কালের প্রবাহে দ্রুত এক বছর অতিক্রান্ত হোল আমাদের প্রেরণার উৎস, প্রবর্তক শিশুসদনের নিবেদিত প্রাণ, আধ্যাত্মিক চেতনায় ঋদ্ধ, শিক্ষাব্রতী মীরা সিংহ (মীরাদি) গত বছর ২০২০ এ ৩রা ফেব্রুয়ারি ৮৩ বছর বয়সে অমৃতলোকবাসী হয়েছেন ‘নয়ন সম্মুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই’। কিছুতেই ভোলা যায় না মীরাদির শৃঙ্খলাবোধ, অগাধ পান্ডিত্য, বেদ-উপনিষদ পাঠ সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথে মগ্নতা।
১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ও দূর্ভিক্ষের কবলে চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চলে যখন হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করছে তখন প্রবর্তক সংঘ (১৯২১ প্রতিষ্ঠিত) জাতি ধর্ম নির্বিশেষে দুঃস্থ মানুষের সেবা করছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সংঘের সম্পাদক বীরেন্দ্র লাল চৌধুরী এবং সহ-সভাপতি বঙ্কিম চন্দ্র সেন রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া দু’টি শিশুকে তুলে আনেন। এই দুটি শিশুকে কেন্দ্র করে ১৯৪৪ সালে প্রবর্তক শিশুসদন গড়ে ওঠে। সদ্য মা হারা শিশুকন্যা মীরাকে নিয়ে বাবা দিশেহারা। সে সময়ে কন্যার ভবিষ্যতের কথা ভেবে বাবা মাত্র ৭ বছর বয়সে মীরাকে শিশুসদনে নিয়ে এলেন।
মীরাদি লিখেছেন, ‘প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা প্রবর্তকের মোহময় পরিবেশ আমার মনকে দিনে দিনে আকর্ষণ করেছে। প্রবর্তকের নিয়মকানুন, দৈনিন্দিন কর্ম তালিকা, উপাসনা, সংগীত, শিক্ষা, জঙ্গল পরিষ্কার করতে করতে ব্রতচারী গান, স্নেহময়ী দিদিমণি, দাদামনিদের আনন্দময় সাহচর্য্য সবকিছুই আমার জীবনে খুব প্রভাব বিস্তার করেছে। আমাকে যেন নতুন জন্ম দিয়েছে। অতি শৈশবে মাতৃহারা হয়ে প্রবর্তক আশ্রমে মাতৃস্নেহের অভাব বোধ করিনি। বীরেন দাদামণি ‘প্রবর্তকের সম্পাদক’ ধীরে ধীরে আমার পিতামাতার স্থান দখল করে নেন। তিনি আমাকে এক কঠোর ব্রত দিলেন। ১২ বছর পিতৃভূমিতে আমি যেতে পারব না। কঠিন ব্রহ্মচর্য গ্রহণ করালেন-তখন থেকেই এই সংঘ হয়ে ওঠে আমার পরম আশ্রয় স্থল’।
মীরাদি দীর্ঘ ৮৩ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু সদনে অনাথদের পরিচর্যায় কাটিয়ে দিলেন। বীরেন দাদামণির স্নেহ ছায়ায় কৃতিত্বের সাথে শিক্ষা জীবন শেষ করলেন। কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃত বিষয় এম এ ডিগ্রি লাভ করেন। ভালো ফলাফল করার জন্য তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করতে বলা হয় কিন্তু আশ্রমের কথা ভেবে তিনি সে প্রস্তাবে রাজি হননি। প্রবর্তক শিশুসদনে ফিরে আসেন। নিবাসী ছাত্র-ছাত্রীদের আধ্যাত্মিক, শারীরিক, মানসিক বিকাশে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন মীরাদি। ১৯৮২ তে নরওয়ের ওসলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘‘আন্তর্জাতিক গ্রীষ্মকালীন বিদ্যালয়’’ থেকে শিক্ষার উপর বিশেষ প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৮৬ থেকে কলকাতায় নারী শিক্ষার উন্নয়নে বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এই সবকিছুই অনাথ শিশুদের কল্যাণার্থে। সংঘের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি প্রবর্তক বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্বও পালন করেছেন। শিক্ষাব্রতী এই মহীয়সী নারী আজীবন নিয়মনিষ্ঠ ছিলেন। পরম যত্নে নিবাসী ছাত্রীদের পাঠদান এবং গান শেখাতেন। একজন দক্ষ সংগঠক মীরাদি। তৎকালে প্রবর্তকের ৫০০ এর উপরে আবাসিক ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ন্ত্রণ করেছেন দৃঢ়তার সাথে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করছি, প্রবর্তক শিশুসদন প্রবর্তক সংঘ (বাংলাদেশ) চট্টগ্রাম দ্বারা পরিচালিত। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর আহ্বানে ভারতবর্ষ চঞ্চল হয়ে উঠে। অসাধারণ মেধাবী শ্রী অরবিন্দের অনুপ্রেরণায় স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত হলেন পশ্চিম বাংলার চন্দন নগরের বিপ্লবী মতিলাল রায়। মতিলাল রায়ের প্রেরণায় একদল যুবক সংসার ত্যাগ করে দেশসেবায় আত্মোৎসর্গ করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে মতিলাল প্রবর্তিত ‘প্রবর্তক সংঘে’র পতাকাতলে সমবেত হন। তাঁর মধ্যে ছিলেন চট্টগ্রামে কয়েকজন সেবামন্ত্রে উদ্বুদ্ধ যুবক শ্রী বঙ্কিম চন্দ্র সেন, শ্রী হেম চন্দ্র রক্ষিত, শ্রী হরি চন্দ্র রক্ষিত, পঙ্কজ চৌধুরী সহ আরো কয়েকজন। ১৯২১ সালে মতিলাল রায়ের নির্দেশে পশ্চিমবঙ্গের চন্দননগর এবং চট্টগ্রামের শাকপুরা গ্রামে একই সঙ্গে প্রবর্তক সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। শাকপুরা থেকেই প্রথম সমাজসেবামূলক কাজ আরম্ভ হয়। স্বাবলম্বী হয়ে সমাজের সকলকে নিয়ে নিজেদের অধিকার সচেতনতা, শিক্ষার প্রসার, দরিদ্রের কর্মসংস্থান, চরকা কাটা, তাঁত বোনা, কাঠের কাজ করা এবং বিভিন্ন রকমের হাতের কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করা এসবই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। উপার্জিত অর্থ অন্যের কল্যাণে ব্যয়িত হবে। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম শহরের আসকার দিঘীর পাড়ে আশ্রম এর কার্যক্রম স্থানান্তরিত হয় এবং চট্টগ্রাম প্রবর্তক সংঘ স্থাপিত হয়। প্রথম সভাপতি শ্রী বঙ্কিমচন্দ্র সেন, সম্পাদক শ্রী হেমচন্দ্র রক্ষিত। ১৯৩০ সালে আবাসিক প্রবর্তক বিদ্যাপীঠ স্থাপিত হয়। আদর্শ স্বনির্ভর মানুষ তৈরীর জন্য প্রবর্তক সংঘের মধ্যে একটি আদর্শ শিক্ষা নিকেতন করার লক্ষ্যে সংঘের সাধকরা ৩০ জন আবাসিক ছাত্র নিয়ে ক্ষুদ্র কলেবরে বিদ্যাপীঠ এর সূচনা করেছিলেন ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ১৬ জুলাই। এই বিদ্যালয় কেবলমাত্র পাঠদানের একটি ক্ষেত্রমাত্র ছিল না। পিছনে ছিল একটি তপোবনের ব্যঞ্জনা। সহজ অনাড়ম্বর সুশৃংখল জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে আধ্যাত্মিক চেতনায় ঋদ্ধ হয়ে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন ছিল এর লক্ষ্য। ১৯৩৩ সালে বর্তমান অবস্থিত গোল পাহাড়ে প্রবর্তক সংঘ একটি বাঁশের বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়। এ পাহাড় তখন নানা হিংস্র জন্তু সংকুল ঘন অরণ্যে পূর্ণ ছিল। জানা যায় সংঘের কর্ম পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় সংঘের জন্য একটি বড় জায়গার প্রয়োজন দেখা দেয়। কর্মীরা চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন। অবশেষে হেমচন্দ্র রক্ষিত মহোদয়ের চেষ্টায় এই পাহাড় কুমিল্লার এক বিধবা মহিলার কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে কিনে নেওয়া হয়। অংশীদারদের কেউ কেউ দান হিসেবে তাঁদের অংশ সংঘের অনুকূলে প্রদান করেন। (সূত্রঃ শ্রী বীরেন্দ্র লাল স্মারক সংকলন জন্মশতবার্ষিকী পৃঃ ৬৭ সংকলক অমল দে) শুরু হোল সংঘের কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রম – জঙ্গল কাটা ,পাহাড় পরিষ্কার, বাসযোগ্য ঘর তৈরী করা ইত্যাদি । অল্প দিনের মধ্যে সম্পাদক হেমচন্দ্র রক্ষিতের জীবনাবসান হোল এবং সংঘ পরিচালনা করার গুরু দায়িত্ব বহন করেন আরেকজন ঋষিতুল্য সংসারত্যাগী মানুষ নতুন সম্পাদক শহীদ বীরেন্দ্রলাল চৌধুরী। তিনি চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র ছিলেন এবং মতিলাল রায়ের আদর্শ অনুসারী। ১৯৩৩ থেকে ১৯৭১ এর মার্চ পর্যন্ত বীরেন্দ্রলাল চৌধুরীর অক্লান্ত পরিশ্রমে সংঘের অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে। ক্রমান্বয়ে আবাসিক অনাথ মেয়েদের জন্য বিশাল মৈত্রেয়ী ভবন, ছেলেদের জন্য শংকর ভবন, মতিলাল ভবন প্রতিষ্ঠিত হয়। চিকিৎসা ও নার্সিং সুবিধার্থে প্রতিষ্ঠিত হয় আরোগ্য নিকেতন। প্রবর্তক শিশু সদন এবং প্রবর্তক বিদ্যাপীঠ এর প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে অনেকে আজ অনেকে সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ, অধ্যাপক, চিকিৎসক, আইনজীবী, প্রকৌশলী ও অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় প্রবর্তক সংঘের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এখনো কার্যক্রম অব্যাহত আছে।
১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রবর্তক সংঘ এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। এ সময় প্রবর্তক পাহাড়ে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অবস্থান নেওয়ায় সদনের ছেলে মেয়েদের নিরাপত্তার প্রশ্ন দেখা দিলে সম্পাদক বীরেন্দ্র লাল চৌধুরী শিশুসদনের বালক-বালিকাদের ও মহিলা কর্মীদের ধলঘাট হাই স্কুলে পাঠিয়ে দেন। বীরেন্দ্র চৌধুরী আশ্রমে রয়ে গেলেন। জানতেন মৃত্যু তাঁর দ্বারপ্রান্তে তবুও প্রবর্তক ছেড়ে তিনি যাননি। ২৮ শে মার্চ পাকহানাদার বাহিনী আশ্রমে ঢুকে বীরেন্দ্র লাল চৌধুরী এবং তাঁর চারজন সঙ্গীকে ধরে নিয়ে এক অজনা বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করলো। এরা এক মহান আদর্শের জন্য জীবন দান করে আমাদের কাছে চির স্মরণীয় হয়ে রইলেন। ‘ প্রবর্তক সংঘ’ একটি নাম মাত্র নয়, বিরাট দালান ঘরও নয় এর সাথে মিশে আছে ঋষিতুল্য কয়েকজন মানুষের স্বপ্ন ও আদর্শ। ১৯৭২ সালে প্রবর্তক সংঘের অন্যতম সংগঠক শ্রীমতি মীরা সিংহ যিনি প্রবর্তক কন্যা নামে পরিচিত এবং শ্রীমতি ঝর্ণাধারা চৌধুরী সংঘের কয়েকজন ছাত্রী নিয়ে সংঘে ফিরে আসেন। তখন সংঘের ভগ্নদশা। সংঘ পুনর্গঠনে তাঁরা আত্মনিয়োগ করলেন। তাঁদের শ্রম ও সংগঠন নৈপুণ্য বিশেষ ফল দিয়েছিল। তাঁদের কাছে প্রবর্তক সংঘের অপরিশোধ ঋণ। স্বাধীনতা-উত্তর বিধ্বস্ত সংঘের উন্নয়নকল্পে বাংলাদেশের মাননীয় মন্ত্রী মরহুম জহুর আহমেদ চৌধুরী সহ চট্টগ্রামের দানশীল ব্যক্তিরা এগিয়ে এলেন। এগিয়ে এলেন জার্মান সাহায্য সংস্থা ‘কোর’, ‘নরওয়ে সাহায্য সংস্থা’। ১৯৭৩ সালে সর্বসম্মতিক্রমে শহীদ বীরেন্দ্রলাল চৌধুরী নিকট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মীরা সিংহকে সংঘের সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হলো। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর অসাধারণ কর্মকুশলতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার ফলে আশ্রম ধীরে ধীরে তার পূর্বশ্রী ফিরে পায়।
বর্তমানে শিশু সদনে ৫৩০ জন ছাত্র-ছাত্রী আছে তার মধ্যে ১২৯ জন সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে মাসিক ২০০০ টাকা করে ক্যপিটেশন গ্রান্ড পায়। ১৯৮৪ সাল থেকে প্রবর্তক শিশু সদন সমাজসেবা অধিদপ্তরে রেজিস্ট্রেশনভুক্ত (রেজিঃ নং- চট্ট ১০৮৫/৮৪)। সমাজের পিছিয়ে থাকা পরিবারের সন্তানদের (অধিকাংশই অনাথ) সার্বিক কল্যাণে নিবেদিত প্রবর্তক সংঘের মতো এত বড় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি নেই। পরিদর্শন খাতা থেকে জানা যায়, অতীতে দেশ এবং বিদেশের বহু মনীষী এই প্রতিষ্ঠানে এসেছেন। সূচনালগ্ন থেকে যাঁদের আত্মত্যাগ, মেধা এবং অক্লান্ত পরিশ্রমে এই প্রতিষ্ঠানটির উত্তরোত্তর শ্রী বৃদ্ধি পেয়েছে সেই ঋষিতুল্য মানুষদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। পরবর্তিতে বিভিন্ন সময়ের প্রবর্তক সংঘের কার্যকরী কমিটি সঙ্ঘের উন্নতিকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। সংশ্লিষ্ট সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রবর্তক সংঘের অতীত ঐতিহ্য বজায় থাকবে এই কামনা করি।
লেখক : শিক্ষাবিদ