা বরিস পরিষ্কার করে দিয়েছেন। বরিস প্রসঙ্গ আপাতত শেষ। বরং নিজের দেশকে পাখির চোখে দেখি। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও সর্বকালের রেকর্ড ৪০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। প্রবাসী রেমিট্যান্স প্রবাহেরও এতে প্রচুর অবদান আছে। আবার বাজারে আলু, পিঁয়াজ, সব্জিসহ কিছু নিত্য পণ্যের দাম হঠাৎ করে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। অসময়ের বৃষ্টি ও বন্যা যেমন এর জন্য দায়ী তেমনি দফায় দফায় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজিও মূল্যবৃদ্ধি রোগটাকে জটিল করে তুলেছে। এদের অন্যায় লোভের লাগাম টেনে ধরার দায় বিভিন্ন বণিক সমিতি, ভোক্তা সুরক্ষা সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট সব সরকারি বিভাগকে দ্রুত নিতে হবে। না হলে জন অসন্তোষের পাশাপাশি উন্নয়নের মসৃণ সড়কে বড় ব্যারিকেড তৈরি হবে। ড. অমর্ত্য সেনসহ অর্থনীতির বড় পন্ডিতরা আরো একটি বার্তা দিয়েছেন, দুর্নীতিকে সহনীয় পর্যায়ে রাখা গেলে বাংলাদেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধি আরো ৩ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব। সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, দফতর, পরিদফতর এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় কেনাকাটা ও বড় বড় টেন্ডার বাণিজ্যে মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক অর্থনৈতিক লুটপাটের ঘটনা মিডিয়ায় উঠে আসে। কিছু কিছু অবিশ্বাস্য ঘটনা দেশব্যাপী চাঞ্চল্যও সৃষ্টি করে। যেমন অতি সমপ্রতি শিকলবাহা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাম্প মেসিন ক্রয় স্ক্যাম। স্বাস্থ্য দফতরেও এমন কেলেংকারি প্রচুর। কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেয়া হলেও সংশ্লিষ্ট এজেন্সি ও দুদকের শ্লথ গতি শাস্তির বিষয়টি সবসময় দৃশ্যমান নয়। এর বাইরে আর্থিক সেক্টরের সুস্থতা ও শেয়ার মার্কেটে এখনো সুশাসন কায়েম হয়নি। লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের সাথে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসসহ নানা ছিদ্রপথে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এর কিছুটাও সামাল দেয়া গেলে দেশ দক্ষিণ এশিয়ার সেরা অর্থনীতি হিসাবে নিশ্চিত উঠে দাঁড়াবেই।
নানা প্রতিকূলতার মাঝেও দেশের অগ্রযাত্রার পথে সমপ্রতি অনাহুত নতুন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে আরেকটি বড় উপসর্গ। এটা হচ্ছে, ধর্মীয় জজবা তথা ধর্মান্ধতার সংক্রমণ। আমরা জানি, নবী করিম (সাঃ) এর কোন ছবি বা প্রতিকৃতি নেই। থাকতেই পারে না, কারণ ইসলাম ধর্মে ছবি বা প্রতিকৃতির অনুমোদন নেই। কিন্তু ইউরোপসহ পাশ্চাত্যের কিছু দেশের এক শ্রেণির অতি প্রগতিবাদী মিডিয়া ও কার্টুনশিল্পী খামাকা ধর্মীয় উস্কানি তৈরি করতে নবী করিম (সাঃ)এর নামে কার্টুন বা ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করে মুসলিমদের ধর্মানুভূতিতে প্রচণ্ড ক্ষত তৈরি করে। ডেনমার্ক করেছে, ফ্রান্সও করে।
অতি সমপ্রতি প্যারিসের একটি ভবনের এমন একটি কার্টুন চিত্র মহানবীর (সাঃ) নামে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। যাঁর কোন ছবি নেই, তাঁর নামে কাল্পনিক কার্টুন বা ব্যঙ্গচিত্র কীভাবে সম্ভব! গোঁড়া মুসলিমদের খেপানোর জন্যই এই আয়োজন। এবং তা শতভাগ সফল। ক’বছর আগেএকটি বিখ্যাত ফরাসী কার্টুন সাপ্তাহিক এমন কার্টুন চিত্র প্রকাশ করে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়। নিহত হন সম্পাদকসহ কয়েকজন নামী শিল্পী ও কার্টুনিস্ট। তবুও কেন আবারও এমন নিরীক্ষা! এর প্রভাব পড়েছে পুরো মুসলিম বিশ্বে। দুঃখজনক হলেও সত্য, সবচে’ বড় অভিঘাতটি আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশে। তুরস্কের এরদোগান কড়া প্রতিবাদ জানালেও সৌদি আরবসহ আরব বিশ্ব বড় অঙ্কের ফরাসি অস্ত্র কেনা ও ব্যবসা নিয়ে বেশি ব্যস্ত। কিন্তু বাংলাদেশে ফ্রান্স বিরোধী বিশাল বিশাল বিক্ষোভ মিছিল শুধু নয় সহিংসতার ঘটনাও ঘটছে। ফ্রান্সকে সমর্থন করে স্ট্যাটাস দেয়ার অভিযোগে একজন হিন্দু চেয়ারম্যানের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়াসহ গ্রেপ্তার হয়েছে কয়েকজন। ফরাসি দূতাবাস বন্ধ করে দেয়াসহ ফ্রান্সের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাপ দেয়া হচ্ছে। ধর্মীয় জজবার আগুনে আবার ঘি ঢালছে, বিদেশে আশ্রিত ক’জন কট্টর সরকার বিরোধী। এরা ঘরপোড়া আগুনে আলুসিদ্ধ খেতে মরিয়া! নিজেরা ধর্মের ধারে কাছে নেই, কিন্তু হঠাৎ ধার্মিকের ছাল পরে ধর্মীয় জজবার ঘাড়ে চেপে দেশে যে কোন অঘটন ঘটাতে টানা সাইবার উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে। জঘন্য মিথ্যাকে সত্যের কড়াইতে ফুটিয়ে তারা উত্তপ্ত করতে চায় দেশের রাজনীতি। ধর্মীয় আবেগের ফেনা আচ্ছন্নদের মতলববাজদের ফাঁদ থেকে হাজার কিলো দূরে থাকতে হবে। কারণ, তাদের বোঝা উচিত, পৃথিবীর কোন দেশ বিচ্ছিন্ন কোন দ্বীপ নয়। পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া কারো এককভাবে চলা সম্ভব না। তা’ছাড়া পশ্চিমা মুল্লুকে লাখ লাখ বাংলাদেশী প্রবাসী আছেন। দেশের সহিংসতা আন্দোলন ফ্রান্সসহ পশ্চিমা মিডিয়ায় ক’দিন ধরে ব্যাপকভাবে প্রচার হচ্ছে। আগুনে হিন্দু চেয়ারম্যানের বাড়ি পোড়ানো ও আরো সহিংস ঘটনার ভিডিওক্লিপসহ। এতে পুরো পশ্চিমা বিশ্ব ও অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানরত বাঙালিরা প্রচণ্ড আতঙ্কে আছেন। যারা আন্দোলন, বিক্ষোভ করছেন তাদের অনেক আত্মীয়ও ইউরোপ আমেরিকায় আছেন। বিষয়টা ধর্মবেত্তা আলেম সমাজকে গভীরভাবে বিবেচনায় নিতে হবে। নিজেদের পরিজনদের ভয়ঙ্কর বিপদে ঠেলে দিয়ে বাংলাদেশের একক আন্দোলনে কী ফল আসবে? ধর্মপ্রাণ প্রবাসী ভাইবেরাদরের ক্ষতির দায়ইবা নেবে কে? আমাদের বহু পরিবার বিদেশ থেকে পাঠানো টাকায় সংসার চালায়। তাদের রিজিক মারা কী পবিত্র ইসলাম সমর্থন করে? দেশের ক্ষতি না হয় বাদই থাক। আশা করি, যারা আন্দোলন নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা শান্তি ও প্রবাসী ভাইদের স্বার্থে দ্রুত ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবেন। না হলে সবার বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।
লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট